
বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্য নিয়ে যখন আলোচনা হয়, তখন দূষণ কিংবা অপুষ্টির কথা শোনা যায় প্রায়ই। কিন্তু একটি ভয়াবহ ও নীরব হুমকির কথা আমাদের অনেকেরই অজানা-সিসা দূষণ। এটি এমন এক বিষাক্ত ভারী ধাতু, যা চোখে দেখা যায় না, গন্ধে ধরা পড়ে না, অথচ নিঃশব্দে ধ্বংস করে চলেছে লাখ লাখ মানুষের স্বাস্থ্য, বিশেষ করে শিশু ও গর্ভবতী নারীদের জীবনের সম্ভাবনা।
সিসা শিশুর মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশে মারাত্মক বাধা তৈরি করে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই সিসা আসে কোথা থেকে? এর উৎস কারা? সিসা দূষণের উৎস এতটাই বিস্তৃত ও ঘরের কাছাকাছি যে আমরা চাইলেও এড়িয়ে যেতে পারি না। রান্নার জন্য ব্যবহৃত কমদামি ও পুরনো পাত্র, প্রসাধনী, সিসাযুক্ত রং, ধূলিকণা, এমনকি ঘরের ভেতরের ধূমপান-সবই সিসার সম্ভাব্য উৎস। সবচেয়ে আশঙ্কার কথা হলো, সিসা-নির্ভর শিল্প-কারখানার এক কিলোমিটারের মধ্যে বসবাসকারী শিশুদের রক্তে সিসার মাত্রা আশপাশের তুলনায় ৪৩ শতাংশ বেশি। এই শিল্প-স্থাপনাগুলো শিশুদের শৈশব কেড়ে নিচ্ছে।
আমরা অনেক সময় ছোটখাটো জিনিসে খরচ বাঁচাতে গিয়ে নিজের অজান্তেই ভয়াবহ ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছি। রান্নাঘরের পাত্র, ব্যবহৃত তেলের বোতল, কিংবা বছর বছর ধরে ব্যবহার করা সেই পুরনো কুকার-এসবই হতে পারে বিষ ছড়ানোর উৎস। একটু ভালো জিনিস কেনা মানেই শুধু আরাম বা সৌন্দর্য নয়, এটি হতে পারে আপনার সন্তানের সুস্থ ভবিষ্যতের বিনিয়োগ।
ধূমপান একটি মারাত্মক অভ্যাস, আর তা যদি হয় ঘরের ভেতরে, তবে তা আরও বিপজ্জনক। ধূমপানের ধোঁয়ার মাধ্যমে সিসা শিশুর শরীরে প্রবেশ করতে পারে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৫০০ শিশুকে নিয়ে এক গবেষণায় দেখেছে, সিসার উপস্থিতি ইতোমধ্যেই আমাদের শিশুর রক্তে ভয়ানক মাত্রায় পৌঁছে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি বলছে, প্রতি লিটারে ৩৫ মাইক্রোগ্রামের বেশি সিসা শিশুর জন্য হুমকিস্বরূপ। অথচ ঢাকার বস্তি এলাকায় ২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে দুই বছরের কম বয়সী ৮৭ শতাংশ শিশুর রক্তে সিসার মাত্রা ছিল ৫০ মাইক্রোগ্রামের বেশি।
ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে সিসাদূষণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে চতুর্থ অবস্থানে। এখানে প্রায় তিন কোটি ৬০ লাখ শিশু সিসা দূষণের শিকার হয়ে বেড়ে উঠছে, যাদের ভবিষ্যৎ দিন দিন ক্ষয়ে যাচ্ছে।
সিসা থেকে আমাদের মুক্তি পেতে হলে কেবল প্রতিকার নয়, চাই প্রতিরোধ। সিসাযুক্ত ব্যাটারি রিসাইক্লিং কারখানা, সিসা গলানোর স্থাপনা কিংবা সিসাযুক্ত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। এই শিল্পগুলো দূষণ কমানোর প্রযুক্তি ব্যবহার করুক, কিংবা জনবসতি থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়া হোক। আমাদের শিশুদের রক্ষা করতে হলে, এই নীরব ঘাতককে থামাতেই হবে।
সিসা এমন এক শত্রু, যে সামনে নেই, তবে সর্বত্র। বাতাসে, ধুলায়, মাটিতে, খাবারে, এমনকি গর্ভের ভেতরেও। তাই এর বিরুদ্ধে যুদ্ধটা আমাদের ঘরের ভেতর থেকেই শুরু করতে হবে। রান্নাঘর, বাথরুম, শোবারঘর-সব জায়গায় সচেতনতা দরকার। শিশুরা যেন নিরাপদ পরিবেশে বড় হতে পারে, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
এই যুদ্ধটা কেবল সরকারের নয়, আমাদের সবার। কারণ, ভবিষ্যতের বাংলাদেশ আজকের শিশুদের হাতেই। আর সেই ভবিষ্যৎ যেন বিষে ভরে না যায়-সেজন্য আজই আমাদের জেগে উঠতে হবে।