Image description

রাজধানীর বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের আর্ট গ্যালারিতে ফিরে এল ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায়। দ্যা বাংলাদেশ ন্যারেটিভ ও হিস্টোরিক্যাল ট্রান্সপারেন্সি সোসাইটির যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘মুজিববাদ মুর্দাবাদ; আওয়ামী দুঃশাসন ১৯৭২-৭৫’ শীর্ষক প্রদর্শনী যেন স্বাধীনতার পরের রক্তাক্ত সময়ের এক জীবন্ত দলিল উপস্থাপন করেছে।

 

৮ আগস্ট শুক্রবার বিকেল তিনটায় শুরু হওয়া এ প্রদর্শনী চলবে দুই দিনব্যাপী, শেষ হবে ৯ আগস্ট রাত আটটায়। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ, ব্যঙ্গচিত্র, আলোকচিত্র, প্রতিবাদী কার্টুন ও আর্কাইভের দলিল-দস্তাবেজের ৮০ টি ছবি এই প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে। প্রদর্শনিটিতে এছাড়াও অনলাইন আর্কাইভ থেকে প্রাপ্ত বিষয় বস্তু এবং ওই সময় অঙ্কিত প্রতিবাদী কার্টুন চিত্র স্থান পায়। প্রতিটি দলিলই সাক্ষ্য দিচ্ছে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, দমন-পীড়ন, দুর্ভিক্ষ, আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতির ও গণমাধ্যমের 'টুঁটি' চেপে ধরার ইতিহাস।

 

দর্শনার্থীদের চোখ আটকে যাচ্ছিল দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা ও টানানো সংবাদ শিরোনামগুলোতে। মুজিববাদীদের দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠার চিত্র ফুটে ওঠে ‘ভোলায় জাসদ নেতার লঞ্চে মুজিববাদীদের গুলিবর্ষণ ও মেজর জলিলকে হত্যার অপচেষ্টা’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদ প্রদর্শনীতে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে–‘এক বছরে ব্যাংক ডাকাতি ৩১টি, গুপ্তহত্যা ১,৪৬৭টি, ডাকাতি ২,০৩৯টি, ছিনতাই ১৭,৩৪১টি’ ও ‘সংসদ সদস্যের বাড়ি থেকে অস্ত্র ও মালামাল উদ্ধার’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ছবিতে।

 

শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার কিভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর উপর দমনপীড়ন ও তাদের হত্যা করেছে তা ফুটে উঠে ‘গোপালগঞ্জে মোজাফফর ন্যাপ প্রার্থীসহ বিরোধীদলীয় ৫ জন কর্মীকে পিটিয়ে হত্যা’, ‘মানিকগঞ্জের জাসদ নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা’, ‘মুন্সীগঞ্জে ৩ শতাধিক জাসদকর্মী গ্রেপ্তার’ ‘রক্ষীবাহিনী কর্তৃক খুলনার ন্যাপ নেতা প্রহৃত ও গ্রেপ্তার’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদের ছবিগুলোর মাধ্যমে।

 

শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলই নয়, রাজনৈতিক সচেতন সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও রক্ত ঝরায় মুজিববাদী সরকার। প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ জনতা রাজপথে নামলে তাদের উপরও হামলে পড়ে মুজিববাদী সরকার ও সন্ত্রাসীরা। তা ফুটে ওঠে ‘বিভিন্ন ছাত্রাবাসে মুজিববাদের হামলা : রাজধানীতে সন্ত্রাস; ছাত্রনেতা আম্বিয়া-মাহবুব গুরুতর আহত’, ‘শেখ মুজিবের আওয়ামীলীগ সরকারের ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন’ ও ‘ঢাকায় বিক্ষোভ জনতার সঙ্গে রক্ষীবাহিনী ও পুলিশের সংঘর্ষ’, ‘বায়তুল মোকাররমের পবিত্র অঙ্গনে রক্ষীবাহিনীর বর্বরতা মুসল্লিগণ প্রহৃত’ ও ‘বরিশালে রক্ষীবাহিনীর বর্বরতার চরম দৃষ্টান্ত’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদের ছবি সামগ্রীতে।

 

প্রদর্শনীটিতে উঠে আসে শ্রমজীবী হত-দরিদ্র মানুষের উপর নির্যাতন ও গুলিচালানোর ঘটনাও। ‘শ্রমিকদের ঈদ বোনাসের দাবিতে বিক্ষোভে পুলিশের গুলি’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদের ছবিটি একটি জলজ্যান্ত উদাহরণ।

