
আওয়ামী লীগ আমলে তিনটি বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেসব ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তাঁদের সবাইকে এবারের নির্বাচনে বাদ রাখা সম্ভব হবে না বলেই নির্বাচন কর্মকর্তারা মনে করছেন। বিশেষ করে পেলিং অফিসারদের সবাইকে বাদ দেওয়ার বিষয়টি অসম্ভব। তাঁরা বলছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁদের সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে চার লাখ। দশম ও দ্বাদশ মিলিয়ে এই সংখ্যা পাঁচ লাখের ওপরে হতে পারে।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, আওয়ামী লীগ আমলের তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে যেসব প্রশাসনিক কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তাঁদের বাদ রাখা যেতে পারে। প্রিজাইডিং অফিসারদের ক্ষেত্রে জেলা ও বিভাগীয় শহর এলাকার আসনগুলোতে বিতর্কিত নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারীদের একাংশকে বাদ রাখা যেতে পারে।
ওই কর্মকর্তা আরো জানান, এবার ভোটকেন্দ্রের সঙ্গে ভোটকক্ষ এবং ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের সংখ্যাও বাড়বে। প্রায় ৪৭ হাজার ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ হতে পারে।
অবশ্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এম এম নাসির উদ্দিন গতকাল শনিবার রংপুরে বলেছেন, ‘বিগত সময়ে যাঁরা নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁদের যথাসম্ভব বাদ দিয়ে নতুন লোক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যোগ করা হবে।’
রংপুর অঞ্চলের নির্বাচন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়সভা শেষে তিনি সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। সিইসি গতকাল সকালে রংপুর নগরের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে এ মতবিনিময়সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন।
তিনি নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা ঠিক রাখা বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করলেও আশা প্রকাশ করেন, পরিস্থিতি ধীরে ধীরে ভালো হচ্ছে। নির্বাচনের সময় আরো ভালো হবে।
সিইসি বলেন, ‘নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে দেশে যে বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তার পরও আমি বলব, গত বছরের জুলাই-আগস্টের পর আইন-শৃঙ্খলার অনেক উন্নতি হয়েছে। আমরা ঘুমাতে পারছি। আমাদের পুলিশ ভাইয়েরা ঘুমাতে পারছেন না, তাঁরা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। ইলেকশন আসতে আসতে আরো ভালো হবে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সবাইকে নিয়ে আমরা এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করতে চাই, মানুষ যাতে নির্ভয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন।’
সিইসি আরো বলেন, ‘নির্বাচনী সিস্টেম, নির্বাচন কমিশন এবং যাঁরা নির্বাচন পরিচালনা করেন, সেই প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ওপর মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে। প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, প্রিসাইডিং অফিসার—সবাই মিলে যে সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে পারে, এ বিশ্বাস ও আস্থা সৃষ্টি করা বড় চ্যালেঞ্জ। মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার অভ্যাস ভুলে গেছে। মানুষকে কেন্দ্রমুখী করা, সবাইকে নিয়ে আসাও চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে। এটা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হয়েছে। সেসব দেশের সঙ্গে তুলনা করলে আমি বলব, বাংলাদেশে অবস্থা অনেক ভালো।’
অস্ত্রের চেয়ে এআই ও সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার মারাত্মক চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে বলেও মন্তব্য করেন সিইসি। তিনি বলেন, ‘পেশাদার সাংবাদিকরা নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও জবাবদিহিমূলক করার জন্য ভূমিকা রাখবেন, এটা ভালো দিক। কিন্তু যাঁরা ফেসবুক সাংবাদিক হয়েছেন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে বিভিন্ন খণ্ডিত বক্তব্য প্রকাশ করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কী করা যায়, আমরা ভেবে দেখছি।’
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে সিইসি বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন : নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য বেগম জেসমিন টুলি বিষয়টি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে কালের কণ্ঠকে বলেন, আওয়ামী লীগ আমলের বিতর্কিত তিনটি নির্বাচনে যাঁরা পোলিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন, তাঁদের অনেকেই ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ওই দুটি নির্বাচনে তাঁদের দায়িত্ব পালন নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি। গণহারে ওই সব পোলিং অফিসারকে বাদ দিলে তো লোক সংকট দেখা দেবে। আর যাঁদের জন্য যাঁদের ভয়ে তাঁরা পক্ষাপাতমূলক আচরণ করবেন তারা তো আর দৃশ্যপটে নেই। তবে এসব পোলিং অফিসারের মধ্যে যাঁরা দুর্নীতিবাজ, সুযোগ সন্ধানী, তাঁদের সংখ্যা বেশি হবে না, তাঁদের চিহ্নিত করে বাদ রাখা যেতে পারে। আর রিটার্নিং অফিসার, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী এবং নির্বাচন কমিশন সঠিক ও নিরপেক্ষ আচরণ করলে পোলিং অফিসাররা সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না। প্রিজাইডিং ও সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারদের মধ্যে যাঁদের দলীয় সিল রয়েছে তাঁদের বাদ রাখতে হবে।
