
শেখ হাসিনা এক বছর আগে পালিয়ে গেছে ভারতে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের এক বছর হয়েছে। এ সময়ে পদ্মা-মেঘনা-যমুনার পানি অনেক গড়িয়েছে। সব সেক্টরে কিছু না কিছু পরিবর্তন এসেছে। ‘মুজিব বন্দনা’ করে যারা দিন শুরু করেছিলেন তাদের আর ওই বন্দনা দেখা যায় না। কেউ কেউ জার্সি বদল করেছেন, কেউ গিরগিটির মতো রং পাল্টিয়েছেন। অনেকের চরিত্রের বদল ঘটেছে। কিন্তু গণমাধ্যম! এক বছরে গণমাধ্যমের চরিত্র কী বদলেছে? সাংবাদিকতার নামে হাসিনা বন্দনায় যারা প্রাণপাত করতেন তারা কী এখন মুখোশ পরেই সেটা চালিয়ে যাচ্ছেন? ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি গণমাধ্যম (মূলত আ. লীগের লিফলেট) দখল পাল্টা দখল নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় হৈচৈ দেখে প্রশ্নটা দেখা দিয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে নেপথ্যের রহস্য কী? ‘কয়লা ধুলে ময়লা যায় না/ ইজ্জত ধুলে খাসলত যায় না’ প্রবাদের ভূমিকায় গণমাধ্যমটির দেখা যাচ্ছে। জুলাই শুরুতে অভ্যুত্থানের সমর্থনে পহেলা জুলাই ‘লাল ফটোকার্ড’ ব্যবহার করে। অভ্যুত্থানের দিন ৫ আগস্ট আসার আগেই পহেলা আগস্ট সে ফটোকার্ডের লাল লং পাল্টিয়ে কালো করা হয়। জুলাইয়ের অভ্যুত্থানের শেষ হওয়ার আগেই মুজিবের শোকে শোকাহত পত্রিকাটি। ফ্যাসিস্ট হাসিনার লিফলেট হিসেবে পরিচিত গণমাধ্যমটি চরিত্র না পাল্টালেও মত প্রকাশের স্বাধীনতায় ‘শত ফুল ফুটতে দাও’ নিশ্চিত অপরিহার্য। সরকারের দায়িত্বশীলরা ওই গণমাধ্যমকে নিজের মতো করে চলতে দেয়ার নিশ্চিত করতে হবে। দখলদারিত্ব চেতনা তো শেখ হাসিনার পতনের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হওয়ার কথা। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সেটা হবে কেন? অবশ্য ওই পত্রিকায় কর্মরত সাংবাদিকরা দাবি করেছেন তারা কোনো দখলদারিত্ব করেননি।
গণমাধ্যমের ভূমিকা দেখে এবং সাংবাদিকদের দলবাজি নিয়ে সম্প্রতি রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান তার ইউটিউব চ্যানেলে বলেছেন, ‘যাদের টাকাপয়সা কম তারা নিরাপত্তার জন্য কুকুর পোষে- আর যাদের টাকা পয়সা বেশি তারা নিরাপত্তার জন্য গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা করেন’। হাসিনা রেজিমে ১৫ বছর গণভবনে সংবাদ সম্মেলনের নামে তোষামোদীর চিত্র দেশে সৎ সাংবাদিকতার চিত্রই পাল্টে দিয়েছে।
