Image description
অগ্নিঝরা জুলাই

আমার সন্তানসহ অন্যদের স্বপ্ন ছিল বৈষম্যহীন দেশ গড়ার। এ স্বপ্ন নিয়ে সেদিন তারা বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়েছিল। কিন্তু জুলাই ফিরে এলেও তাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। একজন শহীদের বাবা হিসেবে এখানেই আমার কষ্ট। এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন গণ-অভ্যুত্থানে নিহত ২০ বছর বয়সী ইমতিয়াজ আহমেদ জাবিরের পিতা। 

ইমতিয়াজ ঢাকার সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির বিবিএ’র শিক্ষার্থী ছিলেন। গত বছরের ১৯শে জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রামপুরায় গুলিবিদ্ধ হন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউ’তে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭ দিন পর মারা যান তিনি। দুই ভাইবোনের মধ্যে ইমতিয়াজ ছিলেন বড়। তার বাবা নওশের আলী কৃষিকাজ করেন। তাদের গ্রামের বাড়ি যশোরের ঝিকরগাছায়। বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণে ঢাকায় এসেছিলেন জাবির। কিন্তু, সেই স্বপ্ন নিভে গেছে চিরতরে। সন্তানের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছেন এই বাবা-মা। একমাত্র ভাইকে হারিয়ে স্তব্ধ বোন। বাবা-মায়ের কষ্ট লাঘবে হাল ধরতে চেয়েছিলেন ইমতিয়াজ।

শহীদ ইমতিয়াজের বাবা নওশের আলী মানবজমিনকে বলেন, দুঃখের বিষয় হলো, তাদের প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে না। শহীদেরা চেয়েছিল শোষণমুক্ত বাংলাদেশ, যেখানে কোনো কলহ থাকবে না, সবার অধিকার থাকবে। শহীদেরা পথ দেখিয়ে গেছে, বর্তমান প্রজন্ম যদি সেই পথে না যায়, তাহলে কিছু করার নেই। তাদের দেখানো পথ কেউ অনুসরণ করছে না। একজন শহীদের বাবা হিসেবে আমার খুব কষ্ট হয়। এতগুলো জীবন আত্মাহুতি দিলো কিন্তু তাদের চাওয়াটা পূরণ হলো না। রাজপথে মানুষ দিনেদুপুরে খুনের শিকার হচ্ছে, ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছে, চাঁদাবাজির কবলে পড়ছে। আহত এবং শহীদদের- কারোরই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। আগের মতো এখনো চলছে। বিচার ব্যবস্থার তো কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। আজ এক বছর হয়ে গেল আমার সন্তানের হত্যাকারীদের বিচার হচ্ছে না। ছাত্ররা বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠন করার জন্য আন্দোলনের ডাক দিয়ে রাজপথে ছিল, সেই ছাত্ররাই এখন বিতর্কিত। তারা নিজেদের স্বার্থে দলীয় প্ল্যাটফরমে চলে গেছে। তারা যদি আজ সেই ছাত্র হিসেবেই থাকতো, তাহলে আমার মনে হয় ভালো হতো। কিছু হোক না হোক, দেশের রাজনৈতিক দলগুলো একটু হলেও ভাবতো ছাত্ররা এখনো সচেতন রয়েছে।

তিনি বলেন, আমি কৃষিকাজ করলেও আমার স্বপ্ন ছিল ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলবো। ইমতিয়াজ ও আমাদের স্বপ্ন ছিল- আমেরিকায় পড়াশোনা করবে, প্রতিষ্ঠিত হয়ে অভাব দূর করবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল। অল্প বয়সে আমাদের রেখে চিরতরে চলে গেল। ও খুব মেধাবী ছিল। সারাক্ষণ পড়াশোনা ছাড়া কিছুই বুঝতো না। যশোর আকিজ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে ঢাকায় এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল। আমার স্ত্রী ও একমাত্র মেয়েকে নিয়ে আমরা যশোর থাকি। ইমতিয়াজ বনশ্রীতে একটি হোস্টেলে থাকতো।

সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, গত বছরের ১৯শে জুলাই শুক্রবার বিকাল ৩টার দিকে গুলিবিদ্ধ হয় ইমতিয়াজ। সেদিন একটা মিছিল নিয়ে বেরিয়েছিল শিক্ষার্থীরা। এ সময় গুলিবিদ্ধ হলে সেখানে থাকা অন্য শিক্ষার্থীরা তাকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। বিকাল ৪টার দিকে তারা আমাকে ফোন করে খবর জানায়। ঢাকায় পৌঁছাই রাত দুইটায়। প্রথমে মুগদা মেডিকেলে গিয়ে সেখানে না পেয়ে শ্যামলীর হৃদরোগ হাসপাতালে যাই। ওই হাসপাতালে তিনদিন পর জ্ঞান ফিরে। একটি অপারেশনও হয় এবং পা কাটার সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসকরা। তখন কোনো প্রাইভেট হাসপাতালে রোগী ভর্তি নেয়নি। পরে আমাদের ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়। সেখানে ভর্তির তিনদিন পর ওর অবস্থা খারাপ হতে থাকে। চিকিৎসক ডায়ালাইসিস করার কথা বলেছিলেন, আমরাও করতে বলেছিলাম। কিন্তু যখন ডায়ালাইসিস করার কথা ছিল, তখন করেননি। ইমতিয়াজকে ১৭ ব্যাগ রক্ত দেয়া হয়েছিল। যেখানে আড়াই ঘণ্টা ডায়ালাইসিস করার কথা ছিল, সেখানে মাত্র আধাঘণ্টার মতো ডায়ালাইসিস করতে পেরেছিল। সাতদিনের মাথায় ২৬শে জুলাই ইমতিয়াজ মারা যায়। ঢাকা মেডিকেলে ময়নাতদন্ত শেষে গ্রামের বাড়ি যশোর ঝিকরগাছায় দাফন করা হয়। আমার ছেলের কোমরের নিচে ডান পায়ে দু’টি গুলি লাগে।

নওশের আলী বলেন, আমার দুই সন্তানের মধ্যে ইমতিয়াজ ছিল বড়। ২০১৮ সালে বাগ আঁচড়া হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করে। জিপিএ-৫ পেয়ে ২০২১ সালে এইচএসসি পাস করে। পরে ইমতিয়াজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে ২০২১-২২ শিক্ষা বর্ষে ঢাকার সাউথইস্ট ইউনির্ভাসিটিতে বিবিএ’তে ভর্তি হয়। আমার একমাত্র মেয়ে তার ভাই মারা যাওয়ার পর একদম ভেঙে পড়েছে। আমেরিকা যেতে না পারলে বিসিএস দেয়ার স্বপ্ন ছিল। সে পাসপোর্টও করেছিল। যেদিন গুলি লেগেছিল সেদিন দুপুর আড়াইটার দিকে তার সঙ্গে মোবাইলে কথা হয়েছিল। শেষ বাড়িতে এসেছিল কোরবানির ঈদে। ক্লাস শুরু হওয়ায় চার-পাঁচদিন থেকে ঢাকায় চলে যায়। ১৮ই জুলাই আন্দোলনে যাওয়ার কথা আমাদের বলিনি। শুনে আমি মন খারাপ করি। তখন ইমতিয়াজ বলেছিল, ‘আব্বু আর যাবো না, মন খারাপ করিও না।’ ঘটনার দিন শুক্রবারও যখন কথা হয়, সারা দেশে নেট বন্ধ থাকায় তাকে আরও সতর্ক করি। সে বনশ্রী-সি ব্লকে হোস্টেলে থাকতো, সেখানে কোনোদিনও আমরা যাইনি। আমাদের সঙ্গে না বলে পরেরদিন আবার আন্দোলনে চলে যায়। ওর বন্ধুরা বলেছিল, ইমতিয়াজের যখন গুলি লাগে, সে তখন জানতো না। যখন দেখে তার পোশাক ও রাস্তার পিচ রক্তে ভিজে যাচ্ছে, তখন সেটি দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। ছেলে যখন আইসিইউ’তে ছিল, তখন বলেছিল-‘বাবা আমি ঠিক আছি, তুমি চিন্তা করিও না। তোমার সব স্বপ্ন পূরণ করবো।’
সন্তানের স্মৃতিচারণ করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, এই শোক ভোলার মতো না। সন্তানের লাশের ভার বহন করা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ। আমার বাড়ি পুরো অন্ধকার হয়ে গেছে। সন্তানের চাহিদা মতো কিছু দিতে পারতাম না, তবে লেখাপড়াটা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। আমার আশা-ভরসা ছিল, এই দুই সন্তানকে নিয়ে। এখন ঘর জুড়ে শুধু ইমতিয়াজের স্মৃতি।