
১৯ জুলাই ২০২৪। দুপুর আনুমানিক দেড়টা। মানুষের ভিড় ঠেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের মূল ফটকের সামনে দাঁড়াতেই যে দৃশ্য চোখে পড়ল, তাতে শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। এসব কী দেখছি! লাশের ওপরে লাশ। রক্তে ভেজা লাশগুলো পড়ে আছে স্তূপাকারে। কয়েকটি লাশে প্যাঁচানো রয়েছে আইডি কার্ড। চরম অযত্ন-অবহেলায় মর্গের মেঝেতে ফেলে রাখা হয়েছে। অনেকে সেখানে ওয়ারিশ বা স্বজন দাবি করে লাশ নিয়ে যেতে চাইলেও যথাযথভাবে শনাক্ত না করে কাউকেই বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছিল না। কিছু সময় দাঁড়াতেই মর্গে লাশের সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে স্বজনদের খোঁজে আসা পাগলপ্রায় মানুষের ভিড়।
একজন সাংবাদিক হিসেবে গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ঘিরে রাজধানীর বিভীষিকাময় নানা ঘটনার সংবাদ সংগ্রহ করতে হয়েছিল। এসব সংবাদ সংগ্রহে গিয়ে যেসব করুণ ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল, তা এখনো মনে হলে দুচোখ ভিজে আসে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল- সাংবাদিক হাসান মেহেদীর মৃত্যু।
১৯ জুলাই দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) মর্গের সামনে যেতেই চোখে পড়ে একটি অ্যাম্বুলেন্স ঘিরে মানুষের জটলা। সেখানে ফুপিয়ে কাঁদছিলেন এক নারী। কোলে তার দুই শিশু সন্তান। জানা গেল- তারা নিহত সাংবাদিক হাসান মেহেদীর স্ত্রী-সন্তান। মেহেদি সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে ১৮ জুলাই বিকালে যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন। লাশের গোসল শেষ করা হয়েছে। অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হবে। যাবে মেহেদির গ্রামের বাড়ি কেরানীগঞ্জে। মর্গের সামনে বন্ধু-সহকর্মীরা মেহেদির স্ত্রী-সন্তানের মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। শিশুসন্তান দুটির দুচোখ বেয়েও ঝরছিল অশ্রু।
১৯ জুলাই মধ্যরাত থেকে দেশব্যাপী কারফিউ জারি করে সরকার। এরপর ২০ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত ছিল আরও ভয়াবহ অবস্থা। সারা দেশে ছড়িয়ে পরা আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। সহিংসতায় হতাহতের বড় অংশই আসে ঢামেকে। ১৯ জুলাই সর্বশেষ ৯৮ জন মারা গেছেন বলে জানিয়েছিল ঢামেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে নিহতের সংখ্যা আরও বেশি ছিল বলে বিভিন্ন সূত্রে তখন আলোচনা হয়।
১৮ ও ১৯ জুলাই হাসিনা সরকারের পতনের আন্দোলনে উত্তাল ছিল রাজধানীর যাত্রাবাড়ী। যাত্রাবাড়ী থেকে সবচেয়ে বেশি হতাহত আনা হয় ঢামেক হাসপাতালে। ২০ জুলাইও সংবাদ সংগ্রহের জন্য যাই ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। সেদিনও আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ অনেককে রিকশায় করে আনা হয় হাসপাতালে। জরুরি বিভাগের সামনে সংবাদ কর্মীদেরও দাঁড়াতে দিচ্ছিল না পুলিশ। গুলিবিদ্ধ অনেককে মেঝেতে ফেলে রাখা হয়। কারও হাত-পা নড়ছিল, কেউ আবার যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন। অথচ, একজন আহত ব্যক্তিকেও সেভাবে আন্তরিকতার সঙ্গে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার চিত্র চোখে পড়েনি। যথাযথ চিকিৎসা না পাওয়ায় অনেককে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখা যায়। এমনকি তাদের নাম রেজিস্ট্রি খাতায় তোলা হয়নি। এর ফলে নিহত ও আহদের সঠিক সংখ্যাও ঠিকমতো পাওয়া যায়নি।
জরুরি বিভাগের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় আহত কাউকে আনা হলেই গননা করে রাখতাম। কারণ মর্গে গিয়েও লাশের সঠিক হিসাব পাওয়া যেত না। চারদিক থেকে এত লাশ, এত আহত ব্যক্তিকে আনা হতো যে সবমিলিয়ে এক ধরনের দিশেহারা অবস্থা।
ঢামেক মর্গে দীর্ঘদিন কাজ করা এক ডোম ওই দিন জানিয়েছিলেন, মর্গে বেওয়ারিশ লাশের স্তূপ হয়ে গেছে। কর্তৃপক্ষ আমাদের বলেছিল, সংবাদ কর্মীরা এলেও যেন সংখ্যা বা হিসাব না দিই। এ ছাড়া সে সময়ে ‘লাশের কারবারও’ হয়েছে বলে জানিয়েছেন একাধিক ডোম।