
‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন পুলিশের বাপ-মা, তার নির্দেশ ছাড়া পুলিশ গুলি করতে পারে না। তার নির্দেশেই এমনভাবে গুলি করে হাজার হাজার মানুষকে পুলিশ আহত ও নিহত করেছে।’ শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রসিকিউশনের তৃতীয় সাক্ষী পুলিশের গুলিতে চোখ হারানো পারভীন নিজের জবানবন্দিতে এ কথাগুলো বলেন। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ গতকাল সাক্ষ্য দেন আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা ২৭ বছর বয়সি পারভীন।
এই দুই সাক্ষীর জবানবন্দি শেষে তাদের জেরা করেন পলাতক থাকা শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। পরে আগামীকাল ৬ আগস্ট এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য পরবর্তী দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল।
এদিন প্রসিকিউশনের পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, গাজী এম এইচ তামীম, বি এম সুলতান মাহমুদ, আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অন্তত চার মামলার বিচার কাজ শেষ করার লক্ষ্য নিয়েছে প্রসিকিউশন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয় থেকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে এসব মামলার সাক্ষীদের যেন যথাসময়ে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়, সে ব্যাপারে কার্যক্রম চলছে।
ইতিমধ্যে চারটি মামলার অভিযোগ আমলে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজন আসামির বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ এবং চানখাঁরপুলে ছয় হত্যা মামলার অভিযোগ আমলে নিয়ে অভিযোগ গঠন করেছেন ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে শেখ হাসিনার মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। বাকি দুই মামলা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের পর্যায়ে রয়েছে।
ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা এই চার মামলার মধ্যে একটিতে শেখ হাসিনা আসামি।
গুলিতে চোখ হারানো পারভীন জবানবন্দিতে যা বললেন : বর্তমানে বরিশালের বাসিন্দা পারভীন ঘটনার সময় থাকতেন রাজধানীর কুতুবখালী। কাজ করতেন দিনমজুর হিসেবে। ১৮ জুলাই বিকালে নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জবানবন্দিতে পারভীন বলেন, ‘কাজ থেকে পায়ে হেঁটে বাসা যাচ্ছিলাম। আমি যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত আসার পর দেখতে পাই রাস্তার ওপর অনেক মানুষ পড়ে আছে, কারো হাত নাই, কারো পা নাই। ফ্লাইওভারের নিচে দেখি একটি ছেলে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছিল। ছেলেটার সারা শরীর রক্তাক্ত। তার দুই চোখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। দেখে আমার মায়া হয়, আমি দৌড়ে গিয়ে দেখি ছেলেটির বয়স ১৮-১৯ হবে। আমি তাকে টেনে তুলে রিকশা খুঁজছিলাম।’
তিনি বলেন, ‘এমন সময় ১৪-১৫ জন সশস্ত্র মারমুখী পুলিশ ছেলেটিকে লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকে। এমনভাবে গুলি করছিল যেন খই ফুটছিল। গুলিগুলো ছেলেটির পিঠে লাগে। আমি বাম হাত তুলে গুলি না করার অনুরোধ করলে একজন পুলিশ আমার বাম চোখে গুলি করে। আরো দুই তিনজন পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি করার ফলে আমার তলপেটসহ কয়েক জায়গায় গুলি লাগে। এ সময় আমার চোখ দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। আমি ব্যথায় কাতরাচ্ছিলাম। আমি রাস্তায় পড়ে যাই। এ সময় ছেলেটি আমাকে এমনভাবে চেপে ধরে এবং জোরে নিঃশ্বাস নেয়, মনে হলো ছেলেটি তখন মারা যায়। তারপর ছেলেটি আমাকে ছেড়ে দেয়।’
নো রিলিজ, নো ট্রিটমেন্ট নির্দেশ দিতে শুনতে পাই : গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সাক্ষ্য গ্রহণের শুরুতে জবানবন্দি দেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ২৫ বছর বয়সি আবদুল্লাহ আল ইমরান। জবানবন্দিতে তিনি জানান, গত বছরের ১৯ জুলাই রাজধানীর বিজয়নগর পানির ট্যাংক এলাকায় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। তার বাঁ হাঁটুর নিচে গুলি লাগে।
আবদুল্লাহ আল ইমরান বলেন, ‘পঙ্গু হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছিল। গত বছরের ২৬ অথবা ২৭ জুলাই সকাল ৯টা-১০টার দিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই হাসপাতাল পরিদর্শনে যান। একপর্যায়ে শেখ হাসিনা তাঁর কাছে যান। শেখ হাসিনাকে তিনি ‘ম্যাডাম’ বলে সম্বোধন করেন। শেখ হাসিনা তাঁকে ‘আপা’ বলে ডাকতে বলেন।’
আবদুল্লাহ আল ইমরান আরো বলেন, ‘তিনি কোথায় পড়াশোনা করেন, হলে থাকেন কি না, কেন থাকেন না, সে সম্পর্কে শেখ হাসিনা জানতে চান। তিনি বলেন, ‘একপর্যায়ে শেখ হাসিনা বুঝতে পারেন, আমি আন্দোলনকারী। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, পুলিশ তোমাকে গুলি করেছে? আমি বলি, পুলিশ আমাকে সরাসরি গুলি করে। পুলিশের পোশাকে কারা ছিল, সেটা আমি জানি না। আমার পর আরো চার থেকে পাঁচজনের সঙ্গে তিনি কথা বলেন। পরে শেখ হাসিনা যখন চলে যাচ্ছিলেন, তখন হেল্পডেস্কের কাছে গিয়ে ‘নো রিলিজ, নো ট্রিটমেন্ট’ অর্ডার দিয়ে যান, যা আমি শুনতে পাই।’ তবে ‘নো রিলিজ নো ট্রিটমেন্ট’ মানে কী, তখন বুঝতে পারেননি বলেও জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন আবদুল্লাহ আল ইমরান। তিনি বলেন, ‘একপর্যায়ে তিনি দেখেন, যথাসময়ে তার অস্ত্রোপচার হচ্ছে না। বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে পারছেন না। তার বাবা হাসপাতাল থেকে নিয়ে যেতে চাইলেও নিতে পারছিলেন না। তখন তিনি বুঝতে পারেন ‘নো রিলিজ নো ট্রিটমেন্ট’-এর মানে। তার পা কেটে তাকে কারাগারে নিতে চেয়েছিল।’ এ ঘটনার জন্য শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে দায়ী করেন আবদুল্লাহ আল ইমরান।’
সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন।