
বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অভিপ্রায় নিয়ে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের। জনগণের আকাঙ্ক্ষা ছিল একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। যেখানে থাকবে না বৈষম্য, রাজনৈতিক নিপীড়ন বা বাকস্বাধীনতার সংকোচন। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বয়স ৫৪ বছর। এর মধ্যে ৫০ বছরের ব্যবধানে দুটি আগস্টে ঘটে গেছে রাজনৈতিক মোড় পরিবর্তনের ঘটনা। প্রথমটি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, দ্বিতীয়টি ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে। দুটি সময়েই পরিবর্তনের কেন্দ্রে ছিল একতরফা, কর্তৃত্বপরায়ণ ও ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা।
১৯৭২ সালের সংবিধানে ঘোষিত চার মূলনীতি ছিল—গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। স্বাধীনতার বছর না পেরোতেই যেন বিচ্যুতি শুরু হয়। ভিন্নমত ও বিরোধী রাজনীতির ওপর দমন-পীড়ন বাড়ে। রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় যে গণতান্ত্রিক ভারসাম্য থাকার কথা ছিল, তা ভেঙে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের অন্তর্নিহিত প্রতিশ্রুতি ক্ষীণ হয়ে আসে। ফলে রাষ্ট্রের ভেতরে জমতে থাকে অসন্তোষ। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল গঠন করে সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রুদ্ধ করে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চালু করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবার নিহত হন তিনি। পতন ঘটে শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলের। খন্দকার মোশতাক আহমেদ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যদিও সে বন্দোবস্ত বেশিদিন টেকসই হয়নি। ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আবির্ভূত হন জিয়াউর রহমান (বীর উত্তম), যিনি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং একই সঙ্গে রণাঙ্গনে সম্মুখসারির যোদ্ধা ছিলেন।
প্রায় পাঁচ দশক পর, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে। ২০০৮ সালের পর টানা তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন, রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন, রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি ও অর্থ পাচার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় কঠোর নিয়ন্ত্রণের প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলন রূপ নেয় গণ-অভ্যুত্থানে। শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনের অবসান ঘটে। গঠিত হয় একটি অন্তর্বর্তী সরকার। এ দুটি ঘটনায় রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব বদলের মাধ্যমে দেশের প্রশাসনিক কাঠামো, কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং অর্থনৈতিক ও অভ্যন্তরীণ গতিপথে পরিবর্তন আসে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। তিনি ছিলেন শেখ মুজিবের মন্ত্রিসভার বাণিজ্যমন্ত্রী। ২০ আগস্ট মোশতাক সামরিক আইন জারি করে নিজেই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন। সংসদীয় ব্যবস্থার পরিবর্তে প্রেসিডেন্সিয়াল ধাঁচের একনায়কতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে ওঠে। প্রধানমন্ত্রীর পদ বিলুপ্ত করে সামরিক ছত্রছায়ায় ১২ জন মন্ত্রী ও ১১ জন প্রতিমন্ত্রীর সমন্বয়ে গঠিত হয় নতুন মন্ত্রিসভা। যার ২২ জনই ছিলেন পূর্বতন বাকশাল সরকারের সদস্য।
শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পরপরই ভারতে বিভিন্ন গুজব উঠতে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে। ১৯ আগস্ট কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির মন্তব্য উদ্ধৃত করে বলা হয়, ‘উপমহাদেশে সিআইএ ও চীন কতটা সক্রিয়, তা প্রমাণ হলো।’ অল ইন্ডিয়া পিস অ্যান্ড সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের প্রতিবাদ সভায় সিপিআই নেতা ভূপেশ গুপ্তা সরাসরি সিআইএর সম্পৃক্ততার অভিযোগ তোলেন। এ অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের নয়াদিল্লি দূতাবাস চরম ক্ষোভ প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্রের মতে, ভারতের প্রভাবশালী মহল থেকে এ ধরনের ‘মিথ্যা ও দায়িত্বজ্ঞানহীন’ অভিযোগ পরিস্থিতিকে আরো ঘোলাটে করছে।
শেখ মুজিবের সরকারের পতনের পর দেশের বাজারে আকস্মিক পরিবর্তন দেখা দেয়। ১৯৭৫ সালের ২৮ আগস্ট তৎকালীন জাতীয় সংবাদপত্র দৈনিক বাংলার খবরে বলা হয়, দেশের সর্বত্র চালের দাম কমেছে। এতে সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে এসেছে স্বস্তির ভাব। চালের দাম কমার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামও কমতে শুরু করে। দাম কমে খাদ্যশস্য, কাপড়-চোপড়, শিশুখাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের। এ সময় অসাধু ব্যবসায়ীরা একেবারে আড়ালে চলে যান। ওই বছর দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৬৭ দশমিক ১৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতি রেখে শেখ মুজিব নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে পরের বছর তা কমে দাঁড়ায় ঋণাত্মক ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশে।
