
২০২৪ সালের জুলাই মাস। দেশের রাজপথ তখন উত্তাল কোটা সংস্কার আন্দোলনে। তরুণেরা স্লোগানে, সাহসে, আর স্বপ্নে জাগিয়ে তুলেছিল নতুন আশার প্রদীপ। সেই আগুনে পুড়ে গিয়েছিল কিছু তাজা প্রাণ। তাদেরই একজন ছিল গলাচিপার মো. সাগর গাজী—এইচএসসি পরীক্ষার্থী, মাত্র ২০ বছর বয়স, যার স্বপ্ন ছিল দেশ দেখার, সমাজ বদলানোর, নিজের জায়গা গড়ে তোলার।
সাগর ২০২৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পরীক্ষা স্থগিত হলে ঢাকায় গিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দেয়। সেদিন ৫ আগস্ট চলমান কোটা আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়েছে এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে ঢাকার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। এ সময় সাগরও বিজয় মিছিলে অংশ নিতে উত্তরার জসীম উদ্দিন ফ্লাইওভার এলাকায় অবস্থান নেয়। ক্ষিপ্ত জনতা র্যাব-১ দপ্তরে ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে। র্যাব, পুলিশও পাল্টা এলোপাথাড়ি গুলি ছোড়ে। ছত্রভঙ্গ জনতা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে থাকে। এসময় একটি গুলি সাগরের মাথায় এসে লাগে। মুহূর্তেই সাগর রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে। স্থানীয়রা সাগরকে পার্শ্ববর্তী ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নিয়ে গেলেও বাঁচানো যায়নি। সাগরের স্বজনরা তার মুঠোফোনে কল করলে স্থানীয়রা তার মৃত্যুর খবর জানায়। পরে সাগরের আত্মীয় ও স্বজনরা হাসপাতাল থেকে লাশ শনাক্ত করে। ওই দিন রাতেই সাগরের মৃতদেহ তার গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর গলাচিপার পূর্ব পাড় ডাকুয়া এলাকায় নিয়ে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
আজ ২০২৫ সালের আগস্ট মাস। সাগরের মৃত্যুর এক বছর হতে চলছে। তবুও গলাচিপার পূর্ব পাড় ডাকুয়া গ্রামের বাতাসে এখনো বাজে তার শেষ কথাগুলোর প্রতিধ্বনি। মৃত্যুর মাত্র কয়েক মিনিট আগে নিজের ফেসবুকে লিখেছিল— “আমি এই জেনারেশনের একজন হয়ে গর্ব বোধ করি। নিজের চোখে স্বাধীনতা দেখলাম।” তার কিছুক্ষণ পরেই ঢাকার উত্তরার জসিমউদ্দিন ফ্লাইওভার এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয় সে।
গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার আগের দিন ৪ আগস্ট সাগর গাজীর ফেসবুকের আরেকটি পোস্ট আজও অগণিত তরুণের চোখ ভিজিয়ে দেয়— ‘আজ যদি আমি মারা যাই বিজয়ের পর আমার কবরের পাশে পতাকা দিও। হয়তো লাশ হবো, নয়তো ইতিহাস হবো।’ শেষ পর্যন্ত সাগর লাশ হয়ে ফিরে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তাই তার ইচ্ছে অনুযায়ী কবরের পাশে পতাকা উত্তোলন করে দেয়া হয়। তার শেষ ইচ্ছা পূরণ করেছে পরিবার। সাগরের কবরের পাশে এখনো টানানো থাকে লাল-সবুজ পতাকা—একটি অসমাপ্ত জীবনের স্বপ্নের প্রতীক হিসেবে।
সাগরের মৃত্যুর পর, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ব্যক্তিগত ও সরকারিভাবে আর্থিক সহায়তা পেয়েছে পরিবারটি। আজও সাগরের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে স্মৃতিচারণ করে অসহায় মা, বাবা। প্রতিদিন কবরের দেখভাল করে সময় কাটিয়ে দেন বৃদ্ধ পিতা, মাতা। বিভিন্ন উৎসবে, খুশিতে ছেলেকে খুঁজে বেড়ান তারা। সাগরের ফিরে আসার প্রতিক্ষায় দূর থেকে কবরের দিকে তাকিয়ে থাকেন মা। এদিকে সাগরের মৃত্যুর পরে তার বাড়ির পাশের একটি সড়কের নাম শহীদ সাগর গাজী সড়ক নাম দিয়েছে স্থানীয় ছাত্রদল। সাগর শুয়ে আছে ডাকুয়া গ্রামের একটি সড়কের পাশে কবরস্থানে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ আসা যাওয়ার পথে সাগরের কবরের পাশে একটি জাতীয় পতাকা উড়তে দেখে আর তার স্মৃতিচারণ করে।
