
শাহিন আলম। একজন সাব-রেজিস্ট্রার। কর্মজীবনে যেখানে গেছেন সেখানেই বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন। জাল দলিল ও বেনামি দলিল প্রদানে ঘুষ নিয়ে একাধিকবার শিরোনাম হয়েছেন। কাগজপত্র ছাড়া ভুয়া দলিল সৃজন করে দুদকের মামলায়ও ফেঁসেছেন। গত ১০ বছরে নামে-বেনামে শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন। ঢাকা, ফরিদপুর ও গোপালগঞ্জে স্ত্রী, মা, ভাই ও শাশুড়ির নামে অন্তত ৫০ বিঘার উপরে জমি কিনেছেন। অল্প সময়ে বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট, মাছের ঘের, গরুর খামার, হোটেল, দোকান, শো-রুমসহ বিপুল সম্পদ গড়েছেন। তবে সম্পদ অর্জনে চাকরি ছাড়া শাহীন আলমের বৈধ কোনো উৎস নেই। মানবজমিনের হাতে আসা কাগজপত্রে দেখা গেছে, শাহীন আলম ঢাকার তেজগাঁওয়ে দু’টি ১০ তলা বাড়ি করেছেন। বকশিবাজার ও কামরাঙ্গীরচরে দু’টি বাড়ি ও ২টি ফ্ল্যাট কিনেছেন। পরিবার নিয়ে বসবাস করেন মোহাম্মদপুর চাঁন মিয়া হাউজিংয়ের নিজের নামে কেনা ২ হাজার স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে। এ ছাড়া সাভার, বাড্ডা, মেরাদিয়া, ফতুল্লা, রূপগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ ও বছিলায় জমি রয়েছে শাহীন আলমের। যশোরের ঝিকরগাছা সাব-রেজিস্ট্রার অফিস সূত্রে জানা গেছে, শাহীন আলম প্রতি রোববার সকালে ঢাকা থেকে বিমানযোগে যশোর যান। পরে সেখান থেকে ঝিকরগাছা সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে পৌঁছান। ৫ দিন ডিউটি শেষে বৃহস্পতিবার বিকালে অফিস শেষ করে আবার বিমানে করে ঢাকায় ফেরেন। সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের এক কর্মচারী বলেন, সপ্তাহ শেষে শাহীন আলম ঢাকায় ফেরার সময় ফ্লাইটে ব্যাগভর্তি টাকা নিয়ে ফেরেন। পরে এয়ারপোর্ট থেকে তার ব্যক্তিগত গাড়ির ড্রাইভার তাকে বহন করে মোহাম্মদপুরের বাসায় ফেরেন। শাহিন আলমের আয়কর নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তিনি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩ লাখ ৮৪ হাজার ২২৮ টাকা আয়ের তথ্য দিয়েছেন। তবে এই আয়করে তিনি ২ লাখ ৩৫ হাজার ২২৮ টাকা ঋণ দেখিয়েছেন। এ ছাড়া বর্তমানে তিনি ৫০ লাখ ৩৮ হাজার ৭৯২ টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসাব দিয়েছেন। কিন্তু তিনি বেতন পান ৩৮ হাজার টাকা। এতে তার আয়-ব্যয়ে ব্যাপক পার্থক্য দেখা গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকার মোহাম্মদপুর ও ভাটারা এলাকায় ডেভেলপার কোম্পানি ও ভূমি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আয় করেন শাহীন আলম। তিনি সম্প্রতি তার শ্বশুরবাড়ি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী সদর ইউনিয়নের পোনা গ্রামে দুই একর জমিতে মাছের ঘের তৈরি করে মাছ চাষ করছেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত এপ্রিলে ঝিকরগাছা ১নং ওয়ার্ডের দুই নম্বর কলোনির ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তি ঝিকরগাছা শ্রমজীবী সমবায় সমিতির মালিকানা দেখিয়ে ঝিকরগাছা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে জাল দলিল রেজিস্ট্রেশন হয়। পূর্বের সাব-রেজিস্ট্রার এই জমির দলিল রেজিস্ট্রি ফেরত দিলেও শাহীন আলম যোগদান করে প্রতারণার মাধ্যমে দলিলটি রেজিস্ট্র্রি সম্পন্ন করেন। এ নিয়ে এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়।
