
প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা খরচের পরও ডুবছে চট্টগ্রাম নগর। গতকাল সোমবার ১০২ মিলিমিটার বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে বিভিন্ন এলাকা। ফলে সেই পুরোনো দুর্ভোগে পড়ে নগরবাসী। অথচ এর আগে চলতি বছরের ৩০ মে ১৯৪ মিলিমিটার বৃষ্টিতেও এমন জলাবদ্ধতা হয়নি।
এবারের জলাবদ্ধতার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নালা ও খালগুলো ভরাট হলেও ঠিকভাবে পরিষ্কার করা হয়নি। আর প্রকল্পের কাজগুলোতেও কিছু ত্রুটি রয়েছে। তবে মৌসুমের শুরুতে নগরের খাল ও নালাগুলো পরিষ্কার থাকায় জলাবদ্ধতা হয়নি।
জলাবদ্ধতা নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) কর্মকর্তারা প্রকৃতির ওপর দায় চাপিয়েছেন। তাঁদের দাবি, নালা ও খালগুলো পরিষ্কার আছে। গতবারের তুলনায় এবার বৃষ্টির তীব্রতা বেশি থাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় করণীয় নির্ধারণে আবার সভা করবেন।
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপটি গত শনিবার উপকূল অতিক্রম করেছে। তবে এখনো তার প্রভাব রয়েছে। এ ছাড়া মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় চট্টগ্রামে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। রোববার দুপুরে ১২টা থেকে সোমবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ১০২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। মঙ্গলবারও (আজ) ভারী বৃষ্টি হতে পারে।পতেঙ্গা আবহাওয়া কার্যালয়ের আবহাওয়াবিদ মাহমুদুল আলম
চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে সভা করা নতুন কিছু নয়। গত আট বছরে মন্ত্রণালয় ও সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে অন্তত ৩৪টি সভা হয়েছে। এ সময়ে চারটি প্রকল্পে খরচ হয়েছে ৯ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। এরপরও জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি মিলছে না নগরবাসীর। গত তিন বছরে ৩০ বার ডুবেছে চট্টগ্রাম নগর—গত বছর (২০২৪) ৬ বার, ২০২৩ সালে ১৪ বার ও ২০২২ সালে ১০ বার।
জানতে চাইলে পতেঙ্গা আবহাওয়া কার্যালয়ের আবহাওয়াবিদ মাহমুদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপটি গত শনিবার উপকূল অতিক্রম করেছে। তবে এখনো তার প্রভাব রয়েছে। এ ছাড়া মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় চট্টগ্রামে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। রোববার দুপুরে ১২টা থেকে সোমবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ১০২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। মঙ্গলবারও (আজ) ভারী বৃষ্টি হতে পারে।
৩৪ সভা ও ৯,৮৫২ কোটি টাকা খরচ
চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে সিডিএ দুটি, সিটি করপোরেশন একটি, পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এসব প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা। গত ৮ বছরে প্রকল্পগুলোর কাজে খরচ হয়েছে ৯ হাজার ৮৫২ কোটি ১৩ লাখ টাকা। সাত থেকে আট বছর ধরে এসব প্রকল্পের কাজ চললেও এখন পর্যন্ত নতুন খাল খননের পুরো কাজ, অন্তত ১৪টি জলকপাট (স্লুইসগেট), ১০টি খালের সংস্কার ও প্রশস্তকরণ, খালের ভেতরে বালুর ফাঁদ (সিল্টট্র্যাপ), নালার নির্মাণকাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি।