একজন স্বপ্নবাজ তরুণ: সাগরের গল্প
সাগরের জন্ম ২০০৪ সালে, পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার ডাকুয়া ইউনিয়নের পূর্ব পাড় ডাকুয়া গ্রামে। পিতা সিরাজুল ইসলাম গাজী পেশায় রাজমিস্ত্রি, মা সাহিদা বেগম গৃহিণী। তিন ভাইয়ের মধ্যে সাগর ছিল সবার ছোট। বড় ভাই সুজন গাজী একটি কোম্পানিতে চাকরি করেন। মেজো ভাই শাওন গাজী ঢাকার টঙ্গী সরকারি কলেজে ডিগ্রিতে লেখাপড়া করছেন। উলানিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাস করে ২০২৩ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয় সাগর। একটি বিষয়ে উত্তীর্ণ হতে না পারায় সে আবার প্রস্তুতি নেয়, পরে (২০২৪) এইচএসসি পরীক্ষায় সেই বিষয়ে অংশ নেয়। পরীক্ষার দুই মাস আগে ঢাকায় সিটি অনলাইন কোম্পানিতে চাকরি নেয় সে। পড়াশোনার পাশাপাশি ছাত্রদলের উলানিয়া কলেজ শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক ছিল সে—রাজনীতি নিয়ে উৎসাহী, দেশপ্রেমে আপ্লুত ছিল সাগর। স্বপ্ন ছিল এইচএসসি পাস করে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য ভর্তি হবেন। সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। তার মৃত্যুর পর ২০২৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলে জানা যায় সেই সাগর জিপিএ ৩.৯২ পেয়ে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। তবে সাগরের পরিবারের মুখে কারও হাসি ছিলো না। এইচএসসির ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর শোকের সাগরে ভাসে অসহায় পরিবারটি।
একটি পরিবার, একটি প্রশ্ন: সাগরের মৃত্যুর সাথে সাথে মাটিতে মিশে গেছে। সাগরের মা সাহিদা বেগম এখনো শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। কান্নার মধ্যে তিনি এখনো বলেন, “কষ্ট কইরা লেহাপড়া করাইছি, মানুষ করছি। আমার পুতকে মারছে ক্যান? দোষটা কী ছিল? আমার বাবারে ছাড়া ঘর ফাঁকা ফাঁকা লাগে। আমাকে আর মা বলে ডাকে না।" সাগরের মৃত্যুর পর তার পড়ার টেবিল, বই, পোশাক ও থাকার জায়গা আগের মতই পড়ে আছে। শুধু নাই সাগর। এসব স্মৃতি আগলে ধরে বেচে আছে বৃষ্টি পিতা, মাতা। পাশাপাশি সাগর হত্যার বিচার চান তারা।
বাবা সিরাজুল ইসলাম গাজীর চোখে শুধু অভিমান: আর চাপা কান্না, তিনি বলেন, “রাজমিস্ত্রি কাজ করে সংসার চালাই। ছেলেটা লেখাপড়ার পাশাপাশি কাজ করতো। আজ কবর দেখে মনে হয়, আমি কিছুই করতে পারিনি। আমার ছেলেটাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি। আমার ছেলে কইতো বড় হইয়া ইঞ্জিনিয়ার হইবে। আমগো ঘর উঠাইয়া দেবে। কিছুই হলো না। আমরা মামলা করেছি, সাগরের হত্যাকারীদের বিচার চাই।"
প্রতিবেশী জাকির হোসেন বলেন, "সাগর মেধাবী ছাত্র ও নম্র ভদ্র স্বভাবের ছিলো। এলাকায় তার সুনাম আছে। ছেলেটা এভাবে মারা গেছে আমরা মেনে নিতে পারি নাই। আসা যাওয়ার পথে প্রায়ই দেখি কবরের পাশে দাড়িয়ে তার বাবা, মা কাঁদছে। আমর চাই পরিবারটির পাশে সরকার থাকুক।"
আজ, এক বছর পরও সাগরের পরিবার বিচার চায়, ছেলের কবরের দিকে তাকিয়ে থাকে নিরব চোখে। তাদের প্রশ্ন—কে দায় নেবে এই হত্যার? এক তরুণ, যার হাতে কলম থাকার কথা, স্বপ্নের পথে এগিয়ে যাওয়ার কথা। তার মাথায় দেয়া হয়েছিল গুলি? কে জবাব দেবে সেই পোস্টের, যেখানে সে পতাকা চেয়েছিল, কিন্তু পেয়েছে নিঃশব্দ বিদায়? সাগরের কবরের পাশে দাঁড়ালে দেখা যায় একটি পুরোনো জাতীয় পতাকা বাতাসে উড়ছে। যেন এখনো বলে যাচ্ছে— “আমি গর্বিত ছিলাম আমার প্রজন্ম নিয়ে। কিন্তু, তার বিনিময়ে পেয়েছি নীরব মৃত্যু।” সাগরের গল্প হারিয়ে যাওয়ার নয়। এটি স্মরণ রাখার। মনে রাখার। যেন ভবিষ্যতে আর কোনো সাগর না হারায়। যেন প্রশ্নগুলোর উত্তর মেলে—একদিন।