 

‘অর্ধ লক্ষাধিক পাট শ্রমিকের আংশিক বেকার হওয়ার আশঙ্কা; ভারতের কাছে পাট বিক্রি করে বাংলাদেশ বিশ্ব বাজার হারাচ্ছে’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি থেকে বোঝা যায় ভারতীয় আধিপত্যবাদকে সর্বপ্রথম স্বাগত জানিয়েছিল শেখ মুজিবের মুজিববাদী সরকার। তখন ভারতের সুবিধা দেখতে গিয়ে নিজ দেশের মানুষের ও রাষ্ট্রের ক্ষতি করতেও দ্বিধা করেননি তিনি।

 

ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে মুজিববাদী সরকার গণতন্ত্রকে হত্যা করতে চেয়েছিল। প্রতিষ্ঠা করেছিল বাকশাল। প্রহসনের নির্বাচনে নিজ দলের বিজয় নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন তিনি। ‘১৮টি কেন্দ্রে জাসদ প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র দাখিল করতে পারেনি; হুমকি সন্ত্রাস অপহরণ’

 

‘নির্বাচনে জেতার পরের কেচ্ছা আওয়ামীলীগাররা কে কেমনভাবে পাশ করলো’, ‘চট্টগ্রাম জাসদ’র সাংবাদিক সম্মেলন; নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ শোষকদের চিনেছে’, ‘অবাধ ও নিরপেক্ষতার প্রহসন! ৭৩-এর নির্বাচন’, ‘ত্রিশালের জনসভায় শাজাহান সিরাজ; মুখে নিরপেক্ষ নির্বাচনের বুলি অথচ বিরোধীদলের ওপর ফ্যাসিবাদী হামলা চলছে’, ‘আওয়ামীলীগের সর্বোচ্চ নেতাদের নির্দেশেই মনোনয়নপত্র দাখিলে বাধা দেওয়া হয়েছে’,

 

দুর্নীতিতে এক লজ্জার উদাহরণ তৈরী করেছিল মুজিববাদী সরকার। ‘মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিববাদী সরকারের সংগৃহীত ৭৫ কোটি টাকার কোন হিসেব নেই’ শিরোনামে সংবাদের ছবিটি তা ফুটিয়ে তোলে। ‘গণকন্ঠে বারবার পুলিশী হামলা’র সংবাদটি গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরার একটি ছোট্ট উদাহরণ।

 

মুজিববাদী অপশাসনের সময়ের দুর্ভিক্ষের বেদনার দলিলও ছিল এই প্রদর্শনীতে। রংপুরে অন্তত ৫০ হাজার মানুষের মৃত্যু, শূন্য থালা হাতে তিস্তা জংশনের দুটি অবোধ শিশু -ছবির চোখদুটি থেকে ঝরে পড়া হতাশা যেন দর্শকের হৃদয় ভেদ করে যায়। পাশাপাশি ছিল ‘বাংলার শিশুদের বাঁচাও’ শিরোনামের আহ্বান, যা তখনকার জনজীবনের দারিদ্র্য ও অনাহারের গভীরতা তুলে ধরে। প্রদর্শিত সংবাদের কিছু শিরোনাম যেন আজও কানে বাজে,‘অইলে খাওন দেন, নইলে গুলি কইরা মারইন’।

 

প্রদর্শনীতে আগত শিক্ষার্থী সাদিক জাহান বলেন, স্বাধীনতার পরপরই দেশে যে অব্যবস্থা, দমন-পীড়ন ও রক্তপাতের মাধ্যমে স্বৈরাচার হয়ে উঠেছিল মুজিববাদী সরকার, তার নিখুঁত দলিল এই প্রদর্শনী। যা থেকে স্পষ্ট আওয়ামিলীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করলেও তারা মূলত জন্ম থেকেই স্বৈরাচার।

 

আয়োজক সংগঠন ‘দ্যা বাংলাদেশ ন্যারেটিভ’র সহযোগী প্রতিষ্ঠাতা জুবায়ের ইবনে কামাল জানান, 'স্বৈরাচারী সরকার ইতিহাসকে কুক্ষিগত করে রেখেছিল এবং ৭২-৭৫ সালের সময়টাকে আলোচনার ঊর্ধ্বে রেখে ইতিহাস পাঠ করতে বাধ্য করেছিল। আমরা ইতিহাসকে পুনর্পাঠ করার চেষ্টা করেছি এই এক্সিবিশনের মাধ্যমে’।