গত ৬ আগস্ট জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ড. আলী রীয়াজ দেশের গণমাধ্যমকর্মী তথা সাংবাদিকদের ‘আয়নায় নিজেদের চেহারা’ দেখার পরামর্শ দিয়েছেন। ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা : অভিযোগ ও স্ব-নিয়ন্ত্রণ অন্বেষণ বিষয়ক সংলাপ’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় আলী রীয়াজ বলেছেন, ‘আপনারা সাংবাদিক না রাজনীতির এটা আগে ঠিক করুন’। তিনি যেন দেশের দলবাজি সাংবাদিকতার মৌচাকে ঢিল ছুঁড়েছেন। ওই সেমিনারে হাসিনা রেজিমে ১৫ বছর গণভবনে তোষামোদী সম্মেলনে তৃতীয়-চতুর্থ সারিতে বসার জন্য ঘাম ঝরাতেন এমন কয়েকজন সাংবাদিককে দেখা গেল গণমাধ্যমের নিরপেক্ষতা নিয়ে জাতিকে ‘ছবক’ দিচ্ছেন। পলাতক হাসিনার মাফিয়াতন্ত্রের চতুর্থ শ্রেণীর অলিগার্ক ওই সাংবাদিকদের বচন কিছু গণমাধ্যমে বেশ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হয়। গত কয়েক বছরে দেশে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠায় বিপ্লব ঘটে গেছে। হাসিনা দলীয় বিবেচনায় শত শত ব্যক্তিকে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার লাইন্সেস দিয়েছেন। তারা সারাবছর সাংবাদিকতার নামে ‘হাসিনার স্তুতি’ ‘মুজিব বন্দনা’ করে আর্থিক ও ব্যবসায়িক সুযোগ সুবিধা নিয়ে বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছেন। তাদের কয়েকজন ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে শিক্ষার্থীদের উপর সরাসরি গুলি করার নির্দেশ দেয়ার জন্য শেখ হাসিনাকে পরামর্শ দিয়েছেন। তারা নানাভাবে দিল্লির এজেন্ডা বাস্তবায়নে সাংবাদিকতাকে কাজে লাগিয়েছেন। এদের কয়েকজন পালিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। তাদের নিয়েও মায়াকান্নার যেন শেষ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে হাজারো ছাত্রজনতার জীবনের বিনিময়ে জুলাই-২০২৪ অভ্যুত্থানে ওই গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকা কী ছিল? কয়টা গণমাধ্যম সত্যিকার অর্থে জনগণের ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘জনগণের মাধ্যম’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে? নাকি সাংবাদিকতার নামে হাসিনার মাফিয়াতন্ত্র কায়েমে ভ্যানগার্ড হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে?
হাসিনা পালানোর পর মাফিয়াতন্ত্রের আওয়ামী লীগ এখন দেশের রাজনীতিতে মৃত্যুবাঘ। অন্তর্বর্তী সরকার আগামী রমজানের আগে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে যখন প্রস্তুতি নিচ্ছে; তখন কেন ‘আওয়ামী লীগ আসছে’ জুজুর ভয় দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে? নির্বাচন পেছানোর লক্ষ্যে এবং আওয়ামী লীগকে আগামী সংসদে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি (পিআর) নির্বাচনের পক্ষে প্রচারণা চালানো হচ্ছে? আর এটা করতে গিয়ে ‘বাঘে-মহিষে এক ঘাটে পানি খাওয়া’ প্রবাদের মতো তথাকথিত প্রগতিশীল চেতনার ব্যক্তিরা ইসলামী ধারার দল জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের মতো রাজনৈতিক শক্তির দাবির পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে।
পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই রাষ্ট্রের প্রথম স্তম্ভ ‘জাতীয় সংসদ’; দ্বিতীয় স্তম্ভ ‘নির্বাহী বিভাগ (প্রশাসন বিভাগ); তৃতীয় স্তম্ভ ‘বিচার বিভাগ’। গণমাধ্যমকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। কিন্তু হাসিনা রেজিমে ১৫ বছর গণমাধ্যম ছিল রাষ্ট্রের ৬ নম্বর স্তম্ভ। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভের ভূমিকায় ছিল ‘দিল্লির সাউথ ব্লক’; আর পঞ্চম স্তম্ভ ছিল অলিগার্ক ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। গণমাধ্যমকে ব্যবহার করা হয়েছে বাড়ির কাজের ছেলের মতোই। কিন্তু গণমাধ্যমের বদৌলতে ‘সাংবাদিকতার’ নামে হয়েছে ‘সাংঘাতিকতা’। বেশির ভাগ তথাকথিত গণমাধ্যম মানুষের চাওয়া-পাওয়া-অধিকার-মানবাধিকার এসবের দিকে কখনোই গুরুত্ব দেয়নি। কেবল মাফিয়ানেত্রী হাসিনা কিসে খুশি হন, কিভাবে গণভবনের তোয়াজ সম্মেলনে আরো সামনের সারিতে বসা যায় তারই প্রতিযোগিতা। গণভবনে আয়োজিত প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে ১৫ বছর গণমাধ্যমে যারা রিপোর্ট লেখেন সেই রিপোর্টারদের সামনের চেয়ারে বসতে দেয়া হয়নি। সামনের সারি সম্পাদক, মালিক, সিনিয়র সাংবাদিক, সাংবাদিক নেতারা দখল করে হাসিনাকে শুধুই তোয়াজ করতেন। সাংবাদিকতার নামে ওই ‘তোষামোদ নীতি’ এমন পর্যায়ে হতো যে হাসিনা নিজেই বিরক্ত হয়ে বলতেন ‘এতো তেল দেবেন না’। ওই সময় তৃতীয় চতুর্থ সারিতে বসার সৌভাগ্যবান শেখ হাসিনাকে ‘আপনি বাংলাদেশের বাতিঘর, আমাদের আশা-ভরসার প্রতীক’; ‘আপনি না থাকলে দেশের কী হবে’; আপনি বিশ্বনেত্রী, আপনার বিশ্ব নেতারা আপনার দিকে তাকিয়ে’; ‘বিদেশ গেলে বোঝা যায় বিশ্ব নেতারা আপনাকে কিভাবে শ্রদ্ধা করেন’, ‘আপনার জন্ম হয়েছে বলে দেশে গণতন্ত্র এসেছে’ ইত্যাদি বলে হাসিনার কাছে নিজেদের ক্রীতদাস প্রমাণের চেষ্টা করেছে; ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা : অভিযোগ ও স্ব-নিয়ন্ত্রণ অন্বেষণ বিষয়ক সংলাপ’ শীর্ষক সেমিনারে তাদের কয়েকজনকে দেখা গেল গণমাধ্যমকর্মীদের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিতের ছবক দিচ্ছেন।
গণমাধ্যম এমন একটি মাধ্যম যাকে প্রতিদিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। প্রতিদিন প্রকাশিত কোন খবর কিভাবে লেখা হয়, কিভাবে কভারেজ দেয়া হয়, কিভাবে হাইট করা হয় তা দেখলেই বোঝা যায় ওই গণমাধ্যমের অবস্থান। ’৯০ পট-পরিবর্তনের আগে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের দেখা গেছে গণমাধ্যমগুলো ছাপা কাগজে আন্দোলনের সমর্থনে কয়েক ইঞ্চি ফাঁকা রাখছে। আন্দোলনের শেষ দিকে গণমাধ্যম প্রকাশনা বন্ধ পর্যন্ত করেছিল। অথচ ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে দেশের বেশির ভাগ গণমাধ্যমের ভূমিকা কী ছিল?
