Image description

নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার তিস্তা নদী যেন এখন এক ‘সোনার খনি’। আর সেই খনির পাহারাদার একদল প্রভাবশালী পাথরখেকো সিন্ডিকেট। নদীর বুক চিরে প্রতিদিন উত্তোলন হচ্ছে হাজার হাজার ঘনফুট পাথর, যা উত্তোলন হচ্ছে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নৌকা ও লোহার তৈরি যন্ত্রপাতির মাধ্যমে। এসব কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যেই ঘটছে প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের চোখের সামনে, কিন্তু নেই কার্যকর কোনো প্রতিরোধ। নেই পর্যাপ্ত আইন প্রয়োগের দৃশ্যমান ব্যবস্থা।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বাইশপুকুর, চরখড়িবাড়ি, একতা বাজার, তেলির বাজার, তিস্তা বাজার, কালিগঞ্জ, ছোটখাতা গ্রোয়েন বাঁধ ও ডালিয়া বাজারসহ অন্তত ১৫-২০টি স্থানে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট প্রতিদিন নদী খুঁড়ে পাথর তুলছে। ব্যবহৃত হচ্ছে প্রায় ৩০-৪০টি যান্ত্রিক নৌকা, যেগুলো প্রতিদিন গড়ে ৬০০-১,০০০ ঘনফুট পর্যন্ত পাথর উত্তোলন করছে। এতে দৈনিক উত্তোলিত পাথরের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে প্রায় ২৫,০০০ ঘনফুটের ঊর্ধ্বে, যার বাজারমূল্য আনুমানিক ১৫-২০ লাখ টাকা।

সিন্ডিকেট প্রতি ঘনফুট পাথর শ্রমিকদের কাছ থেকে ৪০-৫০ টাকা দরে কিনে, কিছু প্রক্রিয়াজাত করার পর নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ও ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করছে ১০০-১২০ টাকায়। ফলে মাসিক অবৈধ আয়ের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৪-৫ কোটি টাকা, যার এক টাকাও সরকারি কোষাগারে রাজস্ব হিসেবে যাচ্ছে না।

এই বিপুল পরিমাণ পাথর পরিবহনের জন্য প্রতিদিন শতাধিক টলি (ট্রাক্টর) ও ট্রাক চলাচল করছে ডিমলা উপজেলার প্রধান ও উপসড়কগুলো দিয়ে। অতিরিক্ত ওজনের এসব যানবাহনের কারণে গ্রামীণ সড়কগুলো চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কোথাও কোথাও ইট-বালু উপড়ে গিয়ে তৈরি হচ্ছে গর্ত ও ধুলাবালির স্তূপ, যা স্থানীয়দের যাতায়াতের জন্য হয়ে উঠেছে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ।

তিস্তাতীরে কান্না, সিন্ডিকেটের উৎসব

স্থানীয় এক স্কুলশিক্ষক বলেন, ট্রাক্টরের কারণে রাস্তায় হাঁটাও যাচ্ছে না। ধুলায় শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, বাচ্চারা ঠিকমতো স্কুলে যেতে পারছে না। অথচ এসব ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাট মেরামতে প্রতি বছর উপজেলা পরিষদ ও স্থানীয় সরকার বিভাগ ব্যয় করছে লাখ লাখ টাকা—যা জনগণের করের অর্থের চরম অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়।

উপজেলার খালিশা চাপানি ইউনিয়নের বাইশপুকুর গ্রামের কৃষক জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘গত সপ্তাহেই আমার তিন বিঘা জমি নদীভাঙনে চলে গেছে। প্রতি বছর জমি হারাচ্ছি, কেউ দেখে না। প্রতিবাদ করলেই হুমকি আসে।’

স্থানীয়দের অভিযোগ, পাথর সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই বিভিন্ন হয়রানির শিকার হতে হয়। এমনকি প্রশাসনের একাংশও তাদের সহযোগিতা করছে বলে গুঞ্জন রয়েছে।

খালিশা চাপানি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শহীদুজ্জামান বলেন, ‘গত তিন বছরে তিস্তা নদীর ভাঙনে শুধু আমাদের ইউনিয়নেই কয়েক শতাধিক পরিবার গৃহহীন হয়েছে। হাজার বিঘারও বেশি আবাদি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। আমরা অসহায়। প্রতিরোধ করতে পারছি না, কারণ সিন্ডিকেট অত্যন্ত প্রভাবশালী।’

টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের এক ইউপি সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা একাধিকবার প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। বরং কিছু প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি নিজেরাই পাথর উত্তোলনের সুবিধাভোগী।

জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে ডিমলার ছয়টি ইউনিয়নের অন্তত ২,০০০টির বেশি পরিবার নদীভাঙনে সর্বস্ব হারিয়েছে। অনেকে এখন আশ্রয় নিয়েছে বিভিন্ন চর, বেড়িবাঁধ বা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। কেউ হারিয়েছেন জমি, কেউ ঘরবাড়ি, আবার কেউ প্রিয়জনের কবরস্থান পর্যন্ত।

এ বিষয়ে ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী অমিতাভ চৌধুরী বলেন, ‘নদীর পাথর উত্তোলন পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় পড়ে না, এটি উপজেলা প্রশাসনের বিষয়।’

ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরানুজ্জামান বলেন, পাথর উত্তোলন সম্পূর্ণ অবৈধ। গত সপ্তাহে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে দুজনকে ৫ দিনের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আরও তথ্য পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অথচ একই সময় পানি উন্নয়ন বোর্ড ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নদীভাঙন প্রতিরোধে জিওব্যাগ ফেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। কিন্তু যেখানে প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে, সেখানেই গভীর গর্ত করে পাথর উত্তোলনের ফলে বাঁধ ও প্রকল্প উভয়ই এখন মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদীর তলদেশ খুঁড়ে পাথর উত্তোলনের ফলে নদীর প্রাকৃতিক গঠন ও স্রোতের ধারা পরিবর্তিত হচ্ছে। এতে ভাঙন বেড়ে যাচ্ছে, পরিবর্তন হচ্ছে নদীপথ এবং মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশগত ভারসাম্য।

সুধীজনদের মতে, তিস্তা এখন কেবল একটি নদীর নাম নয়—এটি হয়ে উঠেছে এক জীবিকার যুদ্ধক্ষেত্র। একদিকে কয়েকজনের অর্থবৈভবের উৎসব, অন্যদিকে নদীপাড়ের হাজারো মানুষের চোখে শুধুই কান্না, হতাশা আর ক্ষোভ। প্রশাসনের সমন্বিত ও কঠোর পদক্ষেপ না নিলে তিস্তা একদিন হয়ে উঠবে শুধুই একটি ভয়াবহ স্মৃতি।