Image description

তিস্তা ও ধরলা নদীর তীব্র ভাঙনে দিশেহারা হয়ে পড়েছে লালমনিরহাট জেলার নদীতীরবর্তী পরিবারগুলো। প্রতিদিনই নদীগর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে আবাদি জমি, ঘর-বাড়ি ও বসতভিটা। কৃষক পরিবারগুলো হারাচ্ছে জীবিকা, ঘরবাড়ি এবং বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বনটুকুও। গত ১০ বছরে তিস্তা ও ধরলার কড়াল গ্রাসে হাজার হাজার পরিবার আবাদি জমি ও বসতভিটা হারিয়ে ভূমিহীন হয়ে চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছেন। ভাঙন আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটছে তিস্তা-ধরলাপাড়ের মানুষের।

ধরলার ভাঙনের ভয়াল থাবায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে লালমনিরহাট সদর উপজেলার মোগলহাট ইউনিয়নের বুমকা, বনগ্রাম, শিবেরকুঠি, বাসুরিয়া এবং তিস্তা নদীর ভাঙনে লালমনিরহাটের কলেজপাড়া, ধুবনী, সিন্ধুর্না, পারুলিয়া, ডাউয়াবাড়ি, ভোটমারি, হরিণচড়া, রাজপুর, পাগলারহাট ও চিনাতলী ভাঙনের ভয়াল থাবায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

লালমনিরহাট সদর উপজেলা বুমকা গ্রামের কৃষক আব্দার রহমান শেখ (৬৫) বলেন, ‘ধরলা নদী ভাঙতে ভাঙতে শুধু বসতভিটাটুকু বাকি। কীভাবে চলবে আমাদের আগামী দিনগুলো একমাত্র আল্লাহই জানেন।’

একই গ্রামের ভোলানাথ দেবনাথ (৬০) বলেন, ‘ধরলার ভাঙনে একে একে পাঁচ বিঘা জমি চলে গেছে। বাকি জমিগুলোও এখন হুমকির মুখে। আমাদের সংসার একসময় সচ্ছল ছিল। এখন রাস্তায় উঠে আসার উপক্রম।

মোগলহাট ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য জোনাব আলী বলেন, ‘ দেবনাথপাড়া এলাকায় শতাধিক বিঘা জমি ইতোমধ্যে নদীতে বিলীন হয়েছে। আরো প্রায় ৩০০ বিঘা জমি ঝুঁকিপূর্ণ। পানি উন্নয়ন বোর্ড পরিদর্শনে আসছে। তাদের উচিত জরুরি ভিক্তিতে ভাঙন প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া। জিও ব্যাগ ফেলানো গেলে অনেক জমি রক্ষা পেত।

লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শুনীল কুমার জানান, জেলায় তিস্তা ও ধরলা নদীতে এরকম প্রায় ২৫টি এলাকায় কমবেশি ভাঙন দেখা দিযেছে। ভাঙন অব্যাহত থাকায় সেখানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়নে ভাঙন প্রতিরোধে কিছু কিছু জায়গায় কাজ চলমান রয়েছে। তিনি আরো বলেন, ‘উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। বরাদ্দ পেলেই জিও ব্যাগ ফেলার কাজ শুরু করা হবে।’

মহিষখোঁচা ইউনিয়নের কুটিরপাড় গ্রামে তিস্তার তীরে বসে কূলভাঙার দৃশ্য অপলক দৃষ্টিতে দেখছিলেন কৃষক আকবর আলী (৬৫)। তার চোখে-মুখে পৈতৃক একখণ্ড জমি হারানোর শঙ্কা। তিস্তা নদীর পানিও কমছে, ভাঙনও বাড়ছে। বালাপাড়া গ্রামের ষাটোর্ধ্ব কৃষক মনছুর আলী বলেন, ভিটেমাটি গিলেছে তিস্তা। সব হারিয়ে পরিবার নিয়ে আজ নিঃস্ব আমি।