বেগম জেসমিন টুলি আরো বলেন, ওই তিন নির্বাচনে যাঁরা রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁদের অনেকেই হয়তো আগের পজিশনে নেই। যাঁরা আছেন, তাঁরা যেন এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের সুযোগ না পান তার ব্যবস্থা নিতে হবে। নির্বাচন কমিশন এ ক্ষেত্রে নিজেদের লোককে (আঞ্চলিক, জেলা ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা) রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারে দায়িত্ব দিতে পারে।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. আবদুল আলীম এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিতর্কিত তিনটি নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের সবাইকে বাদ দেওয়া কঠিন। আমার জানা মতে, ওই তিন নির্বাচনে অনেকে দায়িত্ব পালন করতে চাননি। চাকরি হারানোর ভয় বা অন্য কোন চাপে বাধ্য হয়েছেন। একজন প্রিজাইডিং অফিসারের কথা জানি, তিনি তাঁর ভোটকেন্দ্রে জোর করে ব্যালটে সিল মারতে রাজি ছিলেন না। এসপি নিজে এসে এই কাজটি করেন। পরে এসপি তাঁকে অফিসে ডেকে নিয়ে বলেন, তুমি হিন্দু না হলে জামায়াতের লোক সাজিয়ে জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করতাম।’
আবদুল আলীম আরো বলেন, বিতর্কিত তিনটি নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করেছেন—এই যুক্তিতে গণহারে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের এবারের নির্বাচনে বাদ রাখা ঠিক হবে না। স্থানীয়ভাবে তাঁদের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করে যাঁরা সত্যিই নিজের ইচ্ছায় ওই তিন নির্বাচনে অনিয়মে যুক্ত ছিলেন তাঁদের বাদ দিতে হবে।
শতভাগ ভোট পড়া কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের তথ্য তলব : নির্বাচনে শতভাগ ভোট পড়া অসম্ভব একটি বিষয়। ভোটার এলাকার ভোটারদের মধ্যে মৃত, অসুস্থ ও প্রবাসী ভোটার থাকটাই স্বাভাবিক। তাঁরা ভোট দিতে পারেন না। কিন্তু শতভাগ ভোট পড়ার ঘটনা ঘটে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে প্রায় সব দল অংশগ্রহণ করলেও নির্বাচনটি রাতের ভোটের নির্বাচন নামে পরিচিতি পায় এবং কমপক্ষে ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ এবং ৯০ থেকে ৯৯.৯৯ শতাংশ ভোট পড়েছে সাত হাজার ৬৮৯টি কেন্দ্রে। ভোট পড়ার এই অস্বাভাবিক ও অবিশ্বাস্য হার ছাড়াও নির্বাচনটি ছিল নানা অভিযোগে অভিযুক্ত। ২০১৯ সালের ১৯ জানুয়ারি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, ৫০ আসনের মধ্যে ৪৭টিতে অনিয়ম হয়েছে। নির্বাচনের দিন সংঘটিত এসব অনিয়মের মধ্যে ছিল প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর নীরব ভূমিকা, জাল ভোট দেওয়া, নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল মেরে রাখা, বুথ দখল করে প্রকাশ্যে সিল মেরে জাল ভোট, পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়া ও কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া, ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়া, ভোটারদের জোর করে নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করা, ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যাওয়া, আগ্রহী ভোটারদের হুমকি দিয়ে তাড়ানো, ব্যালট বাক্স আগে থেকে ভরে রাখা এবং প্রতিপক্ষ দলের প্রার্থীর নেতাকর্মীদের মারধর করা।
এই প্রেক্ষাপটে গত জুন মাসে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেসব কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে, সেসব কেন্দ্রের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তথ্য চেয়ে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দেয়। ২৩ জুন দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন নিজস্ব কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে এ তথ্য জানান। একই সঙ্গে ২০১৪ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে দায়িত্বে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করা কর্মকর্তাদেরও খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে বলে জানা যায়। গত জানুয়ারিতে এই অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। গঠন করা হয় পাঁচ সদস্যের কমিটি।
পিবিআইও তথ্য চায় : পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনও (পিবিআই) গত ৩ জুলাই নির্বাচন কমিশনের কাছে বিতর্কিত তিন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব্বে থাকা রিটার্নিং অফিসার, প্রিজাইডিং অফিসারসহ অন্য কর্মকর্তাদের তথ্য চেয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন গত ২০ জুলাই সংশ্লিষ্ট ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের নাম-ঠিকানা, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট নম্বর, মোবাইল নম্বরসহ আরো কিছু তথ্য পেতে সব বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের কাছে চিঠি দিয়েছে। নির্বাচন কর্মকর্তারা মনে করছেন, এসব তথ্য বিতর্কিত নির্বাচনের বিতর্কিত ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের শনাক্তে কাজে লাগতে পারে।
এসব বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের তালিকা এখনো তৈরি হয়নি। প্রাথমিক তালিকা তৈরি হলে তখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলা যাবে কারা বাদ পড়বেন। সরকারের অনেক সংস্থাও এ ধরনের তালিকা চাচ্ছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত এ বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত হয় তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করবেন আট লাখের বেশি ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা : নির্বাচন কমিশন সচিবালয় সূত্র জানায়, একতরফা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৯ আসনে ৪২ হাজার ১৪৯ ভোটকেন্দ্রের ২,৬১,৯১২ ভোটকক্ষের জন্য প্রায় সাড়ে ছয় লাখ ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা দায়িত্বে ছিলেন। এর মধ্যে রিটার্নিং অফিসার ছিলেন ৬৬ জন (প্রতি জেলায় একজন এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে দুজন করে), সহকারী রিটার্নিং অফিসার ৫৯২ জন (৪৯৩ জন ইউএনও, ৫৬ জন উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, ১৮ জন স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক, আটজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, ১১ জন জোনাল এক্সিকিউটিভ অফিসার ও পাঁচজন ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের কর্মকর্তা), ৪২ হাজার ১৪৯ জন প্রিজাইডিং অফিসার, ২,১০,৭৪৫ জন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও চার লাখ ২১ হাজারের মতো পোলিং অফিসার দায়িত্ব পালন করেন। এবার ৪৭ হাজার ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করতে পারেন সব মিলিয়ে আট লাখের বেশি ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা।