Image description
আমাদের উচ্চশিক্ষাব্যবস্থাকে বিশ্বমানের করে তুলতে এবং দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একটি শক্তিশালী অবস্থান দিতে কিছু কাঠামোগত এবং নীতিগত পরিবর্তনের প্রয়োজন। আমার এই প্রস্তাবনায় মূলত শিক্ষাদান, গবেষণা এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
১. কাঠামোগত ও প্রশাসনিক সংস্কার:
প্রথমেই, বাংলাদেশের প্রধান তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়—ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে 'গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়' হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। এতে, এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সাধারণ শিক্ষার সাথে সাথে গভীরতর গবেষণা এবং নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারবে।
প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন উপাচার্য (ভাইস চ্যান্সেলর) এবং চারজন উপ-উপাচার্য (প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর) নিয়োগের সুপারিশ করা হচ্ছে। তাঁদের দায়িত্বগুলো হবে সুনির্দিষ্ট:
প্রথম প্রো-ভিসি (একাডেমিক): ইনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক শিক্ষা কার্যক্রম, পাঠ্যক্রমের আধুনিকীকরণ, এবং পরীক্ষা পদ্ধতির মানোন্নয়নের দায়িত্বে থাকবেন।
দ্বিতীয় প্রো-ভিসি (উন্নয়ন): ইনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো, ছাত্র-শিক্ষক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওয়েলফেয়ার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌত কাঠামোর প্রসারের দেখভাল করবেন।
তৃতীয় প্রো-ভিসি (গবেষণা ও উদ্ভাবন): গবেষণা প্রকল্প, উদ্ভাবনী উদ্যোগ, এবং গবেষকদের প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের জন্য ইনি দায়বদ্ধ থাকবেন।
চতুর্থ প্রো-ভিসি (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক): বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে সম্পর্ক স্থাপন, আন্তর্জাতিক সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, কনফারেন্স ইত্যাদি আয়োজন, বিশ্বের বিভিন্ন ফান্ডিং এজেন্সির সাথে যোগাযোগ স্থাপন, টেকনোলজি ট্রান্সফার এবং সর্বোপরি শিক্ষার্থীদের বৈশ্বিক সুযোগ-সুবিধা তৈরিতে কাজ করবেন।
উপাচার্যের মূল কাজ হবে এই চারটি বিভাগের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তহবিল সংগ্রহ ও সহযোগিতা নিশ্চিত করতে সরকার, দাতা সংস্থা, এবং প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা এবং তাদের সকলকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে সম্পৃক্ত করা।
২. শিক্ষকের ভূমিকা ও গবেষণা কার্যক্রমের পুনর্বিন্যাস
শিক্ষকদের কর্মপরিবেশকে আরও কার্যকর করতে তাঁদের তিনটি ভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে:
টিচিং ট্র্যাক: এই ট্র্যাকের শিক্ষকরা মূলত স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষাদান এবং পরীক্ষা ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করবেন। যেসব শিক্ষকের গবেষণায় আগ্রহ বা অভিজ্ঞতা কম, তাঁদের এই শ্রেণিতে রাখা যেতে পারে।
রিসার্চ ট্র্যাক: এই ট্র্যাকের শিক্ষকরা কেবল গবেষণা, উদ্ভাবন এবং উচ্চতর জ্ঞান সৃষ্টিতে নিয়োজিত থাকবেন। পিএইচডি বা পোস্টডক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন তরুণ শিক্ষকদের এই ট্র্যাকে অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে। এঁরা প্রো-ভিসি (গবেষণা ও উদ্ভাবন)-এর অধীনে কাজ করবেন।
মিক্সড ট্র্যাক: এই ট্র্যাকের শিক্ষকরা শিক্ষাদান এবং গবেষণা—উভয় ক্ষেত্রেই সমানভাবে অবদান রাখবেন।
এই ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি, একটি নতুন 'ফ্যাকাল্টি অফ গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজ' চালুর প্রস্তাব করা হচ্ছে। এই ফ্যাকাল্টির অধীনে স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীরা ভর্তি হবে এবং তাদের জন্য আকর্ষণীয় স্কলারশিপের ব্যবস্থা করতে হবে। রিসার্চ ট্র্যাকের শিক্ষকরা এসব শিক্ষার্থীদের গবেষণার তত্ত্বাবধান করবেন।
৩. গবেষণা অবকাঠামো ও তহবিল ব্যবস্থাপনা:
গবেষণাকে গতিশীল করতে সরকারি বা আন্তর্জাতিক অনুদানের মতো বড় তহবিলগুলো যেমন 'হিট প্রজেক্ট' সরাসরি প্রো-ভিসি (গবেষণা ও উদ্ভাবন)-এর তত্ত্বাবধানে বরাদ্দ করা হবে। এই তহবিল থেকে
প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ন্যূনতম একটি অত্যাধুনিক 'হাই পারফরম্যান্স কম্পিউটেশনাল সেন্টার' এবং অন্যান্য মৌলিক গবেষণার যন্ত্রপাতি ক্রয় করতে হবে । প্রতিটি যন্ত্র পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষিত অপারেটর নিয়োগ দিতে হবে। রিসার্চ ট্র্যাকের শিক্ষকরা ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীরা অনলাইনে সময়সূচি বুক করে এবং ন্যূনতম ফি দিয়ে এসব সুবিধা ব্যবহার করতে পারবেন।
প্রতিজন রিসার্চ ট্র্যাকের শিক্ষককে তাদের গবেষণা শুরু করার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ 'সিড ফান্ডিং' প্রদান করতে হবে।
৪. শিল্প-একাডেমিয়া সংযোগ স্থাপন:
দেশের শিল্প ও গবেষণা খাতের মধ্যে দূরত্ব কমাতে বিভিন্ন এডভান্সড এবং যুগোপযোগী শিল্প থেকে অভিজ্ঞ পেশাদারদেরকে 'অ্যাডজাঙ্কট প্রফেসর' হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। তাঁরা খন্ডকালীন লেকচার প্রদান এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিল্পজগতের বাস্তব চাহিদা সম্পর্কে অবহিত করবেন, যা প্রায়োগিক গবেষণার পরিধি বাড়াবে এবং দেশের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
এই প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়ন করা হলে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুধু শিক্ষার কেন্দ্র নয়, বরং বিশ্বমানের গবেষণা ও উদ্ভাবনের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হবে।
 
 
--------------------------------
-ড. মইন খন্দকার