শেষ সম্বল ঘর-বাড়ি ও ভিটেমাটি নদীগর্ভে বিলীনের আশঙ্কায় চরম দুর্দিন পার করছেন সদর উপজেলার বনগ্রামের বাসিন্দা কফিল (৬৫)। ধরলার তীব্র ভাঙনে নদী তার বাড়ির কাছে চলে এসেছে। তাই আগ্রাসী ধরলার ভাঙন থেকে ঘর-বাড়ি রক্ষা করতে ইতোমধ্যে অন্য জায়গায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন। কিন্তু বাড়ি-ঘর নতুন জায়গায় নতুন করে তোলার টাকার অভাবে কফিলসহ অনেকে চরম দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন।

কফিল জানান, ‘কি কই বাহে, ৬৫ বছর বয়সে কমপক্ষে চার-পাঁচ বার বাড়ি-ঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। বাড়ি-ঘর জমিজমা হারিয়ে এখন নিঃস্ব। আমার নিজস্ব জমি না থাকায় গত পাঁচ বছর ধরে মানুষের জমিতে ঘর-বাড়ি করে স্ত্রী-সন্তানসহ অতিকষ্টে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে আসছি। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ধরলার তীব্র ভাঙন একেবারে বাড়ির কাছেই চলে এসেছে।

সদর উপজেলার শিবেরকুঠি গ্রামের মহিবর রহমানের স্ত্রী বিলকিছ বেগম (৩৫) জানান, ‘নদী ভাঙতে ভাঙতে একেবারে আমাদের বাড়ি থেকে নদীর দূরত্ব মাত্র ২০ গজ। যেকোনো মুহূর্তে আমাদের বাড়ি-ঘর নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা করছি। দ্রুত সময়ের মধ্যে ধরলার ভাঙন ঠেকাতে না পারলে অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাবে।’

লালমনিরহাট সদর উপজেলার মোগলহাট ইউনিয়নের ফলিমারী গ্রামের বাসিন্দা বাহার উদ্দিন (৫৫) মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। গত কয়েক দিন আগে চোখের সামনেই বসতভিটা ধরলা নদীরগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এখন আশ্রয় নিয়ে আছেন অন্য জায়গায়।

তিস্তাপাড়ের অলিমা খাতুন (৪৫) আহাজারি করে বলেন, ‘হামাক বাঁচান ব্যাহে, হামার শোগ শ্যাষ। সব নদীত ভাঙিয়া গেইছে ব্যাহে। হামাক বাঁচান। হামরা কই যাম কী খামো, শোগ নদী ভাঙি নিয়া যাবার লাগছে।

তিস্তাপাড়ের অপর এক ভুক্তভোগী তসর উদ্দিন (৫০) বলেন, ‘নদীর মাঝখানে আমার বাড়ি ছিল। বাড়ি ভাঙতে ভাঙতে আজ যেখানে বাড়ি দেখতেছেন তার পাশ পর্যন্ত ভাঙন আসছে। আমার বাড়িটা যেকোনো সময় ভাঙতে পারে। নদীর কিনারত (কাছাকাছি) আসছে ভাঙন। সরকার শুধু হামাক বুঝ দেয়।’

তিস্তাপাড়ের আবুল হোসেন বলেন, ‘আমরা রিলিপ-টিলিপ কিছু চাই না বাহে, বালুর বাঁধ থাকি শুরু করি নদীর পাশে যদি বস্তা দিত তাহলে আর নদী ভাঙত না।

সদর উপজেলার হরিণচড়া গ্রামের বাসিন্দা মকবুল হোসেন বলেন, তিস্তা নদীভাঙনে আমরা দিশেহারা। বর্তমানে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে নদীর স্রোত ডান দিক দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর ফলে ব্যাপক নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনে কৃষি জমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা নদী ভাঙনের কবলে পড়ছে।