এই চারটি প্রকল্পের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৫ হাজার ৫৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ প্রকল্পটিতে। কর্ণফুলী নদীর তীরে রাস্তা ও জলকপাট নির্মাণে সিডিএর আরেকটি প্রকল্পে ব্যয় হয় ২ হাজার ৩২৮ কোটি ৫১ লাখ টাকা। সিটি করপোরেশন বহদ্দারহাটের বাড়ইপাড়া থেকে বলিরহাট পর্যন্ত নতুন খাল খননের কাজে খরচ করেছে ১ হাজার ২৭০ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা।
এসব সভায় নগরের পাহাড় কাটা বন্ধ করার বিষয়েও বারবার সিদ্ধান্ত হয়। কেননা পাহাড় কাটার পর বালু ও মাটিতে নালা ও খাল ভরাট হয়ে যায়। কিন্তু পাহাড় কাটা বন্ধ হয়নি।
গত আট বছরে অনুষ্ঠিত ৩৪টি সভায় অন্তত ২০০ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। মূলত ঘুরেফিরে একই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্তগুলো পুরোপুরি কার্যকর হয় না। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিল। এ সময় অনুষ্ঠিত ১০টি সভার অনেকগুলোয় সরকারের এক বা একাধিক উপদেষ্টা উপস্থিত ছিলেন। প্রকল্প এলাকাও পরিদর্শন করে দিয়েছিলেন নানা নির্দেশনা।
সভাগুলোয় সব ধরনের নালা-নর্দমা ও খাল পরিষ্কারের নির্দেশনা হয়। ৩৯টি জলকপাটের (স্লুইসগেট) মধ্যে মে মাসের মধ্যে অন্তত ২৭টি চালুর সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত হয়েছে ২৫টি। নগরের বাড়ইপাড়া খালের খননকাজ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করার সময় বেঁধে দেওয়া হয়। এখন এর কাজ চলছে। জলাবদ্ধতার হটস্পটগুলোয় পাম্পহাউস চালু করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তা হয়নি।
এসব সভায় নগরের পাহাড় কাটা বন্ধ করার বিষয়েও বারবার সিদ্ধান্ত হয়। কেননা পাহাড় কাটার পর বালু ও মাটিতে নালা ও খাল ভরাট হয়ে যায়। কিন্তু পাহাড় কাটা বন্ধ হয়নি।
হাঁটু থেকে কোমরপানি, দুর্ভোগ
ভারী বৃষ্টিতে গতকাল সকাল সাড়ে ৯টা থেকে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন এলাকায় এক থেকে চার ঘণ্টা পানি জমেছিল। পানি নামে বেলা দেড়টার দিকে। সরেজমিনে ও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরের প্রবর্তক মোড়, মুরাদপুরের শুলকবহর, চকবাজার কাঁচাবাজার, কাপাসগোলা, কাতালগঞ্জ, জিইসি মোড়, ঝাউতলা রেললাইন, আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকা, এম এম আলী সড়ক, হালিশহর, মোহরা, রিয়াজউদ্দিন বাজার, পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা, আগ্রাবাদের রঙ্গিপাড়া এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এসব এলাকার কোথাও হাঁটুসমান, কোথাও কোমরসমান পানি জমে। এসব এলাকার সড়ক, দোকানপাট, ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তলিয়ে যায়। জলাবদ্ধতায় অন্তত ১৫ শতাংশ এলাকা ডুবেছে বলে দাবি করেছেন সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রিয়াজউদ্দিন বাজারে গিয়ে দেখা যায়, দোকানি ও দোকানের কর্মচারীরা দোকানের ভেতর থেকে পানি পরিষ্কার করছিলেন। এটি নগরের অন্যতম বড় পাইকারি বাজার। এর অন্তত ১০০টি দোকানে পানি ঢুকে পড়ে।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে প্রবর্তক মোড়ে দেখা যায়, হাঁটুপানি জমে আছে মূল সড়কে। লোকজন রিকশায় চলাচল করছেন। আটকে ছিল অন্যান্য গাড়ি। একই দৃশ্য দেখা যায় শুলকবহরেও। এ ছাড়া দুপুর ১২টার দিকে কাতলগঞ্জ এলাকায় দেখা যায় সড়কে কোমরপানি। ডুবে গেছে বিভিন্ন ভবনের নিচতলা।