ক্ষমতা দখলের পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ সরকার ১৯৭১-৭৫ সময়কালের দুর্নীতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রকাশ করে। এতে সরকারি উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের দুর্নীতি, পরিকল্পনাহীনতা এবং আর্থসামাজিক অনিয়মের বিস্তার তুলে ধরা হয়। শ্বেতপত্রে দাবি করা হয়, শেখ মুজিবের শাসনামলে উন্নয়ন পরিকল্পনায় বরাদ্দ করা অর্থের প্রায় ৫০ শতাংশ ব্যয় সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত সুফল মেলেনি। মূলত এ শ্বেতপত্রের মাধ্যমে মোশতাক সরকার আগের শাসনের অবক্ষয় ও অনিয়ম নথিবদ্ধ করে নিজেদের ‘স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক’ প্রশাসনের জোর প্রতিশ্রুতি দেয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ক্ষমতা গ্রহণের পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ একাধিক বক্তৃতা ও সরকারি বিবৃতিতে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি ঘোষণা করেন, দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও জনগণের অংশগ্রহণভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। একই সঙ্গে তিনি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের ইঙ্গিতও দেন। তবে বাস্তবে তার প্রশাসনে সেনাবাহিনীর নিরঙ্কুশ প্রভাব, রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম বন্ধ রাখা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দমন নীতির ফলে এ প্রতিশ্রুতির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নও ছিল। মোশতাকের গণতন্ত্র ফেরানোর ঘোষণাকে অনেকেই দেখেন একপ্রকার রাজনৈতিক বৈধতা তৈরির প্রয়াস হিসেবে, যা পরবর্তী সময়ে বাস্তবায়ন হয়নি। তার শাসনকাল মাত্র তিন মাসেরও কম সময় স্থায়ী হয়। ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
নভেম্বরের প্রথম সাতদিনের মধ্যেই দুই দফা অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের প্রত্যক্ষদর্শী হয় বাংলাদেশ। ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থান ঘটান খালেদ মোশাররফ। আর ৭ নভেম্বর পাল্টা আরেক অভ্যুত্থানে মৃত্যু হয় তার। সে সময় জনশ্রুতি ছড়িয়ে পড়েছিল, খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানটি ছিল ভারতপন্থী একটি অভ্যুত্থান। এ জনশ্রুতিকেই বিভিন্ন সময় বিশ্লেষকদের বক্তব্যে তার অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। দুই অভ্যুত্থানের মাঝে ৩ নভেম্বরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতা—তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী ও মো. কামারুজ্জামানকে।
গত বছরের আগস্টের সূচনা হয়েছিল ব্যাপক উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে। আগের ১৫ দিনে দেশের সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনগুলোর হামলায় ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। আন্দোলন দমনের অংশ হিসেবে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে। প্রতিদিনই ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হয় আন্দোলন। এর ধারাবাহিকতায় ৫ আগস্ট এ আন্দোলন রূপ নেয় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে। দেশ ছেড়ে পালান শেখ হাসিনা। ভেঙে পড়ে তার দেড় দশকের স্বৈরশাসনে দুর্বল হয়ে পড়া রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ৫ আগস্টের পর টানা তিনদিন দেশে কোনো কার্যকর সরকার বা প্রশাসনিক নির্দেশনা ছিল না।
৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে। সেনাবাহিনী অন্তর্বর্তী সরকারকে পূর্ণ সমর্থন দেয়। শেখ হাসিনা যখন দেশ ছেড়ে পালান তখন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল সংকটাপন্ন। সরকারের পতনের আগের মাসেই সাধারণ মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ এবং খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। বাজারে সিন্ডিকেটের দাপট ছিল প্রকট। কিন্তু সরকার পতনের পর পরই চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেট কিছুটা দুর্বল হয়। চাল-ডাল-তেলসহ কিছু নিত্যপণ্যের দাম কমতে থাকে। এ সময়েই দেশের পূর্বাঞ্চলে প্রবল বন্যা দেখা দেয়। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, খাগড়াছড়ি ও ফেনী জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল পানিতে ডুবে যায়। সরকার গঠনের কয়েক দিনের মধ্যেই উপদেষ্টাদের বড় পরীক্ষা হয়ে দাঁড়ায় বন্যা মোকাবেলা।
