Image description
২৪ শতাংশ ভোটার তরুণ, তরুণদের মেজাজ বুঝে কাজ করার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভয়াবহ বিমান  দুর্ঘটনার পর সরকারের ২ উপদেষ্টাকে ১২ ঘণ্টা আটকে রেখেছিলেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। প্রশাসন এবং কলেজ কর্তৃপক্ষের চেষ্টার কোনো ত্রুটি না থাকলেও ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি তারা। এমনকি দেশে ক্রিয়াশীল বড় ছাত্র সংগঠনগুলোর চেষ্টাও কোনো কাজে লাগেনি। 
এ ছাড়াও দেশে যখন কোনো চাঞ্চল্যকর অথবা অমানবিক ঘটনা ঘটে সেটিকে স্যোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে ভাইরাল করে প্রশাসনকে বাধ্য করা হয় পদক্ষেপ নিতে।

দেশের এমন একটি প্রেশার গ্রুপের সংঘবদ্ধ অস্তিত্ব পাওয়া যায় গত বছরের জুলাই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। তবে বেশিরভাগ তরুণ সমাজ (ছাত্র-কর্মজীবী) দেশের প্রচলিত ব্যবস্থাকে পরিবর্তন বা সংস্কারের পক্ষে। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তারা একমত।

আগামীর বাংলাদেশে এ তরুণ সমাজের মেজাজের বাইরে গিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যে কোনো সরকারের পক্ষে কঠিন হবে বলে মনে করেন রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা। আগামীর বাংলাদেশে তারা ফ্যাক্টর হয়ে আছেন বলে মনে করেন এ রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করতে হলেও এ তরুণদের মেজাজকে বুঝতে ভুল করলে যে কোনো দলের জন্য ভরাডুবির কারণ হতে পারে বলেও মনে করেন তারা। ফলে আগামীর বাংলাদেশের জন্য ফ্যাক্টর হবে এ সব তরুণরা। 
তারা মনে করেন, পাকিস্তান আমল থেকে দেশের নানান সংকটে ছাত্র-যুবকদের ভূমিকা ছিল অগ্রভাগে। তবে সব সময়ই ছাত্ররা পরিচালিত হতো কোনো না কোনো ছাত্র সংগঠনের ব্যানারে। এমনকি ডাকসুসহ সকল ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্র সংগঠনের ব্যানারেই নেতা নির্বাচিত হতো। এমনকি ২০০৭ সালের ছাত্র আন্দোলনেও ছাত্র সংগঠনগুলোর ভূমিকা ছিল মুখ্য এবং নেতৃত্বেই ছিলেন তারা। কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনটি পরে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। ফলাফল হিসেবে ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যান ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাসহ তার সরকারের সকল মন্ত্রী এবং বিপুলসংখ্যক আওয়ামী লীগের নেতারা। 

আন্দোলনটির সামনের সারিতে ছিলেন জেন-জি বা জেনারেশন জেড (১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের ভেতর যাদের জন্ম)। এরা কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। এখনো একটা বিরাট অংশ কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। ফলে যে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত কিংবা অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে কোনো সময় এ তরুণরা আবারও মাঠে নামার সম্ভাবনা প্রবল।

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশের তরুণরা অতীতের অনেক সময়ের চেয়ে এখন বেশি সচেতন। তরুণ জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে একটি রাষ্ট্রে একটি পরিবর্তন দেখতে চেয়েছিল। সেটি হলো সমাজ নিয়মের মধ্য দিয়ে চলবে যেখানে পরিপূর্ণভাবে আইনের শাসন কার্যকর থাকবে।

যারা বর্তমানে এবং আগামী দিনে দেশ পরিচালনা করবেন তাদের তরুণদের স্বপ্নকে বুঝতে হবে। ভুল করলে তরুণরা আবার ক্ষেপে যাবে এবং আবার মাঠে নামার সম্ভাবনা থাকবে। 

নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, দেশের মোট ভোটার ১২ কোটি ৪৪ লাখ ৮০ হাজার। এর মধ্যে তরুণ ভোটার তিন কোটি চার লাখ সাত হাজার। মোট ভোটারের মধ্যে ২৪ দশমিক ৪২ শতাংশই ১৮ থেকে ২৯ বছরের তরুণ। এসব তরুণদের বড় অংশই কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এসব তরুণরা কোনো জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি। এমনকি ক্যাম্পাসগুলোতে সঠিকভাবে তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতাও ছিল না। 

ফলে আগামী নির্বাচনে এসব তরুণরা তাদের মেজাজের সঙ্গে যায় এমন দল এবং প্রার্থীকে জয়লাভের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার সম্ভাবনাই বেশি।

