Image description

বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বুকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সকাল থেকেই এক অস্বাভাবিক নীরবতা চেপে বসেছিল। চারপাশে থমথমে এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। সড়কে টহল সেনাবাহিনীর, মোড়ে মোড়ে পুলিশ, এলিট ফোর্স র‌্যাবের স্নাইপার ভ্যান আর বিজিবির হুইসেলের উৎকট শব্দ। সাধারণ মানুষ নিজের ঘরের চার দেয়ালের মধ্যেই বন্দি ছিলেন।

সকাল ৯টা পর্যন্ত শহরের অধিকাংশ রাস্তাঘাট ছিল ফাঁকা। দোকানপাট বন্ধ, গণপরিবহন উধাও।

ঠিক বেলা ১টা ৪০ মিনিট। চট্টগ্রামের কাজির দেউড়ি মোড়ে হঠাৎ কিছু তরুণ-তরুণী ছুটে আসে জাতীয় পতাকা হাতে। তারা ‘পালাইছে, পালাইছে! শেখ হাসিনা পালাইছে!’ স্লোগানে উল্লাসে ফেটে পড়ে।

তাদের উল্লাসের স্লোগানে ওই এলাকার মানুষ প্রথমে একটু অবাকই হলেন! তারপর যখন নিশ্চিত হওয়া গেল যে, হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন তখন ওই এলাকাসহ চট্টগ্রাম শহরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে এই স্লোগান। এ সময় অনেকেই রাস্তায় সিজদায় লুটিয়ে পড়েন আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের জন্য, কেউ কেউ কোলাকুলি করেন সহযোদ্ধাদের সঙ্গে—যেন ঈদের উৎসব চলছে।

সেদিন এই প্রতিবেদক বন্দরনগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে অন্তত ১০ জন নারী-পুরুষের সঙ্গে কথা বলেন। বাকলিয়ার রিকশাচালক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ভাই, কত মার খাইছি, গালি খাইছি পুলিশের। আজ মনটা হালকা লাগতেছে। মনে হচ্ছে, সত্যি স্বাধীন হইলাম।’

খুলশীর মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিন বলেন, ‘স্বাধীনতার নামে দেশটারে বন্দি বানাইছিল যে মাইয়া, তার পতন দেখে মরলেও আফসোস নাই।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, আমরা ক্যাম্পাস থেকে বের হয়েছি খুব ভোরে। দুপুরের পরপর যখন শহরে পৌঁছে খবর পেলাম শেখ হাসিনা দেশ ছেড়েছে, মনে হচ্ছিল গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেছে। আমাদের প্রথম প্রতিক্রিয়াটা ছিল একটা চিৎকার, যা শুধু প্রতিবাদ নয়, তা ছিল মুক্তির উল্লাস। আমি নিজে দাঁড়িয়ে বলেছি, ভাইরা, আজকের দিনটা আমরা বইয়ের পাতায় রাখব না, বুকের ভেতর রাখব।

৫ আগস্টের সেই দুপুর শুধু একটি সরকারের পতন নয়, একটি নিঃশ্বাস আটকে থাকা জাতির মুক্তির শ্বাস ফিরে পাওয়ার মুহূর্ত। একটি অধ্যায়ের অবসান, আরেকটি ইতিহাসের সূচনা। চট্টগ্রামের রাস্তায় লেখা সেই ইতিহাস এখনো উজ্জ্বল কাজির দেউড়ির দেয়ালে, মানুষের চোখে, অশ্রুজলে।

নগর ছাত্রদলের আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম বললেন, সকালে প্রতিদিনের মতো আন্দোলনের জন্য বের হই। আমরা জানতাম, পরিস্থিতি জটিল। সরকারের শেষ সময় চলছে। দেশজুড়ে গুঞ্জন হাসিনা পালাতে পারেন। কিন্তু নিশ্চিত কিছু জানতাম না। ঠিক দুপুর ১টার একটু পর আমরা খবর পাই হাসিনা দেশ ছাড়ছেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে পুরো দুই নম্বর গেট মোড় উত্তাল হয়ে ওঠে। আমি নিজেই চিৎকার করে বলি, পালাইছে! হাসিনা পালাইছে! পাশে থাকা এক তরুণ কাঁদতে কাঁদতে আমাকে জড়িয়ে ধরল। এই একটা দৃশ্যÑএই কান্না, এই হাসি, এই মুহূর্ত, আমি সারা জীবন ভুলব না।

চট্টগ্রাম মহানগর উত্তরের শিবিরের সভাপতি তানজীর হোসেন জুয়েল বলেন, সেদিন আমরা ঘর থেকে বের হয়েছি শহীদ হওয়ার বাসনা নিয়ে। ভয়, আটক, গুলি কিছুই থামাতে পারত না আমাদের। সকাল থেকেই সব জনশক্তি নিয়ে সড়কে অবস্থান নিই। কেউ উত্তর পাহাড়তলী, কেউ অলংকার মোড়, কেউ কাজির দেউড়ি আলাদা আলাদা দলে ভাগ হয়ে আমরা শহরের গুরুত্বপূর্ণ সব পয়েন্টে দাঁড়িয়ে ছিলাম। প্রতিটি মুহূর্তে প্রস্তুত ছিলাম চূড়ান্ত ঘোষণা পাওয়ার জন্য। দুপুর ১টার পর যখন খবর আসে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়েছেন, আমরা কারো মুখের দিকে তাকানোর সুযোগ পাইনি। সবাই চিৎকার করে কাঁদছিল, কেউ হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছিল, কেউ ছুটে গিয়েছিল পতাকা আনতে।

তানজীর আরো বলেন, ‘আমার মনে আছে, আমি বলছিলাম, ভাইরা, আমরা পিছিয়ে যাইনি, আমরাই ছিলাম ইতিহাসের ঠিক মুখোমুখি। আজ যারা বলবে, এ তো শুধু একজন শাসকের দেশত্যাগ, তারা জানে না আমাদের বুকের ভেতর কত কষ্ট নিয়ে আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম। এই আনন্দ, এই স্বাধীনতার আলো আমরা কাঁধে করে বয়ে এনেছি।’