Image description

চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলার উপাদি দক্ষিণ ইউনিয়নের মাস্টার বাজার এলাকার পিংড়া গ্রামের গাজী বাড়ির প্রবাসী আব্দুল মালেক গাজীর ছেলে শহীদ আব্দুর রহমান গাজী। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত চাঁদপুরে পড়াশোনা করলেও স্নাতক পড়ার জন্য ঢাকায় চলে যান তিনি।

বিবিএস শ্রেণিতে পড়তেন নারায়ণগঞ্জ সরকারি তুলারাম কলেজে। তিনি ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর বিজয় মিছিলে গিয়ে রাজধানীর শ্যামপুর এলাকায় দুপুর ১টার দিকে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন।

 

শহীদ আব্দুর রহমানের জন্ম ২০০১ সালের ২৩ অক্টোবর। রহমান যখনই বাড়িতে আসতেন মায়ের সঙ্গে নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে গল্প করতেন। বাবা প্রবাসী হওয়ার কারণে মায়ের কাছে ছিল সব আবদার।

সম্প্রতি শহীদ আব্দুর রহমানের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় স্বজনদের সঙ্গে। রহমানের বাবা আব্দুল মালেক গাজী দীর্ঘ বছর সৌদি প্রবাসী। ছেলে শহীদ হওয়ার কথা জেনেও কর্মসংস্থান হারানোর শঙ্কায় দেশে আসতে পারেননি।

স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শহীদ আব্দুর রহমানসহ দুই ভাই ও দুই বোন। সবার বড় বোন পান্না বেগম (২৬) বিয়ে হয়েছে। বোন জামাতা মো. শাহানুর বকাউল। তিনি সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক মৌচাক শাখায় অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। দ্বিতীয় শহীদ আবদুর রহমান। তৃতীয় আব্দুল্লাহ স্থানীয় দিঘলদী মাদরাসায় দশম শ্রেণিতে পড়ে ও চতুর্থ বোন জান্নাত। বয়স ৯। স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে।

আব্দুর রহমান পিংড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি, হযরত শাহজালাল উচ্চ বিদ্যালয়ে এসএসসি এবং শহরের বাবুরহাট স্কুল ও কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর স্নাতক শ্রেণিতে পড়ার জন্য চলে যান ঢাকায়। সেখানে শ্যামপুর বোনের বাসায় থেকে নারায়ণগঞ্জ সরকারি তুলারাম কলেজে পড়তেন।

শহীদ আব্দুর রহমানের ফুফাত ভাই হানিফ মিজি বলেন, আমি নিজেও ঢাকায় থাকি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিয়মিত অংশগ্রহণ করেছি। কিন্তু আবদুর রহমানের বিষয়ে জানতামনা। সে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আমরা জানতে পেরেছি। শেখ হাসিনার পতনের পর যাত্রাবাড়ী এরাকায় বিজয় মিছিলে গিয়ে রহমান গুলিবিদ্ধ হয়। তবে সে পরিবারের কাউকে মিছিলে যাওয়ার কথা জানায়নি।

আব্দুর রহমানের বোন জামাতা শাহানুর বকাউল বলেন, দেশের অবস্থা উত্তপ্ত থাকার কারণে ওইদিন আমি নিজ বাসায় ছিলাম। আবদুর রহমান কলেজে ভর্তি হওয়ার পর আমাদের বাসায় বেশি থাকতো। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৫ আগস্ট দুপুরে ১২টা থেকে ১টার মধ্যে সে যাত্রাবাড়ী থানার বিপরীত এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়।

তিনি আরও বলেন, ওইদিন দুপুরে কিছু লোক যাত্রাবাড়ী আমাদের বাসার নিচে আসেন এবং আব্দুর রহমানের বাসা কোনটি খোঁজ করেন। ওই সময় বাসার গেট বন্ধ ছিল। আমি নিজে গিয়ে লোকজনের সঙ্গে কথা বলি। তারা বলেন, আমরা ফেসবুকে দেখেছি আব্দুর রহমান গুলিবিদ্ধ হয়েছে এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আছে। পরে সন্ধ্যা ৭টার দিকে আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে তার লাশ পাই। এর আগে সে যাত্রাবাড়ী থানার বিপরীতে গুলিবিদ্ধ হয়। সেখান থেকে তার সহপাঠীরা উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। ৫ আগস্টের পর আমরা ফেসবুকে একাধিক ভিডিওতে দেখেছি ওই সময় পুলিশ কীভাবে গুলি চালিয়েছে এবং অনেকেই তখন শহীদ হন। ওই শহীদদের সঙ্গেই ছিল আব্দুর রহমান।

শাহানুর বকাউল বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে রাতেই তার লাশ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। ৬ আগস্ট বাড়িতে নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে আব্দুর রহমানকে দাফন করা হয়। তার নামাজে জানাজায় ইমামতি করেন ছোট ভাই মো. আব্দুল্লাহ।

আব্দুর রহমানের বোন পান্না বেগম বলেন, ৫ আগস্ট সকাল ৯টার দিকে রহমান বাসা থেকে বের হয়। তবে সে মিছিলে যাবে এমন কিছু বলেনি। আমি তাকে বারবার সতর্ক করেছি ভাই তুমি কোনো মিছিলে যাবে না। কিন্তু আমার কথা কর্ণপাত করেনি। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর বেশিরভাগ সময় আমার কাছে থেকেছে। আব্দুর রহমান বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়া এবং গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হওয়ার বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন বোন পান্না।

শহীদ আব্দুর রহমানের মা পরভীন ছেলের স্মৃতি ও গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হওয়ার কথা বলতে গিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, শহীদ হওয়ার প্রায় ১৫ দিন আগে আমার সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয়। আমাকে রহমান বলেছে মা আমি বাড়িতে আসবো। তোমাদের বাজার করে দিয়ে যাব। তার বাবাই তাকে বলেছে বাড়িতে আসার জন্য। কিন্তু ছেলে বাড়িতে এসেছে আল্লাহর মেহমান হয়ে।

এই শহীদের মা বলেন, আবদুর রহমান ঈদুল আজহার সময় সর্বশেষ যখন বাড়িতে এসেছে তখন অনেক স্বপ্নের কথা আমার সঙ্গে বলে। বলে মা-আমি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়েছি, গাড়ির ড্রাইভিং শিখেছি। আগেই পাসপোর্ট করে রেখেছি। ড্রাইভিং শিখতে গিয়ে ওই প্রতিষ্ঠান আমাকে ভালো ড্রাইভিং শেখার কারণে ৫ হাজার টাকা পুরস্কার দিয়েছে। ওই টাকা মায়ের কাছে রেখে যায় আব্দুর রহমান। এই টাকার সঙ্গে আরো যোগ করে ড্রাইভিং লাইসেন্স করবে। এরপর বিদেশে গিয়ে ভালো চাকরি করবে। কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে আমার কাছে আবদার করতো।

তিনি বলেন, ছেলে শহীদ হওয়ার পরে জামায়াতের পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা, মতলব দক্ষিণ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা ও কিছু ফল দিয়েছে। এরপর জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা, জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকা ও সর্বশেষ জুলাই মাসে জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র পেয়েছি।

পারভীন বেগম বলেন, আমার স্বামী প্রবাসী। যে কারণে ঢাকায় আমার মেয়ের জামাতাসহ জামায়াতে ইসলামী নেতা হাবিবুর রহমানের সহযোগিতায় ছেলে হত্যার বিচার দাবি করে ট্রাইব্যুনালে আবেদন করেছি।