Image description
সনদের ভবিষ্যৎ শঙ্কায় ♦ ১. নোট অব ডিসেন্টসহ পূর্ণাঙ্গ জাতীয় সনদ তৈরি ♦ ২. সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষর আদায় ♦ ৩. ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলোর বাস্তবায়ন

এ মুহূর্তে তিন চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়িয়ে আছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এগুলো হচ্ছে নোট অব ডিসেন্টসহ পূর্ণাঙ্গ জাতীয় সনদ তৈরি করা, ওই সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষর নেওয়া ও ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলোর বাস্তবায়ন কীভাবে হবে সেটা। রাজনীতিবিদরা এ তিন চ্যালেঞ্জের জন্য জুলাই সনদের সাফল্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। প্রশ্ন তুলছেন সনদের ভবিষ্যৎ নিয়ে।

ঐকমত্য কমিশনের বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিয়ে এরই মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে উষ্মা প্রকাশ করা হয়েছে। কোনো দল মামলার হুমকি, কোনো দল রাজপথে নামার হুমকি আবার কোনো দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করার ইঙ্গিত দিয়েছে। সংলাপে অংশ নেওয়া দলগুলো এখন মোটা দাগে তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একটিতে রয়েছে বিএনপি, আরেকটিতে জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), অপরটিতে রয়েছে বাম ঘরানা ও ইসলামপন্থি দলগুলো। কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের মতে, ঐক্যের পরিবর্তে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন চতুরতার সঙ্গে বিভেদ তৈরি করেছে। আগামী দিনগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজপথে নামার ইস্যু তুলে দিয়েছে। কোনো কোনো দল আরেকটি বিপ্লবের বার্তা দিয়েছে। সব মিলিয়ে জুলাই সনদ ঘিরে তৈরি হয়েছে এক ধরনের হতাশা ও অনিশ্চয়তা।

৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে ২৩টি সেশনে ১৯টি বিষয় নিয়ে আলোচনা শেষে ১৯টি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে বলে কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। তবে এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর নানা প্রশ্ন রয়েছে। তাদের দাবি, কমিশন এক প্রকার জোর করে ঐকমত্য হয়েছে বলে চাপিয়ে দিচ্ছে। কারণ মৌলিক অনেক ইস্যুতে দলগুলো তাদের অবস্থান থেকে বিরোধিতা করেছে, নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে, সুনির্দিষ্ট ইস্যুতে আলোচনা বয়কট করেছে, ওয়াকআউট করেছে। দলগুলোর প্রশ্ন- এরপর সেসব বিষয়ে কীভাবে ঐকমত্য হয়।

যে ১৯টি বিষয়ের ওপর আলোচনা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭০, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব, নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা সম্পর্কিত বিধান, বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ-(ক), সুপ্রিম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ (খ), উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালতের সম্প্রসারণ, জরুরি অবস্থা ঘোষণা, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, সংবিধান সংশোধন, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান, নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান সম্পর্কিত, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল, পুলিশ কমিশন গঠনসংক্রান্ত প্রস্তাব, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব (সংখ্যা বৃদ্ধি, নির্বাচন পদ্ধতি ইত্যাদি), দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট (উচ্চকক্ষের গঠন, সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি, এখতিয়ার ইত্যাদি), রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, ইলেকটোরাল কলেজ ইত্যাদি, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব [অনুচ্ছেদ ৪৮/৩, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ সম্পর্কিত প্রস্তাব ও রাষ্ট্রের মূলনীতি।

এসব বিষয়ের মধ্যে ১০টিতে বিএনপিসহ কয়েকটি দলের নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে অর্থবিল ও আস্থা ভোটের সঙ্গে সংবিধান সংশোধন ও জাতীয় নিরাপত্তা (যুদ্ধ পরিস্থিতি) যুক্ত করার মধ্যে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে কয়েকটি দল। বিচার বিভাগীয় বিকেন্দ্রীকরণ এবং সুপ্রিম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়ে বিএনপি উচ্চ আদালতের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে রাখার প্রশ্নে তিন-চতুর্থাংশ দল ও জোট একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী ও দলীয়প্রধান হতে পারবেন না বলে একমত হয়। বিএনপিসহ কয়েকটি দল এ বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। সরকারি কর্ম কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান সংবিধানে সংযোজন না করে সংশ্লিষ্ট আইনসমূহে প্রয়োজনীয় সংশোধনের মাধ্যমে নিশ্চিত করার বিষয়ে মতামত প্রদান করে বিএনপি নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে।

