
ফেনীর সোনাগাজীতে মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে ছাদে আগুন দিয়ে হত্যার ঘটনার তদন্তে পরতে পরতে অনিয়ম আর সন্দেহ ছিল পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআইয়ের বিরুদ্ধে। অভিযোগ উঠেছে, বিশেষ উদ্দেশ্যে আত্মহত্যার ঘটনাকে হত্যা নাটক সাজিয়ে পাকাপোক্ত করে আদালতে চার্জশিট দেয় পিবিআই। এর ফলে উপস্থিত সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে বিচারক মামলার ১৬ আসামির প্রত্যেককেই মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন। ওই মামলায় রায়ে সোনাগাজী সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার তৎকালীন অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলাসহ ১৬ জন এখন কনডেম সেলে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হওয়ায় নুসরাত হত্যাকাণ্ডের ভয়মুক্ত সাক্ষীরা দিচ্ছেন এখন সেই সময়ের জোরজবরদস্তি সাক্ষ্য আদায়ের চাঞ্চল্যকর তথ্য। ফলে আবারও আলোচনায় সেই নুসরাত হত্যা ঘটনা। এ অবস্থায় আলোচিত মামলাটির পুনঃতদন্তের দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীসহ সচেতন মহলের অনেকেই।
সম্প্রতি প্রবাসী সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেন তার ইউটিউব চ্যানেলে ‘আত্মহত্যাকে হত্যা দেখিয়ে ১৬ জনের ফাঁসি!’ শিরোনামে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। ৩৪ মিনিট ৪৪ সেকেন্ডের সেই ভিডিওতে উঠে আসে মামলার পেছনে চাঞ্চল্যকর বেশকিছু তথ্য। এদিকে যুগান্তরের অনুসন্ধানেও বেরিয়ে আসে নুসরাতের মৃত্যুর নেপথ্যে চাঞ্চল্যকর বেশকিছু তথ্য।
২০১৯ সালের ৬ এপ্রিল সোনাগাজী ফাজিল মাদ্রাসার একটি ভবনের ছাদে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ৮০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া শরীর নিয়ে সে নিজেই নিচে নেমে আসে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই বছরের ১০ এপ্রিল রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে তার মৃত্যু হয়।
এর আগে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে মামলা করেন নুসরাতের মা। ঘটনার সূত্রপাত সেখান থেকেই। পরে মামলার তদন্তভার পায় পিবিআই। মামলার বাদী হন নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান। তদন্তে দাবি করা হয়, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। মাত্র ৬১ কার্যদিবসে মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষ হয়। ওই বছরের ২৪ অক্টোবর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ১৬ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন। তবে দণ্ডপ্রাপ্তদের পরিবার এবং অনুসারীরা দাবি করছেন, সিরাজ উদ-দৌলার সঙ্গে দ্বন্দ্বের জের ধরেই নুসরাত আত্মহত্যা করেন। অথচ পিবিআই তদন্তে একে ‘হত্যাকাণ্ড’ হিসাবে ‘সাজিয়ে’ নাটক তৈরি করে।
তারা বলছেন, আত্মহত্যার আগে এক শিক্ষকের মোবাইলে নুসরাত এসএমএস করেছিল, ‘স্যার, সিরাজ উদ-দৌলার জামিন হলে আমি আত্মহত্যা করব এবং সবাইকে ফাঁসিয়ে দেব।’ ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের স্বজনদের অভিযোগ, তদন্তে নিরপেক্ষতা ছিল না পিবিআইর। বরং রাজনৈতিক প্রভাব ও ব্যক্তিগত রেষারেষির শিকার হয়েছেন তারা। কেউ কেউ দাবি করেছেন, তদন্ত কর্মকর্তাদের চাহিদামাফিক অর্থ দিতে না পারায় মামলা থেকে অনেকে বাঁচতে পারেননি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নুসরাতের দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে ঘুস লেনদেন ও আসামিদের পরিবার থেকে অর্থ আদায়ের অভিযোগও। ভাই রাশেদুল হাসানের একটি ভিডিও ইতোমধ্যে ভাইরাল হয়েছে, যেখানে তাকে টাকার বিনিময়ে মামলা থেকে আসামির নাম কাটানোর কথা বলতে শোনা যায়। আসামিদের পরিবার থেকে একের পর এক অভিযোগ আসছে, জবানবন্দি আদায় করা হয়েছে নির্যাতনের মাধ্যমে, ঘটনার সময় অনেকে ঘটনাস্থলে ছিলেনই না। পিবিআইর তদন্তে নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার জন্য যে কেরোসিন ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে, তা নাকি স্থানীয় দোকান থেকে কেনা হয়েছিল। অথচ সেই দোকানের মালিক জানান, তিনি কখনো কেরোসিন বিক্রিই করেননি। তাছাড়া চার্জশিটে যে বোরকা উদ্ধারের কথা বলা হয়েছে তার একটি ভিডিও পাওয়া গেছে। যেখানে দেখা যায়, বোরকাটি উদ্ধারের আগে একজন পুকুরে নেমে বোরকাটি পানির নিচে কাদার মধ্যে পুঁতে রাখেন। পরে সেটি নাটকীয়ভাবে উদ্ধার দেখানো হয়।
ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সাইফুর রহমান জোবায়েরের বাবা আবুল বশর বলেন, ঘটনার দিন আমার ছেলে বাড়িতে আমার সঙ্গে গাছের ডালপালা কাটছিল। খবর পেয়ে সে এসে ওই ছাত্রীকে হাসপাতালে ভর্তিতে সহযোগিতা করে। কিন্তু আমার ছেলেকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নির্যাতন চালিয়ে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়। আমরা আপিল করেছি, আশা করি ন্যায়বিচার পাব। ওই মাদ্রাসার ইংরেজি বিষয়ের প্রভাষক আবছার উদ্দিনের স্ত্রী সুরাইয়া আবছার ইফাত বলেন, আমার স্বামীসহ সব আসামিই নির্দোষ। আত্মহত্যার ঘটনাকে যারা হত্যায় রূপান্তরিত করেছে তাদের শাস্তি চাই। অপর দণ্ডপ্রাপ্ত মহিউদ্দিন শাকিলের ভাই ইমাম উদ্দিন সোহাগ বলেন, পিবিআই প্রধান বনজ কুমার, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহআলমসহ যারা আত্মহত্যার ঘটনাকে হত্যায় রূপান্তরিত করেছেন তাদের গ্রেফতারের দাবি জানাচ্ছি। আমার নির্দোষ ভাইকে যেভাবে বারবার রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করেছে, একই ভাবে তাদেরও রিমান্ডে নিয়ে রহস্য উদ্ঘাটন করা হোক।
দণ্ডপ্রাপ্ত কামরুন নাহার মনির মা নুরনাহার বলেন, আমার অন্তঃসত্ত্বা মেয়ে কারাগারে সন্তান জন্ম দিয়েছে। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় তাকে বারবার রিমান্ডে নেওয়া হয়। নুসরাতের মেজো ভাই আরমান আমার মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। বিয়ে দেইনি বলে তাকে ফাঁসানো হয়েছে। আমি মামলা চালাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছি। আত্মহত্যার ঘটনাকে হত্যা দেখিয়ে ১৬ জন লোককে ফাঁসানো হয়েছে।
দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি জাবেদ হোসেনের বাবা রহমত উল্লাহ বলেন, নুসরাত আত্মহত্যা করেছিল। কিন্তু মিডিয়া ট্রায়ালের কারণে আমার ছেলেসহ ১৬ জন লোককে ফাঁসির দণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ওই মাদ্রাসার পিওন মামলার সাক্ষী নুরুল আমিন বলেন, নুসরাতসহ পাঁচজন মেয়ে পাঁচ ছাত্রের সঙ্গে প্রেম করে ছাদের ওপর আড্ডা দিচ্ছিল। তখন প্রিন্সিপাল সিরাজ-উদ দৌলা তাদের শাসন করেছিলেন। তখন থেকে প্রিন্সিপালকে দেখে নিতে তারা ষড়যন্ত্র করেছিল। ঘটনার দিন আমি অফিসে পরীক্ষার কাগজ ভাঁজ করছিলাম। চিৎকার শুনে ঘটনাস্থলের দিকে এগিয়ে যাই। নুসরাতকে গায়ে আগুন দেওয়া অবস্থায় নেমে আসতে দেখি। তবে ছাদের ওপর অন্য কাউকে দেখিনি। পরে পিবিআই পুকুরে নতুন বোরকা ফেলে আবার নাটকীয়ভাবে পুকুর থেকে তুলেছিল। তখনো আমি বলেছিলাম এটা তো নতুন বোরকা। এরপর থেকে ৩-৪ মাস সকাল ৯টা থেকে গভীর রাত পযন্ত ফেনীর পিবিআই অফিসে আমাকে হাজিরা দিতে হতো। ওই সময়ে আমার তিন-চার লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এছাড়া একটি এনজিও থেকে এক লাখ টাকা ঋণ করে পিবিআইয়ের পরিদর্শক শাহআলমকে দিয়েছি।
ফেনীর সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি, ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত রুহুল আমিনের ভাতিজা ফখরুদ্দিন রানা বলেন, আমার কাকা রুহুল আমিনসহ ১৬ জনই নিরপরাধ, তাদের ফাঁসানো হয়েছে। আরেক দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আবদুর রহিম শরীফের বাবা আবদুল শুক্কুর বলেন, আমরা জেনেছি মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে। অথচ আমার ছেলেসহ অন্যদের ফাঁসানো হয়েছে।
সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলমের ছোট ভাই মাঈন উদ্দিন রুবেল বলেন, এটা তো আয়নার মতো পরিষ্কার মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু আমার ভাইসহ ১৬ জন আসামি ফাঁসির আদেশ নিয়ে কারাবন্দি আছেন। আমি সবার মুক্তি চাই। সোনাগাজী সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার পিওন মো. মোস্তফা বলেন, পিবিআই আমার কাছ থেকে জোরপূর্বক সাক্ষ্য নিয়েছিল। ঘটনার পর পিবিআই সদস্যরা যখন ছাদের দিকে উঠতে চেয়েছিলেন তখন আমি বাধা দিয়েছিলাম। আমি হত্যা কিংবা আত্মহত্যা কোনোটিই দেখিনি।
ওই মাদ্রাসার বাংলা বিভাগের অধ্যাপিকা খুজিস্তা খানম গণমাধ্যমে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
মামলার অন্যতম সাক্ষী ওইদিন পরীক্ষার হল সুপার মাওলানা নুরুল আবছার ফারুকী বলেন, ঘটনার দিন আমি অফিস কক্ষ থেকে শোরগোল ও চিৎকার শুনতে পাই। প্রথমে ভেবেছিলাম আগুন লেগেছে। তাৎক্ষণিক ওই মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক বেলায়েত হোসেনকে মেইন সুইচ বন্ধ করতে বলে আমি ঘটনাস্থলের দিকে এগিয়ে যাই। তখন দেখি একজন পুলিশ কনস্টেবল ও মাদ্রাসার নাইট গার্ড একজন ছাত্রীকে কোলে তুলে মাদ্রাসার গেটের দিকে হাসপাতালের উদ্দেশে নিয়ে যাচ্ছিল। আমি আদালতে এমন সাক্ষী দিয়েছি।
বিশিষ্ট ফৌজদারি বিশ্লেষক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পী বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, বিচারিক আদালতে নুসরাত হত্যার বিচারটি শেষ হয়ে এখন হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্সের জন্য আছে। মামলাটি রায়ের পর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হাইকোর্টের কয়েকটি বেঞ্চ ঘুরে পরে একটি বেঞ্চে দীর্ঘদিন শুনানি হয়। শুনানি প্রায় শেষ হয়ে আর্গুমেন্ট পর্যায়ে ছিল। হঠাৎ করে বেঞ্চটি ভেঙে যাওয়ায় আর শুনানি হয়নি। আপাতদৃষ্টিতে বিচারিক আদালতে মামলাটির বিচার আইনগতভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। এখন বিচারে সঠিক ঘটনা উন্মোচিত হয়েছে কিনা-আদালতেই সেটি উপস্থাপন করতে হবে।
মো. সারোয়ার হোসেন বাপ্পী আরও বলেন, নুসরাত হত্যার ঘটনাটি আত্মহত্যা কিনা সেটা প্রমাণের এখনো সুযোগ আছে। প্রকৃত ঘটনা উন্মোচিত হয়েছে কিনা, সেটি হাইকোর্ট দেখতে পারেন। বিচারিক আদালতে যদি প্রকৃত ঘটনা উন্মোচিত না হয়ে থাকে, তাহলে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা এখানে সাক্ষ্য-প্রমাণ তুলে ধরতে পারেন। পরে উচ্চ আদালত বিচার বিশ্লেষণ করে একটা রায় দেবেন। মিথ্যা প্রমাণিত হলে নির্দোষ ব্যক্তিরা খালাস পাবেন আর ঘটনায় জড়িতরা শাস্তির সম্মুখীন হবেন। এ পর্যায়ে মামলাটি পুনঃতদন্তের কোনো সুযোগ নেই। বিচারেই একমাত্র বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে।
এদিকে আসামিদের স্বজনদের আনা অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের সাবেক পরিদর্শক মো. শাহআলম বলেন, ‘উচ্চ আদালতে বিচারাধীন এই মামলার বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’
অভিযোগের বিষয়ে তৎকালীন পিবিআই প্রধান ও অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ‘যেহেতু এই মামলার বিচার শেষ হয়ে গেছে। সেহেতু এ বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই।’
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআইর প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মো. মোস্তফা কামাল বলেন, ‘নুসরাত হত্যার ঘটনায় তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিট দাখিল হয়েছে। পরে মামলার রায় হয়েছে। ওই মামলার বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে পারি না।’
এদিকে নুসরাতের ভাই ও মামলার বাদী মাহমুদুল হাসান নোমান বলেন, আমরা বিচারিক আদালতে ন্যায়বিচার পেয়েছি। এখন উচ্চ আদালতের রায়ের জন্য অপেক্ষায় আছি। তবে আসামিপক্ষ আমাদের প্রকাশ্যে হুমকি দিচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তারা সক্রিয়। এতে আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নুসরাত হত্যার বিচার নিয়ে দেশের মানুষ এক সময় যেমন স্বস্তি পেয়েছিল, এখন আবার সেই ঘটনায় প্রশ্ন জেগেছে। সত্যি যদি কারও প্রতি অবিচার হয়ে থাকে, তবে তা খুঁজে বের করাই হবে আইনের প্রকৃত জয়। উচ্চ আদালতই বলবেন-এটি ছিল নির্মম হত্যাকাণ্ড, নাকি অপব্যাখ্যাকৃত আত্মহত্যা?