শেখ হাসিনার পতনের পর যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের প্রশংসা জানানো হয়। তবে ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য না করে কেবল জানায়, তারা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। কিন্তু শেখ হাসিনার আকস্মিকভাবে ভারতে আশ্রয় নেয়া নয়াদিল্লির জন্য হয়ে দাঁড়ায় এক জটিল কূটনৈতিক পরীক্ষায়। কারণ তার দীর্ঘ শাসনকালজুড়ে বিরোধী রাজনীতির দমন, নির্বাচনী অনিয়ম এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকোচনের ঘটনায় ভারতের নীরব সমর্থনের অভিযোগ বহুদিন ধরেই অভিযোগ ছিল। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে শুরু হয় ভারতীয় পণ্যের বর্জন আন্দোলন এবং দেশব্যাপী ভারতবিরোধী প্রতিক্রিয়া। শুধু রাজনৈতিক নয়, ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্কও পড়ে যায় চাপের মুখে। অন্যদিকে শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়ার পরও ভারত প্রথম দিকেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি শুভেচ্ছা জানায়। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন সরকারের শপথ গ্রহণের পরপরই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক অভিনন্দন বার্তা পাঠান এবং ঘোষণা দেন যে নয়াদিল্লি ঢাকার সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাবে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে শেখ হাসিনার পতনের পর ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের মাঝে এক ‘অস্বস্তিকর বাস্তবতা’ থেকে গেছে।
২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পর পরই ভারতীয় গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা গুজব, ষড়যন্ত্রতত্ত্ব এবং বিভ্রান্তিকর প্রতিবেদন ছড়িয়ে পড়ে। কিছু কথিত টেলিভিশন চ্যানেল ও অনলাইন পোর্টালে গুজব ছড়ানো হয়, রাজনৈতিক পরিবর্তনের পেছনে পশ্চিমা কোনো গোয়েন্দা সংস্থার প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে। পুরনো বিক্ষোভ ও সংঘর্ষের ভিডিও নতুন বলে প্রচার করা হয়। এসব প্রচার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ছিল অতিরঞ্জিত ও তথ্যবিচ্যুত।
অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে গঠিত দুর্নীতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে উঠে আসে গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে একটি ‘চামচা পুঁজিবাদ’ থেকে রূপান্তরিত ‘চোরতন্ত্র’ গড়ে উঠেছিল। শ্বেতপত্র অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ২৮টি ভিন্ন উপায়ে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন ও দুর্নীতির মাধ্যমে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ২৬ লাখ কোটি টাকা) অবৈধভাবে পাচার হয়েছে বিদেশে। এছাড়া ড. ইউনূস সরকার ঘোষণা দেয়, ২০২৬ সালের এপ্রিলের মধ্যে একটি অংশগ্রহণমূলক ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অবাধ নির্বাচন আয়োজন করা হবে। এ ঘোষণার মাধ্যমে সরকার অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আশ্বাস দেয়।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বণিক বার্তাকে বলেন, ‘২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। এমন ধরনের গণতন্ত্র যাতে আবার নতুন করে স্বৈরতন্ত্র আসতে না পারে। সেজন্য অন্য অভ্যুত্থানের চেয়ে ছাত্রদের এ গণ-অভ্যুত্থান ভিন্ন। এবার সামগ্রিক কাঠামো নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অভ্যুত্থানের যে চিন্তাচেতনা সেটি আমাদের মূলধারার রাজনীতিকে কীভাবে পরিবর্তন করবে এবং রাজনীতি এটিকে কীভাবে ধারণ করবে, সেটিই এখন দেখার বিষয়। সেটি দেখার অপেক্ষায় আমরা আছি এবং নির্বাচন সেটির সুযোগ করে দেবে বলে ভরসা রাখি।’
২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতি পুনর্গঠনের ঘোষণা দিলেও এখন পর্যন্ত পরিস্থিতির উন্নয়নে বড় কোনো অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে স্থবিরতা নেমে এসেছে। বেকারত্ব, বৈষম্য ও দারিদ্র্য জেঁকে বসছে। মূল্যস্ফীতি ও কর্মসংস্থান সংকট পরিস্থিতির আগের চেয়ে কিছুটা উন্নতি হলেও খুব বেশি আশাব্যঞ্জক নয়। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও বিশেষ কোনো অগ্রগতি হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে ‘মব জাস্টিসের’ প্রবণতা দেখা গেছে। রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে আঁকড়ে থাকা ঘুস, দুর্নীতিরও অবসান হয়নি। পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি বাস্তবে রূপ নিচ্ছে ধীরগতিতে। পতিত বিগত সরকারের সময়কার মতোই পুরনো আমলাদের ওপর নির্ভরতা, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের আধিক্য ও সুপারিশের ভিত্তিতে নিয়োগ প্রক্রিয়াসহ নানা সংকটকে সঙ্গে নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে জনপ্রশাসন।