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টার দায়িত্ব পান নাহিদ ইসলাম। তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে পরিচিত হতে সম্পাদক, সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের আয়োজন করেন। ওই মত বিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন এমন একজন জানান, সেখানে যারা উচ্চকণ্ঠ ছিলেন তাদের বেশির ভাগই পতিত হাসিনার তাবেদারী করেছেন। নতুন সরকারের কাছ থেকে নানামুখী সুবিধা, ব্যবসা বাণিজ্যের নিশ্চয়তা, বিজ্ঞাপন বাগাতে রাতারাতি জার্সি বদল করেছেন। বর্তমানে সরকারের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন।
এরশাদের শাসনামলে কবি মুহাম্মদ রফিক খোলা কবিতায় লিখেছিলেন ‘সব শালা কবি হবে; পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে, উড়বেই; বন থেকে দাঁতাল শুয়োর রাজাসনে বসবেই’। বর্তমানে গণমাধ্যমের যা অবস্থা তাকে কবিতার ওই ‘কবি’ শব্দটি কেটে ‘সাংবাদিক’ শব্দটি সংযোজন করার সময় হয়ে গেছে। এখন খবর পড়ে, উপস্থাপনা করে, ইউটিউবে ভিডিও দেন, রেডিও জকি সবাই সাংবাদিক। আর যাদের প্রচুর টাকা রয়েছে তারা গণমাধ্যম মালিক। পেশা হিসেবে সাংবাদিকদের যত সংগঠন রয়েছে আর অন্য কোনো পেশায় এতো বিপুল সংখ্যক সংগঠন নেই। এদের একটি সংগঠন জনগণ্ঠের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করার পাশাপাশি ২০২৪ সালে ৪৯৬ সাংবাদিক হয়রানির শিকার এবং ২৪ জন গণমাধ্যম কর্মীকে অপসারণের কথা বিবৃতিতে উল্লেখ করেছেন। তাদের এই মায়াকান্না ন্যায় সংগত। তবে হাসিনা রেজিমে ১৫ বছর হাজার হাজার সাংবাদিক হয়নারীর ঘটনায় এদের হৃদয়ে নাড়া দেয়নি।
দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার সম্পাদকের বাসায় চারবার পুলিশ হানা দিয়েছে, ইনকিলাব পত্রিকা অফিসে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে পুলিশ সাংবাদিকদের গ্রেফতার করেছে। তখন এদের এতো উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায়নি। শুধু কী তাই, আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে কুষ্টিয়ায় আদালতে ছাত্রলীগ-যুবলীগ রক্তাক্ত করেছিল, ইত্তেফাক ও নিউ নেশনের সম্পাদক ম-লীর সভাপতি ব্যারিষ্টার মইনুল হোসেনকে রংপুর কোর্টে যুবলীগ রক্তাক্ত করেছে, পত্রিকা অফিসে সংগ্রামের সাবেক সম্পাদক আবুল আসাদকে যেভাবে যুবলীগ মারধোর করে চ্যাংদোলা করে পুলিশকে দিয়েছে। গণমাধ্যম জগতে চরম মানবাধিকার লংঘনের ওই ঘটনাগুলো ঘটার পরও আজকের বিবেকবানদের প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি। হাসিনা রেজিমে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ কিছু কিছু আইন করে গণমাধ্যমের কন্ঠ রোধের চেষ্টা হয়েছে। সংবাদকর্মীদের নানাভাবে হেনস্তা, হামলা, মামলা, কারাগার এবং বিজ্ঞাপনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন পতিত হাসিনা। কয়েকটি গণমাধ্যম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সে সময় আজকের গণমাধ্যমের স্টেকহোল্ডার সংগঠনগুলোর বিবেকে নাড়া দিলে এবং তারা প্রতিবাদী হয়ে উঠলে আওয়ামী লীগ শাসন হয়তো এতো ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে পারতো না।
হাসিনা পালানোর পর বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, দুর্র্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশনসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের মধ্যে পরিবর্তন এসেছে। ভারতের তাবেদারি, হিন্দুত্ববাদী বিজাতীয় সংস্কৃতি চর্চার স্রোত থেমে গেছে। এখন গণমাধ্যমে কী পরিবর্তন আসবে? সোশ্যাল মিডিয়ায় গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক চলছেই। প্রশ্ন হচ্ছে এ বিতর্কের অবসানের পথ খুঁজে বের করতে হবে গণমাধ্যমের স্টেক হোল্ডারদের। পাশাপাশি হাসিনা রেজিমে যে দখল-পাল্টা দখল এবং গণমাধ্যম সেক্টরকে গণবিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে সেখান থেকে উত্তরণের এখনই সময়।