Image description

গত বছর, ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় বাংলাদেশের ব্যাংক খাত সংকট গভীরতার শিখরে পৌঁছে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল। ব্যাংকখাতের নানা দুর্বলতা ও ঋণসংকট দেশের অর্থনীতির ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলছিল এবং এটি দ্রুত সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সামনে নিয়ে এসেছিল। সেই সময়ে ব্যাংকখাত সংকট যেন কঙ্কালের মতো মাথার ওপর দাঁড়িয়ে থেকে দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের পথে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

সেই সময় ডলারের বিনিময় হার ছিল ১২৮ টাকা, যা সাধারণ বাজারে ছিল অস্বাভাবিক উচ্চ। দেশের জিডিপির জন্য প্রাণমাতার মতো গুরুত্বপূর্ণ রেমিট্যান্স প্রবাহও বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়ে পৌঁছে গিয়েছিল ১০.৪৯ শতাংশ, যা মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলেছিল।

এসব সংকটের পেছনে ছিল দীর্ঘদিনের ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতি, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, অনিয়ম আর প্রশাসনিক দুর্বলতা। এ সময় বাজারে আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করছিল।

তবে, ২০২৪ সালের আগস্টের পরপরই সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর ও যুগোপযোগী পদক্ষেপ নিয়ে আর্থিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার যাত্রা শুরু করে। আর আজ, মাত্র এক বছরে সেই বিপর্যয়ের অর্ধেক কাটিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন শাসন ব্যবস্থার ফলস্বরূপ ব্যাংক খাত আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, সংকট থেকে ক্রমশ মুক্তি পাচ্ছে।

ইসলামী ব্যাংকের টার্নঅ্যারাউন্ড: সংকট থেকে প্রত্যাবর্তন

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশোধনমূলক উদ্যোগের অন্যতম সফল উদাহরণ হিসেবে আলোচনায় এসেছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড।

২০১৭ সালে চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর ঋণ বিতরণে দেখা যায় ব্যাপক অনিয়ম। নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ ঋণ বিতরণ হয়, যা ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা দুর্বল করে তোলে। এর ফলে ব্যাংকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ২ হাজার ৩০৮ কোটি টাকার জরুরি ‘ডিমান্ড লোন’ নিতে বাধ্য হয়, কারণ ব্যাংকটি তার গ্রাহকদের আমানত থেকে নির্ধারিত ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (সিআরআর) বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়।

তবে ২০২৫ সালের জুন ও জুলাই- মাত্র দুই মাসে ব্যাংকটি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ঋণের ১ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। জুনে ৮০৮ কোটি এবং জুলাইয়ে ৭০০ কোটি টাকা ফেরত দিয়ে প্রায় ৮০০ কোটি টাকার ঋণ বাকি রেখেছে।

নবনিযুক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ওমর ফারুক খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘গত বছরের আগস্টে আমাদের সিআরআর ছিল নেগেটিভ ২ হাজার ৩০৮ কোটি টাকা। আমরা এখন ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের আমানত বৃদ্ধি পাচ্ছে, গ্রাহকদের আস্থা ফিরে আসছে এবং আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী সিআরআর বজায় রাখতে পারছি।’

তিনি জানান, গত এক বছরে ইসলামী ব্যাংকের নিট আমানতে প্রবৃদ্ধি প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা হয়েছে, যা একটি বড় সাফল্যের দিক নির্দেশ করে।

সরকারের পরিবর্তন বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ

বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ব্যাংক খাতের রোগ নিরাময়ের লক্ষ্যে শক্তিশালী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তিনি ব্যাংক খাতে দুর্নীতি ও খেলাপি ঋণের প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ করে জানিয়েছেন, আগে ধারণা করা হচ্ছিল খেলাপি ঋণের হার ৯ শতাংশ, কিন্তু বাস্তবে তা ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। উল্লেখ্য, ব্যাংক খাতের ‘রোগ’ নির্ণয় করতে এক ডজনের বেশি ব্যাংকে পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করা হয়। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর ‘রোগ’ নির্ণয়ের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ওষুধ’ দেওয়া শুরু করে।

বাংলাদেশ ব্যাংকখেলাপি ঋণ তারল্য সংকট মোকাবিলায় ৫টি বড় সংস্কার চালু করেছে:

১. খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র প্রকাশ ও আন্তর্জাতিক মানের ঋণ শ্রেণিকরণের নিয়ম প্রয়োগ

২. দুর্বল ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভূতকরণের মাধ্যমে পুনর্গঠন

৩. কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কমানো

৪. মুদ্রানীতি কঠোরকরণ ও বাজারভিত্তিক মুদ্রাবিনিময় হার চালু এবং

৫. ঋণ আদায় প্রক্রিয়া দ্রুততর করতে অর্থঋণ আদালত আইনের সংস্কার।

এই সংস্কার কার্যক্রমে ইতোমধ্যে ১৪টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে এবং দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে শীর্ষ কর্মকর্তাদের অপসারণ করা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অবশ্য অর্থনীতির জন্য উদ্বেগজনক সংকেত হিসেবে দেখা দিয়েছিল মূল্যস্ফীতির গতিপ্রকৃতিতে পরিবর্তন। গত তিন বছর ধরে প্রায় ৯ শতাংশের আশেপাশে স্থিতিশীল থাকা মূল্যস্ফীতি কিছুটা শিথিল হওয়ার পর ধারাবাহিকভাবে তিন মাস কমতে থাকে। কিন্তু জুলাই মাসে হঠাৎ করে এই প্রবণতা উল্টে গিয়ে মূল্যস্ফীতি বাড়তে শুরু করেছে, যা মূল্য স্থিতিশীলতা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।

অপরদিকে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বা ফরেক্স রিজার্ভ পুনরায় বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং দীর্ঘদিন ধরে অস্থিতিশীল থাকার পর মুদ্রার বিনিময় হারেও স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে, যা অর্থনীতির জন্য একটি ইতিবাচক দিক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

এদিকে বাজার স্বাভাবিক রাখতে নিলামের মাধ্যমে ডলারের দরপতন রোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের কৌশলগত হস্তক্ষেপ সফলভাবে কাজ করছে। এক মাসের কম সময়ের মধ্যে চার দফায় মোট ৫৩৯ মিলিয়ন ডলার কেনার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছে।

এরই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) ডলার কেনার জন্য নিলাম আহ্বান করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো থেকে ১২১.৩৫ থেকে ১২১.৫০ টাকার মধ্যে সর্বমোট ৪৫ মিলিয়ন ডলার কেনা হয়েছে। এর আগে ২৩ জুলাই নিলামে ১২১.৯৫ টাকার কাট-অফ রেটে ১০ মিলিয়ন ডলার ক্রয় করা হয়েছিল। এই তথ্য থেকে দেখা যায়, বাজারে ডলারের সিগন্যাল রেট গত কয়েকদিনে অন্তত ৪৫ বেসিস পয়েন্ট কমেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই ক্রয় কার্যক্রম শুরু হয় ১৩ জুলাই থেকে, যখন প্রথমবারের মতো নিলামের মাধ্যমে ১২১.৫০ টাকায় ১৭১ মিলিয়ন ডলার কেনা হয়। এর পর ১৫ জুলাই একই রেটে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে আরও ৩১৩ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, মূল উদ্দেশ্য হলো ডলারের দ্রুত দরপতন রোধ করা এবং বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।

এ ধরনের কৌশলগত হস্তক্ষেপ রেমিট্যান্স ও রফতানি খাতকে চাঙ্গা রাখতে সহায়ক হিসেবে কাজ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

সংকট কাটিয়ে সুস্থতার লক্ষণ

গত এক বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল সূচকগুলোতে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে, যা ব্যাংকখাতের স্বাস্থ্যের নতুন পরিচায়ক।

২০২৪ সালের ২৮ আগস্ট সরকার আর্থিক খাতের উন্নয়নে একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করে। এর কিছুদিন পর, ১১ সেপ্টেম্বর ব্যাংকখাত সংস্কারের লক্ষ্যে একটি বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। এই উদ্যোগগুলোর মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশের আর্থিক খাতের দুর্বলতা শনাক্ত করে দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই সমাধানের পথ প্রস্তুত করা।