এরই মধ্যে পার হয়েছে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর। প্রশ্ন উঠেছে গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশ কোন পথে এগোচ্ছে? তুলনামূলক পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায়, গণ-অভ্যুত্থানের মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে শ্রীলংকা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পুনর্গঠনের পথে দৃশ্যমান অগ্রগতি অর্জন করেছে। অন্যদিকে ২০১১ সালের আরব বসন্তের সূচনাকারী তিউনিসিয়া এক দশকের বেশি সময় পেরিয়েও দিশা খুঁজে পায়নি। অভ্যুত্থানের পর সেখানে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার শুরু থেকেই সমালোচনার মুখে পড়ে, বিশেষত আগের প্রশাসনের সুবিধাভোগীদের অংশগ্রহণ, আহত ও নিহতদের পুনর্বাসনে ব্যর্থতা এবং শিক্ষাঙ্গনে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হওয়ায়। রাজনৈতিক অঙ্গনে সেক্যুলার ও উগ্র ডানপন্থীদের দ্বন্দ্ব ক্রমেই ঘনীভূত হয়, যা সমাজে ঘৃণা ও সংঘাতের পরিবেশ তৈরি করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তিউনিসিয়ার অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ের কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। এক বছরের ব্যবধানে শিক্ষার্থীরা এখনো পুরোপুরি টেবিলে ফেরেনি, প্রশাসনিক সংস্কারের উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি এবং গণ-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন অনেক ক্ষেত্রেই সীমিত। অর্থনীতির অনেক সূচক এখনো চাপের মুখে এবং রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা কিংবা অংশগ্রহণমূলক সংস্কারের পথে বড় ধরনের অগ্রগতি হয়নি।
সামগ্রিক বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুটা হয়েছিল আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার মধ্য দিয়ে। কিন্তু নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এ সরকারের কৌশলগত বড় ধরনের ঘাটতিগুলো এক বছরের মাথায় স্পষ্ট হয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল স্বৈরাচারী ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি বা স্তম্ভগুলোর সংস্কার করা। যেমন আমলাতন্ত্র। কিন্তু আমার কাছে সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য লেগেছে যে অন্তর্বর্তী সরকার গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলছে, অনেক কিছু সংস্কার করা হবে। কিন্তু একই সঙ্গে তারা বলছে, তাদের আমলাদের দরকার। আমলাতন্ত্র একটা প্রতিষ্ঠান এবং সেটা ছাড়া চলবে না ঠিকই। কিন্তু আামলাতন্ত্র আর আমলার শাসন দুটো ভিন্ন বিষয়। আমলা শাসন নিজেদের সুযোগ-সুবিধাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। আমলা শাসন মাঠের ফলাফল নিয়ে অত বেশি চিন্তিত হয় না। অন্তর্বর্তী সরকার আশ্চর্যজনকভাবে একদিকে গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সুর মিলিয়েছে, কিন্তু বাস্তবায়নের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে আমলা শাসন। এটি একেবারে স্ববিরোধী একটা কর্মকাণ্ড এবং এ স্ববিরোধিতার ফলাফল আমরা এখন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি।’
অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার নিয়ে অনেক উদ্যোগ নিয়েছে এবং ভালো কাজও করেছে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘বিভিন্ন সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। কিন্তু সেক্ষেত্রেও দেখা গেছে কমিউনিটির সম্পৃক্ততা ছিল সবচেয়ে কম। আমলাতান্ত্রিক সুপারিশের ভিত্তিতে করা হয়েছে। তারা মানুষকে গণনার মধ্যে যত না নিয়েছে, তার চেয়ে বেশি তাদের রাজনৈতিক দল বা প্রতিষ্ঠানকে গণনার মধ্যে নিয়েছে। তারা সাধারণ মানুষকে গুরুত্ব দিতে অভ্যস্ত নয়। অর্থাৎ সেই আমলা শাসনের বাস্তবতাই দেখছি আমরা। জুলাই আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে সমাধান করা দরকার ছিল। কিন্তু সবচেয়ে দ্রুততার সঙ্গে যা করা হলো সেটি হলো বঞ্চিতের নামে এক আমলা গ্রুপের দ্রুততম পুনর্বাসন ও ক্ষমতায়ন। এমনকি এখনো যেসব সংস্কারকার্য চলছে, সেখানেও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শ্রম অধিকার, স্থানীয় সরকার, পুলিশ সংস্কার—এগুলো গুরুত্ব পায়নি। সরকার সংস্কারের জন্য ব্যাপক সময় ব্যয় করেছে এক ধরনের সংস্কার আলোচনায়। কিন্তু সেখানেও মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে যেগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে—বিচার ব্যবস্থা, পুলিশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য—সেগুলো গুরুত্ব কম পেয়েছে। কারণ চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের একটা ভিন্ন বার্তা হলো “শুধু কথা বললে হবে না”, কাজ করে দেখাতে হবে। এবং নির্মোহভাবে কাজ করে দেখানোর খতিয়ানটা নিতে হবে এক বছরের মাথায়। আমরা চাই যে অন্তর্বর্তী সরকার সফল হোক, গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাগুলো অর্জিত ও বাস্তবায়ন হোক।’