এসব বিষয় মাথায় রেখে নির্বাচনে জয়ের জন্য তরুণদের ভোট টানতে নানা ছক কষছে বিএনপি, জামায়াতসহ অন্য দলগুলো। একই সঙ্গে পালন করছে নানা কর্মসূচি, নির্ধারণ করছে কৌশল। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশ এবং প্রেক্ষাপটে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হলো- ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচন। এসব নির্বাচনে জয় পরাজয় নিশ্চিত হয়েছে ১০ শতাংশ ভোটে। আর বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৪ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতসহ বেশির ভাগ দল অংশ নেয়নি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জাময়াত অংশ নিলেও রাতের ভোট হিসাবে খ্যাতি পাওয়া ওই নির্বাচন দেশে এবং বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। ফলে এসব নির্বাচনের ফলাফল এবারের নির্বাচনে কোনো ফল বয়ে আনবে না।

ইসির পরিসংখ্যান মতে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিন কোটি ৩৬ লাখ ৩৪ হাজার ৬২৯টি ভোট পেয়ে ২৩০টি আসনে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ। দলটির প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ৪৮.০৪ শতাংশ। ওই নির্বাচনে বিএনপি দুই কোটি ২৭ লাখ ৫৭ হাজার ১০১ ভোট পেয়ে ৩০ আসনে জয় পায়। বিএনপির প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ৩২.৫০ শতাংশ।

আর জামায়াতে ইসলামী পেয়েছিল ৩২ লাখ ৮৯ হাজার ৯৬৭ ভোট, যা প্রদত্ত ভোটের ৪.৭০ শতাংশ। আসন পায় দুটি। এর আগে ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ৪০.৯৭ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৯৩ আসনে জয়ী হয়। আর আওয়ামী লীগ ৪০.১৩ শতাংশ ভোটে ৬২ আসন পায়। আর জামায়াতে ইসলামী ৪.২৮ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৮ আসনে জয়লাভ করে।

ইসির হিসেবে দেশে বিদ্যমান ভোটার তালিকার ২৪.৪২ শতাংশ তরুণ। গত বছরের ১৭ মার্চ পর্যন্ত হালনাগাদ তালিকায় দেশে মোট ভোটার সংখ্যা ১২ কোটি ৪৪ লাখ ৮০ হাজার ৬৮৭ জন। এর মধ্যে ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সী তরুণ ভোটার তিন কোটি চার লাখ সাত হাজার। এ ছাড়া ৩০-৪১ বছর বয়সী ভোটার সংখ্যা তিন কোটি ৫৯ লাখ ৭৩ হাজার।

তবে ইসি ধারণ করছে এবারের হালনাগাদ ভোটার তালিকায় তরুণ ভোটার সংখ্যা আরও বাড়বে। কারণ বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমের আওতায় নতুন ভোটার যুক্ত হচ্ছেন একই সঙ্গে মৃতদের নাম বাদ দেওয়া হচ্ছে। 
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার জনকণ্ঠকে বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে তরুণরাই সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং একটি ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটিয়েছে। বুলেটের সামনে আবু সাঈদসহ যারা বুক পেতে দিয়ে শহীদ হয়েছেন তারা বয়সে সবাই তরুণ।

সংগ্রামে বেঁচে থাকা তরুণরাই সংস্কারের কথা বলছে, পবিবর্তনের কথা বলছে। মধ্যবয়স্ক এবং সিনিয়র নাগরিকরা তাদের সমর্থন দিয়েছে। ফলে সংস্কারের কাজ চলমান রয়েছে। আগামীর বাংলাদেশেও তরুণরাই হবে ফ্যাক্টর। তাদের বাদ দিয়ে দেশ চালানো কঠিন হবে। 

তরুণরা চায় একটি সুন্দর বাংলাদেশ। তারা পৃথিবীকে দেখছে এবং শিখছে। ফলে তারা আর বাংলাদেশকে পিছিয়ে পড়া ভূ-খ- দেখতে চায় না। যারা তাদের মেজাজ বুঝতে তারাই তরুণদের সমর্থন পাবে বলে আমি বিশ^াস করি। শেখ হাসিনার মতো ভুল করলেই আবার তরুণরাই মাঠে নেমে পড়বে। সুতরাং তরুণদের নিয়ে আমরা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে আশাবাদী ।

তিনি বলেন, ১০ শতাংশ ভোটে জয় পরাজয় নির্ধারিত হয়। আর তরুণ ভোটার ২৫ শতাংশের মতো। সুতরাং আগামী নির্বাচনেও তরুণদের ওপর নির্ভর করতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। তরুণদের যাতে কাছে টানা যায় সে কৌশল অবলম্বন করেই এগিয়ে যেতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। 

