
ফ্যাসিবাদ-বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে দীর্ঘ আলোচনার পর জুলাই সনদ প্রায় চূড়ান্ত করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তবে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেয়া এবং বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোতে ভিন্নমত দেখা দিয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের তৈরি ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’-এর খসড়া আমলে নিয়ে বিএনপিসহ সংলাপে অংশ নেয়া ডান-বাম-মধ্যপন্থি বেশির ভাগ দলই চায়Ñ নির্বাচিত সংসদের প্রথম দুই বছরে এ সংস্কার বাস্তবায়ন করতে।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ আরো কয়েকটি দল যাদের কোনো জনভিত্তি নেই, তারা চায়Ñ এ সনদকে আইনি ভিত্তি দিয়ে আগামী নির্বাচনের আগেই সাংবিধানিক সংস্কার কার্যকর করা হোক। এ দাবি নাকচ করে দিয়েছে বিএনপি। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, কোনো ফরমান জারি বা সংবিধানে বদল আনার ক্ষমতা বর্তমান সরকারের নেই। এ ছাড়া জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দিতে ঐকমত্য কমিশনের ক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ১২ ফেব্রুয়ারি গঠিত এই কমিশনের কার্যপরিধিতে জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দেয়ার ক্ষমতা দেয়া হয়নি। কমিশন গঠন-সংক্রান্ত গেজেটে বলা হয়েছেÑ ‘জাতীয় ঐকমত্য গঠনে রাজনৈতিক দল এবং শক্তিগুলো আলোচনা করবে, এই মর্মে পদক্ষেপ সুপারিশ করবে।’
ঐকমত্য কমিশনও চায় রাজনৈতিক দলগুলোর সর্বসম্মত মতামতের ভিত্তিতে জুলাই সনদের একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ উপস্থাপন করতে। এ বিষয়ে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ এখনো আশাবাদী। তিনি বলেন, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে জুলাই জাতীয় সনদের একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়া হবে। এরপর তা দলগুলোকে দেয়া হবে। তার ভিত্তিতে জাতীয় সনদ স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হবে। জুলাই সনদ বাস্তায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে আবারো দলগুলোর সাথে আলোচনায় বসবে ঐকমত্য কমিশন।
কমিশন গত ২৮ জুলাই সব রাজনৈতিক দলকে জুলাই সনদের খসড়া দেয়। তা চূড়ান্ত হলে সই করবে রাজনৈতিক দলগুলো। এই সনদে বলা থাকবেÑ কী কী সংস্কার কীভাবে হবে। খসড়ায় সাত দফা অঙ্গীকার রয়েছে। দ্বিতীয় দফায় সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সংস্কারে যেসব সুপারিশে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার রয়েছে। এতে বলা হয়েছেÑ এর জন্য সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন, পরিমার্জন, পুনর্লিখন এবং আইনেও অনুরূপ পরিবর্তন করা হবে। তৃতীয় ও চতুর্থ দফায় সনদ গৃহীত হওয়ার পর পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের দুই বছরের মধ্যে সংস্কারের যেসব সুপারিশে ঐকমত্য হয়েছে, তা বাস্তবায়ন ও টেকসই করার অঙ্গীকার করা হয়েছে। জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন, এলডিপি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিসহ আরো কয়েক দলের আপত্তি রয়েছে এ দুটি দফা নিয়ে।
তবে এসব আপত্তির বিষয় খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। তারা চায় জুলাই সনদ দ্রুত জাতির সামনে উপস্থাপন করা হোক। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে বিএনপির নেতৃত্ব দিচ্ছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি ইনকিলাবকে বলেন, ভাষাগত কিছু দিক ছাড়া সনদের খসড়ার সঙ্গে তারা একমত। জুলাই সনদে যেসব সুপারিশ সেগুলো দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে বলে সব রাজনৈতিক দল প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এটি বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান, আইন ও বিধিবিধানের যেসব সংশোধনী প্রয়োজন হবে, সেগুলো আমরা যদি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্বে যাই তাহলে বাস্তবায়ন করব বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ খুব দ্রুতই হবে বলে আমি আশাবাদী। এটি যখনই চূড়ান্ত হয়ে আমাদের কাছে আসবে, আমরা স্বাক্ষর করব।
জামায়াতের পক্ষ থেকে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় নেতৃত্ব দেয়া দলের নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘আমরা মনে করি, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেয়া যায়। এটি লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক, অধ্যাদেশ, গণভোট বা ফরমান জারির মাধ্যমে হতে পারে। এই সংস্কারের মাধ্যমেই আগামী নির্বাচন হওয়া দরকার, এটিই আমাদের দাবি।’
জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। দলের সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার (আইনগত কাঠামো আদেশ), গণপরিষদ নির্বাচন অথবা গণভোট যেকোনো পদ্ধতিতে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে হবে। কোন পদ্ধতিতে সেটি হবে, সেটি আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করা যেতে পারে, তাতে আমাদের আপত্তি নেই। আইনি ভিত্তির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না হলে আমরা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করব কি-না, সেটি ভাবতে হবে।
আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘এত দিন ধরে আলোচনার পরও জুলাই সনদ কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, তা পরিষ্কার না হলে জনমনে ধোঁয়াশা তৈরি হতে পারে। আলোচনার ভিত্তিতে অনেকগুলো বিষয়ে একমত হওয়া গেছে। কিছু বিষয়ে বিএনপি ‘নোট অব ডিসেন্ট’ (ভিন্নমত) দিয়েছে। সেগুলো কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, সে বিষয়েও স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। তবে আমি আশাবাদী, আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়গুলোর সমাধান বেরিয়ে আসবে।
এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাষ্ট্রবিজ্ঞানি অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, জুলাই সনদের খসড়া রূপরেখায় পিআর পদ্ধতি বাদ দেয়াটা একটি স্বস্তির বিষয়। এখন জুলাই সনদ বাস্তবায়ন কিভাবে হবে সেটি নিয়ে যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে তাও নিরসন হবে বলে মনে করি। দেশের স্বার্থে সব রাজনৈতিক দল নিজেদের দলীয় স্বার্থ পরিহার করবেন এমনটিই সবাই আশা করে। জুলাই বিপ্লবের চেতনাকে সুসংহত করতে হলে ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।
জুলাই বিপ্লবের চেতনাকে রাষ্ট্রীয় কঠামোর সর্বস্তরে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ড. মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন কমিশন গঠন করে। এ সব কমিশনের বিভিন্ন সুপারিশের ভিত্তিতে জুলাই জাতীয় সনদ তৈরির লক্ষে গঠিত হয় ঐকমত্য কমিশন। এর মধ্যে ছয়টি কমিশনের ১৬৬টি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্য কমিশন। প্রথম পর্বে ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত ফ্যাসিবাদ-বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়া দলগুলোর সাথে পৃথকভাবে আলোচনা করে কমিশন। প্রথম পর্বে ঐকমত্য হয়নি, এমন ২০টির মতো মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে দ্বিতীয় ধাপে গত ৩ জুন থেকে সব দলকে একসঙ্গে নিয়ে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা শুরু করে ঐকমত্য কমিশন, যা গত ৩১ জুলাই শেষ হয়। ২৩ দিনের বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় মৌলিক সংস্কারের ২০টি প্রস্তাবে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে আটটি বিষয়ে সব দল একমত হয়েছে। বাকি ১২টিতে বিভিন্ন দলের ভিন্নমত বা মন্তব্যসহ সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সব দল যে আটটি বিষয়ে একমত হয়েছে সেগুলো হচ্ছেÑ ১. সংসদীয় কমিটির সভাপতিত্ব; ২. নির্বাচনী এলাকার সীমানা; ৩. প্রেসিডেন্টের ক্ষমা-সম্পর্কিত বিধান; ৪. রুরি অবস্থা ঘোষণা; ৫. প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল; ৬. নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও সম্প্রসারণ; ৭. বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ ও ৮. পুলিশ কমিশন গঠন। ভিন্নমতসহ যে সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে সেগুলো হলোÑ ১. ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন ২. প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান; ৩. সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের বিধান সংবিধানে যুক্ত করা; ৪. নারী প্রতিনিধিত্ব; ৫. দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন ৬. উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ও উচ্চকক্ষের ক্ষমতা; ৭. প্রেসিডেন্ট নির্বাচন; ৮. প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা ও দায়িত্ব; ৯. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা; ১০. রাষ্ট্রের মূলনীতি। এ ছাড়া প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়েও দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। সবদল কর্মে সিনিয়র বিচারপতির বিষয়ে ঐকমত্য হলেও বিএনপি আরো দুটি বিকল্প রাখার পক্ষে মত দিয়েছে।