এসব এলাকার কোথাও হাঁটুসমান, কোথাও কোমরসমান পানি জমে। এসব এলাকার সড়ক, দোকানপাট, ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তলিয়ে যায়। জলাবদ্ধতায় অন্তত ১৫ শতাংশ এলাকা ডুবেছে বলে দাবি করেছেন সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা।
জলাবদ্ধতার কারণে গতকাল সকাল থেকে দুর্ভোগ নিয়ে চলাচল করতে হয়েছে নগরবাসীকে। ভারী বর্ষণ ও জলাবদ্ধতার কারণে সড়কে পরিবহনের সংখ্যা কমে যায়। এ সুযোগে যেসব গাড়ি ছিল তাদের চালকেরা বাড়তি ভাড়া হাঁকাতে থাকেন। নিরুপায় হয়ে বাড়তি ভাড়া দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে হয় যাত্রীদের। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছিল স্কুলগামী শিশু-কিশোর ও তাদের অভিভাবকেরা।
নগরের কাজীর দেউড়ি এলাকার বাসিন্দা ওমর ফারুক বলেন, তাঁর সন্তান পাঁচলাইশ এলাকার একটি স্কুলের ছাত্র। প্রতিদিন রিকশাভাড়া নেন ৬০ টাকায়। বৃষ্টির কারণে রিকশা পাননি। সিএনজিচালিত অটোরিকশা পেলেও ভাড়া নেয় ১৬০ টাকা। অথচ স্বাভাবিক সময়ে এ ভাড়া ১০০ টাকা। আবার বাচ্চাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে অফিসে যেতেও রিকশাভাড়া বাড়তি দিতে হয় ৩০ টাকা।
নগরের উত্তর কাট্টলীর বাসিন্দা শাহেদ ইসলাম বলেন, বাসা থেকে অফিসে আসার পথে তিন জায়গায় জলাবদ্ধতার কারণে আটকে গিয়েছিলেন। পরে সাত থেকে আট কিলোমিটার বাড়তি পথ ঘুরে অফিসে যেতে হয়। এতে এক ঘণ্টা দেরি হয়েছে।
চট্টগ্রামের খাল ও নালাগুলো পরিষ্কার করা হলেও ময়লা-আবর্জনা ফেলার কারণে তা অল্প সময়ের মধ্যে আবার ভরাট হয়ে যায়। তাই প্রথম দফা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা না হলেও এখন হচ্ছে। সামনেও হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার মজুমদার
পাল্টাপাল্টি দোষারোপ
সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস প্রথম আলোকে বলেন, সিডিএর আওতায় খালগুলো পরিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু নালা-নর্দমাগুলো ভরাট হয়ে আছে। এতে বৃষ্টির পানি খালে পৌঁছাতে না পারায় জলাবদ্ধতা হয়েছে। আর এখনো সব জলকপাটের কাজ শেষ না হওয়ায় জলাবদ্ধতা হচ্ছে। আর্থিক জটিলতায় বন্ধ থাকা হিজড়া খাল প্রশস্ত করার কাজ আগামী শুষ্ক মৌসুমে শুরু করবেন তাঁরা। এরপর আরও বেশি সুফল পাওয়া যাবে।
তবে সিটি করপোরেশনের উপপ্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা প্রণব কুমার শর্মা দাবি করেছেন, নালা-নর্দমা পরিষ্কার থাকলেও বৃষ্টির তীব্রতা বেশি থাকায় পানি দ্রুত সরতে পারেনি। এতে জলাবদ্ধতা হয়েছে। সিডিএ হিজড়া খালের কাজ না করার কারণেও আশপাশের অনেক এলাকায় জলাবদ্ধতা হচ্ছে।
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, জলাবদ্ধতা প্রকল্পগুলোয় কিছু ত্রুটি রয়ে গেছে। পানির ধারণের জন্য জলাধার রাখা হলেও পরে তা বাদ দেওয়া হয়েছে। আবার যেসব কাজ হয়ে গেছে, তা ঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের প্রস্তুতি নেই। চট্টগ্রামের খাল ও নালাগুলো পরিষ্কার করা হলেও ময়লা-আবর্জনা ফেলার কারণে তা অল্প সময়ের মধ্যে আবার ভরাট হয়ে যায়। তাই প্রথম দফা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা না হলেও এখন হচ্ছে। সামনেও হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।