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী কাউসার আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা বর্তমানে হতাশ। আমরা সংস্কার চাই কিন্তু কাক্সিক্ষত সংস্কার হচ্ছে না। বাংলাদেশে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন করতে না পারলে তরুণরা আবার মাঠে নেমে পড়বে। আমরা প্রস্তুত আছি।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সৈয়দ মকবুল হোসেন কলেজের শিক্ষার্থী মেহেদি হাসান সাগর বলেন, আমরা তরুণরা এদেশে আইনের শাসন চাই। কোন বৈষম্য, অন্যায় আমরা চাই না। তরুণরা জেগেছে এবং তারা জেগেই থাকবে। যে কোনো অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে আবার প্রয়োজনে মাঠে নামব।

তরুণদের কাছে টানতে তৎপর ছাত্র সংগঠনগুলো ॥ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন বলেন, আমরা তরুণদের মধ্যে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আদর্শ তুলে ধরছি। দেশ গঠনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বার্তা পৌঁছে দিচ্ছি। তারেক রহমান নিজেও পরিবর্তন চান যা তরুণরা চায়।

এ ছাড়া ছাত্রদলের পক্ষ থেকে ছাত্রবান্ধব কর্মসূচি-মেধাবী ও গরিব ছাত্রদের পাশে দাঁড়ানো, শিক্ষাঙ্গনে পড়াশোনার পরিবেশ নিশ্চিত করাসহ নানান কাজ করে যাচ্ছি। শিক্ষাঙ্গনে কোনো সন্ত্রাসী কার্যকলাপ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল প্রতিহত করবে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় ছাত্রদলের সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করবে। 
ইসলামী ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় শাখার সভাপতি এস এম ফরহাদ বলেন, ছাত্রশিবির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজ করছে। তরুণদের সম্পদে পরিণত করাই ইসলামী ছাত্র শিবিরের কাজ। এ জন্য শিবির কখনো তার কর্মীদের অসামাজিক কার্যকলাপে সম্পৃক্ত হতে দেয় না। আগামীর বাংলাদেশে তরুণদের ভূমিকা থাকবে অনেক। তাই আমরা শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায়ে কাজ করছি। শিক্ষার জন্য, তরুণদের জন্য যা কিছু কল্যাণকর তাই আমরা করছি। আশা করি তরুণরা আমাদের সঙ্গেই থাকবেন।  

রাজনৈতিক দলগুলোতে তরুণ প্রার্থীদের প্রাধান্য ॥ বিএনপির নির্বাচনী সেলের সঙ্গে সম্পৃক্তরা জানান, এবারের নির্বাচনে তারা অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতাদের একটু বেশি প্রাধান্য দেওয়া হতে পারে। যারা বিগত দিনের আন্দোলন-সংগ্রামে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিলেন, এলাকায় পরিচ্ছন্ন অবস্থান রয়েছে, বিগত দিনে মামলা-হামলায় নির্যাতিত হয়েছেন, নেতাকর্মীদের পাশে ছিলেন, দলের প্রতি শতভাগ আনুগত্য ছিলেন তারা এবারের মনোনয়ন নির্বাচনে অনেক বেশি এগিয়ে থাকবেন।

এদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও ইতোমধ্যেই অনেক তরুণ প্রার্থীকে বাছাই করেছেন আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য।

রাজনৈতিক দলগুলো মনে করেন, বিপুলসংখ্যক তরুণকে কাছে টানতে হলে যত বেশি সম্ভব তরুণ প্রার্থী দরকার। কারণ বর্তমানে তরুণদের মানসিকতা আগের চেয়ে ভিন্ন। তারা তরুণ প্রজন্মের লোকদেরই রাষ্ট্র পরিচালনায় দেখতে চায়। 
এ ছাড়া জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)’র প্রায় সব প্রার্থীই হবে তরুণ। জুলাই অভ্যুত্থানের পুরোটা সময়ই তারা তরুণদের নেতৃত্বে ছিল। তরুণদের মধ্যে তাদের সেই জনপ্রিয়তার ধরে রাখতে পারলে তারা আগামী নির্বাচনে ভালো করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

এদিকে গণঅধিকার পরিষদও অনেকটা তারুণ্যনির্ভর দল। তাদের বেশিরভাগ প্রার্থীও তরুণ। তবে এসব তরুণ দলগুলোকে তাদের সম বয়সী কিংবা সমসাময়িক তরুণদের মানসিকতা বুঝে কাজ না করলে তরুণদের সমর্থন নাও পেতে পারেন।