Image description

ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ডিআইইউ) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী তারেক শাহরিয়ার তন্ময়। গণঅভ্যুত্থানের সময় ১৮ জুলাই ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে অন্ধকারতম দিন। একটি মিছিলে অংশ নিতে গিয়ে বাম চোখ হারান তিনি। আন্দোলনের উত্তাপ, পুলিশের গুলি, রক্ত, হাসপাতালের অপমান, পরিবারের কান্না- সব মিলিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মতো।

তন্ময় বলেন, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ হওয়ার পর ১৬ জুলাই যখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মাঠে নামে, আমিও অংশ নিই। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অবস্থান করি নতুন বাজার, ভাটারা থানার সামনে। ১৭ তারিখে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির আন্দোলনে একটা ব্রেক ছিল, কিন্তু ১৮ জুলাই সকালেই আবার আন্দোলন শুরু হয়।’

‘বন্ধুর ফোনে আন্দোলনের খবর পেয়ে রেডি হয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যাই। বের হওয়ার আগে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দেখি, আওয়ামী লীগের কিছু লোকজন বস্তা থেকে অস্ত্র আর ছুরি বের করছে। তখনই ভয় পেয়ে যাই। আইডি কার্ড গলায় না ঝুলিয়ে পকেটে রাখি, যেন কেউ বুঝতে না পারে যে, আমি আন্দোলনে যাচ্ছি। বাসার নিচে বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সে এলে আমরা নতুন বাজারের দিকে যাই। রাস্তাঘাট ফাঁকা, গাড়িঘোড়া চলছে না, পরিবেশ থমথমে। হঠাৎ দেখি, দুই দিক থেকে বড় একটা মিছিল আসছে আমরাও তাতে যোগ দিই।’

বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দেখি, আওয়ামী লীগের কিছু লোকজন বস্তা থেকে অস্ত্র আর ছুরি বের করছে। তখনই ভয় পেয়ে যাই। আইডি কার্ড গলায় না ঝুলিয়ে পকেটে রাখি, যেন কেউ বুঝতে না পারে যে, আমি আন্দোলনে যাচ্ছি। বাসার নিচে বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সে এলে আমরা নতুন বাজারের দিকে যাই। রাস্তাঘাট ফাঁকা, গাড়িঘোড়া চলছে না, পরিবেশ থমথমে। হঠাৎ দেখি, দুই দিক থেকে বড় একটা মিছিল আসছে আমরাও তাতে যোগ দিই।’

মিছিল যখন বাসতলা দিয়ে উত্তর বাড্ডার দিকে আগাচ্ছিলো, তখনই ঘটে ভয়াবহ ঘটনা। ‘বাসতলা পেরোতেই ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা মিছিলে হামলা করে। ককটেল ছোঁড়া হচ্ছিল, সাউন্ড গ্রেনেড ছোঁড়া হচ্ছিল। আমরা সংখ্যায় অনেক ছিলাম, তাই তারা আমাদের সামনে টিকতে পারেনি। মিছিল এগোতে থাকে। ফুটওভার ব্রিজের ওপরে দেখি পুলিশ, এপিবিএন দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎই টিয়ার শেল ছোঁড়া শুরু হয়।’

তিনি বলেন, ‘আমরা কখনো আগাচ্ছি, আবার কখনো পেছাচ্ছি। পুলিশও কখনো সামনে আসছে, কখনো পিছে যাচ্ছে। একপর্যায়ে পুলিশ গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। তখন আমি মাঝখান থেকে সামনে চলে এসে চিৎকার করে বলি—কেউ পিছে যাবা না। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই শর্টগানের গুলি এসে লাগে আমার বাম চোখে।’

আমি তখনও বুঝতে পারিনি গুলি লেগেছে। ঢিল বা অন্য কিছু মনে হয়েছিল। কিন্তু যখন চোখে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করলাম, মুখে হাত দিয়ে দেখি রক্ত। মোবাইল বের করে ক্যামেরায় নিজের মুখ দেখেই ঘাবড়ে যাই। মুখজুড়ে রক্ত, চোখ ঝাপসা। ডান চোখ ঢেকে দেখি—বাম চোখে আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।