এ ছাড়াও সমমনা জোট, ১২-দলীয় জোট, এনডিএম এবং আম-জনতার দল নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। উচ্চকক্ষ গঠনের বিষয়ে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি দল ও জোট একমত হয়েছে। ৫টি দল (বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, আম-জনতার দল) উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতির বিষয়ে অন্য সব দল একমত হলেও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব বিষয়ে কমিশন কর্তৃক উত্থাপিত প্রস্তাবে বিএনপি, জাতীয়তাবাদী সমমনা দল, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি এবং জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন ক্রমিক ৫ এবং ৬-এ এবং নাগরিক ঐক্য ক্রমিক ৫-এ নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রস্তাবের ভিত্তিতে কমিশন কর্তৃক উত্থাপিত সমন্বিত প্রস্তাবের ক্রমিক ৮, ৯, ১১ এবং ১২-এর বিষয়ে বিএনপিসহ কয়েকটি দল ও জোট নোট অব ডিসেন্ট দেয়। সর্বশেষ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির বিষয়ে গণফোরাম, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী), বাসদ, বাংলাদেশ জাসদ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি এবং জেএসডি নোট অব ডিসেন্ট দেওয়ার পাশাপাশি সংলাপ বর্জন করে। এর বাইরে সবচেয়ে বেশি নোট অব ডিসেন্ট দেওয়া হয়েছে নারী প্রতিনিধিত্ব নিয়ে। কমিশন জানিয়েছে, জাতীয় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব ক্রমান্বয়ে ১০০ আসনে উন্নীত করা হবে-এ বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত। তবে কোনো কোনো দল সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে এবং কোনো কোনো দল সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে সংরক্ষিত নারী আসনে নির্বাচনের পক্ষে।

আলোচনায় কোনোরকম সুস্পষ্ট ঐকমত্য না হওয়ায় কয়েকটি বিষয়ে কমিশনকে সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়া হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, উচ্চকক্ষ ও রাষ্ট্রীয় মূলনীতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়। কমিশনের ওই সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়। সংলাপের শেষ দিকে এসে দলগুলোর পক্ষ থেকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। কোন প্রক্রিয়ায় বা কীসের ভিত্তিতে সনদ বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে নানা মন্তব্য করছে রাজনৈতিক দলগুলো। জামায়াত, এনসিপিসহ সমমনা দলগুলো জুলাই সনদের জন্য এখন আইনি ভিত্তি চাচ্ছে। তারা বলছেন, যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হচ্ছে তা নিয়ে তৈরি হবে জুলাই সনদ আর এতে আমাদের স্বাক্ষর করার কথা। কিন্তু কীসের ভিত্তিতে স্বাক্ষর করব। অন্যদিকে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো এর বিরোধিতা করছে। সংলাপে অংশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে এ প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। কিন্তু কমিশন এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো জবাব দিতে পারেনি। সংস্কারের প্রস্তাবগুলোর আইনগত ভিত্তি না থাকলে তা বাস্তবায়নযোগ্য হবে না বলে জানিয়েছেন জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তিনি বলেন, জনগণের কাছে এর কোনো মূল্য থাকবে না। এমন প্রস্তাবে সই করে লাভ কী? এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, জুলাই সনদকে যদি আমরা একটা আইনি ভিত্তির জায়গায় নিয়ে আসতে না পারি, সেক্ষেত্রে সেই জুলাই সনদ সেটা পূর্বেকার মতো তিন দলের রূপরেখার (’৯১ সালের ঘটনা) মতো শুধু একটা ইতিহাসের দলিল হয়ে থাকবে। যার কোনো কার্যকারিতার জায়গা থাকবে না। আমরা একটা অকার্যকর অপূর্ণাঙ্গ মৌলিক সংস্কারবিহীন জুলাই সনদ চাই না। অন্যদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, পূর্ণাঙ্গ সনদ পেলে স্বাক্ষর করবে বিএনপি। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন জায়গা হবে আগামী জাতীয় সংসদ। বিভিন্ন অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাব বর্তমান সময়েই কার্যকর হয়ে যাবে। এসব প্রসঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা ধাপে ধাপে এগোচ্ছি। ভবিষ্যৎই বলে দেবে সামনের পথ কী হবে। কেমন হবে। কীভাবে এগোব আমরা।