নামে বেনামে যত সম্পদ: সাব-রেজিস্ট্রার শাহীন আলম তার ছোটভাই ইকবাল হোসেনের নামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ কেনেন। এরমধ্যে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার পিঙ্গালিয়া মৌজায় বিএস ১৫৮৪নং খতিয়ানের ১৬৯৭নং দাগে ১২ শতাংশ, ১৭১০নং দাগে ৯ শতাংশ, ১৬৯০নং দাগে ২২.৫ শতাংশ। এ ছাড়া মা ফরিদা ইয়াসমিনের নামেও জমি কেনেন। এরমধ্যে ঢাকা তেজগাঁও বড় বেরাইদ ৯নং মৌজায় ৯৬৫২নং খতিয়ানের ৫০৩নং দাগে ৫ শতাংশ ও ৫০৫নং দাগে ৩.২৫ শতাংশ। যেখানে দু’টি বাড়ি নির্মাণ করা হয়। এ ছাড়া লালবাগ থানার চরকামরাঙ্গী ৩নং মৌজায় ২৫৩৯১ খতিয়ানে ১৭৩৮নং দাগে ৪.২৫ শতাংশ। লালবাগ শিবপুর ৯নং মৌজায় ১১৫২৭ নং খতিয়ানের ২১নং দাগে ১.০১১ শতাংশ জমি কেনেন শাহীন আলম। যার আনুমানিক বাজারমূল্যে ১০ কোটি টাকার উপরে। ২০১৫ সাল থেকেই শাহীন আলম তার স্ত্রী সারমিন সুলতানার নামে জমি কেনা শুরু করেন। এরমধ্যে ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার ইছাপাশা মৌজায় ৮৩৭নং খতিয়ানের ১১নং দাগে ২১ শতাংশ। বাকাইলনগরকান্দা মৌজায় ১১৮৭নং খতিয়ানের ২০৪নং দাগে ১১ শতাংশ ও ২১০নং দাগে ২০ শতাংশ। গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার পিঙ্গালিয়া মৌজার ১৫৮৫নং খতিয়ানের ১৬৯৭নং দাগে ১৫ শতাংশ, ১৭১০নং দাগে ৯ শতাংশ জমি রয়েছে। এই জমির বাজারমূল্যে প্রায় ৩ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৫ই আগস্টে সরকার পতনের পর সরকারি কর্তকর্তাদের সম্পদ বিবরণী দাখিল করতে নির্দেশ দেন অন্তর্বর্তী সরকার। তখন বিপাকে পড়ে শাহীন আলম। পরে কৌশলে নিজের ও স্ত্রীর নামে থাকা সমস্ত জমি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলায় বসবাস করা তার শাশুড়ি শামিমা আক্তার ও শ্বশুর মিজানুর রহমানের নামে লিখে দেন। কাশিয়ানী সদর ইউনিয়নের বিভিন্ন মৌজায় শাহীন আলমের শাশুড়ি ও শ্বশুরের নামে ৪০ বিঘার উপরে জমি রয়েছে। যা শাহীন আলমের টাকায় কেনা। এ ছাড়া বিদেশেও সম্পদ করেছেন শাহীন আলম। অনুসন্ধানে জানা গেছে, শাহীন আলমের পৈতৃক নিবাস ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাঁকাইল গ্রামে তার একটি একতলা বাড়ি রয়েছে। অথচ চাকরি পাওয়ার আগেও তাদের টিনের ভাঙাচোরা ঘর ছিল। এ ছাড়া বাঁকাইলের পাশেই তিনি আরও ২০ শতকের একটি প্লট কিনেছেন। যার মূল্য এক কোটি টাকা। সাব-রেজিস্ট্রার তার ভাইয়ের নামে ৪.২৫ অজুতাংশ জমি ক্রয় করেন এবং সেখানে ছয়তলা ভবন তৈরি করেন। প্রতিটি ফ্লোরের আয়তন প্রায় ১,৫৯০ বর্গফুট। পরে এই ভবন ও জমি তার ভাইয়ের নাবালক ছেলে-মেয়ের নামে ‘হেবামূলে’ রেজিস্ট্রেশন করে দেন। যার দলিল নম্বর ৫৯৮২ ও রেজিস্ট্রি খরচ হিসেবে চার লাখ টাকা দেখানো হয়েছে।
সচিবালয় ঘেরাও করেন শাহীন আলম: ২০২৪ সালের ১৮ই আগস্ট সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাধ্যতামূলক সম্পদ বিবরণী জমা দেয়ার নির্দেশ দেন অন্তর্বর্তী সরকার। এতে সাব-রেজিস্ট্রাররা চরম ক্ষুব্ধ হয়। ওই মাসের ২৭ তারিখ বিকালে ৭০ থেকে ৮০ জন সাব-রেজিস্ট্রার একযোগে আইন মন্ত্রণালয়ের প্রবেশমুখে আন্দোলন করেন। এ সময় তারা উপসচিব (রেজিস্ট্রেশন) আবু সালেহ মো. সালাহউদ্দিন খাঁ ও সিনিয়র সহকারী সচিব মুরাদ জাহান চৌধুরীর কক্ষে গিয়ে তাদের ঘিরে ধরেন। হুমকি-ধামকি দিয়ে সম্পদের তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানান। কেউ কেউ সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের নেমপ্লেট ভেঙে ফেলেন। এতে নেতৃত্ব দেন মোহাম্মদপুরের শাহীন আলম, নারায়ণগঞ্জের জেলা রেজিস্ট্রার খন্দকার জামিলুর রহমান, মানিকগঞ্জের জেলা রেজিস্ট্রার জাহিদ হোসেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা রেজিস্ট্রার সরকার লুৎফুল কবির, সাব-রেজিস্ট্রারদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ বন্দরের শেখ কাউছার আহমেদ, ফতুল্লার সাজ্জাদুর রহমান, কেরানীগঞ্জ দক্ষিণের ইমরুল খোরশেদ, বরিশাল চাখারের মকসু মিয়া, ঢাকার নবাবগঞ্জের আব্দুল বাতেন, উত্তরার লুৎফর রহমান ও সূত্রাপুরের নূরুজ্জামান পলাশ। জানতে চেয়ে সাব-রেজিস্ট্রার শাহীন আলমকে ফোন করা হলে তিনি ফোন কেটে দেন। পরে এই প্রতিবেদকের ফোন নম্বরটি ব্লক করে দেন। মুঠোফোনে খুদেবার্তা পাঠালেও সাড়া দেননি। পরে তার কর্মস্থলে মানবজমিন প্রতিনিধি পাঠিয়েও তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। ফোনে যোগাযোগের পর তিনি কর্মস্থলেও আসছেন না।