
‘অনেক আসামি দেশের বাইরে চলে গেছে। আবার অনেকে দেশে থাকার পরেও এখনো আইনের আওতায় আসেনি। বিচার নিশ্চিত না হলে আমাদের হাজারো সন্তানের রক্ত ও আত্মত্যাগ বৃথা যাবে। কোটি কোটি টাকা বা অট্টালিকা আমরা চাই না। সন্তানের হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচারই একমাত্র চাওয়া।’ এভাবেই নিজের হতাশা ও আক্ষেপের কথাগুলো বলছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ফেনীতে শহীদ ইশতিয়াক আহমেদ শ্রাবণের বাবা নেছার আহম্মদ।
জানা যায়, গেল বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হাজারো শহীদদের মধ্যে একজন শ্রাবণ। ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচির অংশ হিসেবে ফেনীর মহিপালে আন্দোলনে যোগ দেন শ্রাবণ। পরে সেখানে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নির্বিচারে গুলিতে প্রাণ হারান তিনি। শ্রাবণ ফেনী সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, শ্রাবণ ছিলেন একজন তরুণ সংগঠক ও ক্রিকেটার। ২০০৪ সালের ১২ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ২০২৩ সালে ফেনী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অপেক্ষায় ছিলেন। শহীদ শ্রাবণ বাবা-মায়ের সঙ্গে ফেনী শহরের বারাহীপুর এলাকায় বসবাস করতেন। তার পৈত্রিক বাড়ি ফুলগাজী উপজেলার আনন্দপুর ইউনিয়নে। তিন-ভাইবোনের মধ্যে শ্রাবণ সবার বড় ও পরিবারের একমাত্র ছেলে ছিলেন।
শ্রাবণের বাবা নেছার আহম্মদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের এখন আর কোনো আনন্দ নেই। আখিরাতে ছেলের সঙ্গে দেখা হলে সেদিনই আনন্দ হবে। বুকে পাথর নিয়ে চলাফেরা করি। কাউকে বলতেও পারি না একমাত্র সন্তান হারানোর এই কষ্ট।
অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের প্রতি হতাশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, উনারা (ছাত্ররা) বিভিন্ন রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। এখন রাজনৈতিক দল নিয়ে এসেছে। শহীদ পরিবারের দিকে কে তাকাবে? এজন্যই এখনো বাধ্য হয়ে রাস্তায় নামতে হয়। আমরা ন্যায্য ও প্রাপ্য অধিকার চাই।
শ্রাবণের মা ফাতেমা আক্তার শিউলি বলেন, ৪ আগস্টের পর থেকে সব আনন্দ চলে গেছে। আমাদের গোছানো একটি জীবন অগোছালো হয়ে গেছে। জীবনের সব আনন্দ ওইদিনই শেষ হয়ে গেছে। বড় মেয়েটি সারাক্ষণ একা একা বসে কান্না করে, শ্রাবণই ছিল তার ভাই-বন্ধু। মেয়েটি কাউকে কিছু বুঝাতে পারে না এখনো। ভাইয়ের শোকে কারো সঙ্গে কথাও বলে না। আমার আনন্দ বা সুখ-আহ্লাদ সবকিছু আমার ছেলের কাছে রয়ে গেছে।
তিনি বলেন, এখন শুধু সুষ্ঠু একটি বিচারই চাওয়া। এজাহারনামীয় আসামিরা বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বড় বড় আসামিরা দেশের বাইরে পালিয়ে গেছে। আর এ দুনিয়াতে বিচার না হলেও মহান আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছি। আমি তো সন্তানক হারিয়ে ফেললাম, বিচার আল্লাহ করবে ইনশাআল্লাহ। আমার ছেলে সবসময় ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলতো। এসব বিষয়ে ভীষণ আন্তরিক ছিল।
জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, আন্দোলনে ফেনীতে হতাহতের সংখ্যা অন্য জেলার চেয়ে তুলনামূলক বেশি ছিল। ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক, চিকিৎসা সহায়তা ও পুনর্বাসনের জন্য আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে জেলার ১০টি শহীদ পরিবারকে ১০ লাখ টাকা করে মোট ১ কোটি টাকা সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। আহতদের মধ্যে ‘এ’ ক্যাটাগরির তিনজনকে ৬ লাখ টাকা, ‘বি’ ক্যাটাগরির ৩০ জনকে ৩০ লাখ টাকা এবং ‘সি’ ক্যাটাগরির ৩৪৩ জনকে ৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। এসব সহায়তার বাইরেও জেলা প্রশাসন, সমাজসেবা অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন দপ্তরের মাধ্যমে সবমিলিয়ে হতাহতদের এখন পর্যন্ত প্রায় ৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকা সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
ফেনীতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে জানতে কথা হয় পুলিশ সুপার মো. হাবিবুর রহমানের সঙ্গে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, জেলায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ঘটনায় ২২টি মামলা হয়েছে। তারমধ্যে ৭টি হত্যা ও ১৫টি হত্যাচেষ্টা মামলা। এসব মামলায় ২ হাজার ১৯৯ জন এজাহারনামীয় ও আরও ৪ হাজার অজ্ঞাত আসামি রয়েছে। তাদের মধ্যে ১ হাজারের বেশি আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার ১১ জন আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ইতোমধ্যে একটি মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।