তন্ময়ের বন্ধু তখন তাকে দ্রুত নিয়ে যায় এএমজেড হাসপাতালে। সেখান থেকে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়। হাসপাতালের ভেতরেই একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল আমার চোখের, তখনই বুঝলাম অবস্থা কতটা খারাপ। ডাক্তাররা বলল, চোখের অবস্থা এতই খারাপ যে তারা কিছুই করতে পারছে না। পরে একটা ব্যান্ডেজ দিয়ে পাঠানো হয় চক্ষু ইনস্টিটিউটে।

চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে নেওয়ার পরই শুরু হয় অপারেশন। কিন্তু অপারেশনের আগে এক অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হন তন্ময়। একজন ডাক্তার এসে বলেন ‘নেতা হইছোস? নেতা হইতে গেছোস? দাঁড়া, তোদের ব্যবস্থা নিচ্ছি। সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করো?’ আমি কিছুই বলিনি। তখন আমি অপারেশন টেবিলে, খুব দুর্বল।

অপারেশন শেষে তাঁকে এক বেডে আরেকজন রোগীর সঙ্গে শুইয়ে রাখা হয় জায়গা সংকটের কারণে। হাসপাতালের বাইরে ছাত্রলীগের হামলার চেষ্টা হলেও তারা ভেতরে ঢুকতে পারেনি, গেট লক করে দিয়েছিলো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পরে আমাদের ভার্সিটির রেজিস্ট্রার, কিছু শিক্ষক আসেন। তাঁরা সেদিন অনেক সাপোর্ট করেন, সব খরচও ভার্সিটি থেকে বহন করা হয়।

সেদিনই নিরাপত্তার কারণে হাসপাতালে না রেখে মগবাজারে এক আত্মীয়ের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ি রংপুর। মা-বাবা খবর পেয়ে সে রাতেই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সকালে এসে আমাকে দেখে ভেঙে পড়েন। পরদিন আবার চোখ চেকআপ করাতে যাই। তখন ডাক্তার বলেন, চোখ ফেরানো সম্ভব হবে না। তবে আরেকটা অপারেশন করতে হবে কিছুদিন পর।’

তন্ময়ের চিকিৎসায় সঙ্গী হন ভার্সিটির একজন বড় ভাই, ‘আকাশ ভাই’, যিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাশে ছিলেন। রাত্রিযাপন, হাসপাতালে রাখা, আত্মীয়ের বাসায় তাকে রেখে আসা, সবকিছুতেই সহায়তা করেন। এরপর কারফিউ শুরু হলো । বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ। তিনি বলেন, ‘একবার আমার মামা কারফিউ ভেঙে ওষুধ আনতে গিয়ে পুলিশের মার খেতে বসেছিলেন,পরে বাসায় ফিরে আসেন।’

পরবর্তীতে পাসপোর্ট ও ভিসার প্রক্রিয়া শুরু হয় বিদেশে চিকিৎসার জন্য। পাসপোর্ট পেলেও তখন ভারতীয় ভিসা বন্ধ ছিল। আগস্টের ৫ তারিখে শেখ হাসিনার পতনের পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়। এরপর উত্তরা, ঝিগাতলা, ধানমন্ডিসহ বিভিন্ন চক্ষু হাসপাতালে ঘুরে চিকিৎসা নেন তিনি।

‘ভার্সিটির শিক্ষকরা বললেন, অপারেশনের খরচ ওনারাই বহন করবেন। পরে ভিসাও হয়, ভার্সিটির বিওটি থেকে ২ লাখ টাকা পাই চিকিৎসার জন্য। কিন্তু ভারতে যাওয়া সম্ভব হয়নি। যেসব চিকিৎসক ভারত থেকে আসেন, তারা বলেন- এখন আর ভারতের গিয়ে লাভ নেই। উন্নত দেশে গেলে হয়তো কিছুটা করা যেত। কিন্তু আর্থিকভাবে সেটা সম্ভব হয়নি’, যোগ করেন তিনি।

তন্ময় পরে জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে ১ লাখ টাকা সহায়তা পান। কিন্তু চোখ আর ফেরেনি। তিনি বলেন, ‘আমি এখনো বাম চোখে কিছুই দেখতে পাই না। ১৮ জুলাই শুধু আমার চোখে গুলি লাগেনি, সেদিন আমার ভবিষ্যৎ, স্বপ্ন সবকিছুতে গুলি লেগেছিল। একটা অন্ধকার আমার ভিতরে ঢুকে গেছে, যেটা আজও পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারিনি।’ তাঁর ভাষ্য, ‘আমি শুধু একটা চোখ হারাইনি, হারিয়েছি জীবনের ছন্দও’।