ডলারের বিনিময় হার ১২৮ টাকা থেকে ১২০ টাকায় নেমে এসেছেডলারের বিনিময় হার ১২৮ টাকা থেকে ১২০ টাকায় নেমে এসেছে

রিজার্ভে দৃঢ় স্থিতিশীলতা

কোভিড-পরবর্তী সময়ে অতিরিক্ত আমদানি ব্যয় এবং অর্থপাচারের ফলে ২০২১ সালের আগস্টে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দ্রুত হ্রাস পেতে শুরু করে। ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে আইএমএফের বিপিএম৬ পদ্ধতিতে রিজার্ভের পরিমাণ মাত্র ২০.৪৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। তবে, অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগ এবং নানা কৌশলগত পদক্ষেপের মাধ্যমে এক বছরের মধ্যে রিজার্ভ বাড়িয়ে ২৫.০৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা সম্ভব হয়। বর্তমানে সাধারণ হিসাব অনুযায়ী রিজার্ভ প্রায় ৩০.০৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, ‘রিজার্ভ থেকে কোনও বড় পরিশোধ করতে হয়নি, বরং কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে অতিরিক্ত ডলার কেনা শুরু করে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করছে।’

ডলারের বিনিময় হার: ১২৮ টাকা থেকে ১২০ টাকায় নেমে এসেছে, যা বাজারে স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত দেয়।

মূল্যস্ফীতি: ১০.৪৯ শতাংশ থেকে কমে ৮.৫৫ শতাংশে নেমেছে, এবং আশা করা হচ্ছে আগামী বছরের মধ্যে ৫ শতাংশের নিচে নামবে।

রেমিট্যান্স প্রবাহ: বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বৃদ্ধি ও হুন্ডি দমন প্রচেষ্টায় রেমিট্যান্স প্রবাহ প্রতি মাসে গড়ে ৩ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি উন্নীত হয়েছে।

এসব পরিবর্তন একদিকে আমানতকারীদের আস্থা ফিরিয়ে এনেছে, অন্যদিকে ব্যবসায়িক কার্যক্রমে স্থিতিশীলতা ও গতি আনার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।

অন্যান্য ব্যাংকের উন্নতি দুর্বল ব্যাংকের পরিকল্পিত পুনর্গঠন

ইসলামী ব্যাংকের পাশাপাশি ইউসিবি ও কয়েকটি ব্যাংক ইতোমধ্যে তারল্য সংকট কাটিয়ে উঠেছে। তবে এখনও রয়েছে কয়েকটি দুর্বল ব্যাংক, যাদের খেলাপি ঋণের হার ৭০ থেকে ৯৫ শতাংশের মধ্যে।

বাংলাদেশ ব্যাংক এইসব ব্যাংক একীভূত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, যাতে সেগুলোকে আপাতত সরকারি ব্যাংক হিসেবে পরিচালনা করা হবে। পরে বেসরকারি খাতে ফেরানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে, যেখানে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অংশগ্রহণ করবে।

নতুন ব্যাংক কোম্পানি আইনের মাধ্যমে একই পরিবার থেকে পরিচালকদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে এবং অন্তত ৫০ শতাংশ পরিচালক স্বতন্ত্র হবেন, যাদের নিয়োগ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত প্যানেল।

নেপথ্যের চ্যালেঞ্জ বাধা

বাড়তে থাকা খেলাপি ঋণ, দুর্নীতি, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কমানো এবং সম্পদ উদ্ধারের ধীরগতি — এসব এখনও ব্যাংক খাতের বড় চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর স্বীকার করেছেন, বিগত আওয়ামী লীগের আমলে আনুমানিক ১৭ থেকে ২০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে ব্যাংক খাত থেকে, যা খেলাপি ঋণের প্রায় অর্ধেক। তিনি বলেন, ‘সম্পদ উদ্ধারে টাস্কফোর্স গঠন করা হলেও বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুসারে মামলা প্রস্তুত করতে সময় লাগছে।

তবে সরকার আলোচনার মাধ্যমে ধীরে ধীরে সম্পদ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে, কারণ একেবারে কঠোর আইনি পথে দ্রুত ফল আনা সম্ভব নয়।

ভবিষ্যতের রূপরেখা

ইসলামী ব্যাংক আশাবাদী সেপ্টেম্বরের মধ্যে বাকি ঋণও পরিশোধ করবে। বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি আগামী ২০২৬ সালের মধ্যে ৫ শতাংশের নিচে নামানোর লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক একীভূতকরণ ও সুশাসন নিশ্চিত করতে আরও উদ্যোগ নিচ্ছে, যা দেশের ব্যাংক খাতকে দীর্ঘমেয়াদে আরও মজবুত করবে। আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলোর নজরেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ইতিবাচক সংকেত পাঠাচ্ছে।

সুশাসনের পথে ব্যাংক খাতের নতুন গল্প

বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর নজরদারি, কার্যকর আইন-আদালত সংস্কার, ও সুশাসন নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে ব্যাংক খাত এখন ক্রমশ সুস্থ হচ্ছে। যদিও আগের দুঃসময়ের ছায়া পুরোপুরি মুছে যায়নি, তবু বর্তমান পরিস্থিতি ভবিষ্যতের জন্য আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

এই পুনর্জাগরণ প্রমাণ করে যে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও যথাযথ নিয়মনীতি ছাড়া অর্থনৈতিক খাতের সুস্থতা সম্ভব নয়।

গত এক বছরে নেওয়া নিয়ন্ত্রক সংস্কারগুলো ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা বাড়ালেও গোপন রাখা খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে পুনরুদ্ধারের পথ জটিল হয়েছে। ব্যাংক খাতের বাইরেও বিমা ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে সংকট মোকাবিলায় কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বেশ কিছু জীবনবীমা কোম্পানি দেউলিয়ার মুখে, অথচ গ্রাহকদের সুরক্ষায় সরকারি সংস্কার এখনও বিলম্বিত।

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলছেন, ব্যাংকিং খাতে সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ ও সংস্কার প্রয়োজন ছিল, সেখানে অগ্রগতি স্বল্পমাত্রায় সীমাবদ্ধ থেকেছে।‌

তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতে শুরু করা সংস্কারগুলো প্রশাসনিক রদবদল ও নীতিগত অস্থিরতার কারণে দেরিতে এগিয়েছে। অপ্রদর্শিত খেলাপি ঋণের সঠিক হিসাব প্রকাশের জন্য নতুন রিপোর্টিং ব্যবস্থা চালু করা হলেও দুর্বল ব্যাংকগুলো পুনর্গঠনের বিষয়ে এখনও কোনও চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘সরকার যদি অন্তত এক-দুইটি বড় সমস্যাপ্রবণ ব্যাংক পুনর্গঠন করতো, তাহলে সেটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতো। কিন্তু সে সুযোগ তারা হাতছাড়া করেছে।’

মূল্যস্ফীতির সাম্প্রতিক সময়ে অপ্রত্যাশিত উত্থান উদ্বেগের বিষয় বলে জানান তিনি। বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি কমেছে ঠিকই, কিন্তু তা এখনও সরকারের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। তাছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এখন সরকারের অগ্রাধিকার তালিকার নিচে নেমে গেছে। এর সঙ্গে মিলিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫০০ মিলিয়ন ডলার কিনেছে, যা সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির পরিপন্থি এবং মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বাড়াতে পারে।’

ডা. জাহিদ আরও বলেন, ‘টাকার বিনিময় হার দীর্ঘদিন স্থিতিশীল থাকলেও ডলার কেনার কারণে বাজারে অতিরিক্ত টাকা সরবরাহ হয়ে টাকার মানে চাপ পড়ে এবং মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা ব্যাহত হয়।’

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড.  ফাহমিদা খাতুন স্বীকার করেন, ব্যাংক খাতে কিছু সংস্কার হয়েছে; দুর্বল ব্যাংকগুলোর ফরেনসিক অডিট সম্পন্ন করা হয়েছে এবং পাচার অর্থ উদ্ধারে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

তবে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের তহবিল সহায়তা সত্ত্বেও এখনও কিছু দুর্বল ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারেনি।’