Image description

জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করার দুই বছরের মধ্যে জাতীয় সনদ বা জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে। ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সংবিধানে যথাযোগ্য স্বীকৃতি দিতে হবে বলে জুলাই সনদের খসড়ার অঙ্গীকারনামায় উল্লেখ করেছে কমিশন। এ ছাড়াও, অব্যাহত আলোচনার মাধ্যমে আগামী দুই-তিনদিনের মধ্যেই ঐতিহাসিক জুলাই সনদের চূড়ান্ত প্রক্রিয়ায় পৌঁছাতে যাচ্ছে কমিশন। এখন পর্যন্ত ১২টি বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যদিও দু’টি বিষয়ে ‘নোট অফ ডিসেন্ট’ রয়েছে বলে জানিয়েছে কমিশন। তবে, চারটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ কমিটির বিষয়ে বৈঠকের শুরুতেই ওয়াকআউট করে বিএনপি, পরে যোগ দেয় আলোচনায়। দলটি বলছে, নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি যেমন সংসদের কাছে, তেমনি জনগণের কাছেও রয়েছে। কিন্তু যদি কর্তৃত্ব না থাকে, কেবল দায়িত্ব আর জবাবদিহি থাকে, তাহলে তা কার্যকর রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যথেষ্ট নয়। সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগে নির্বাহী বিভাগের হাত-পা বাঁধা হলে তা ভবিষ্যতের জন্য বাধা সৃষ্টি করতে পারে। জামায়াতে ইসলামী বলছে, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো আগে থেকেই স্বাধীন ছিল। এখানে সরকারের হস্তক্ষেপ করার আইনগত কোনো সিস্টেম নেই।

গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় দফার ২০তম  বৈঠকে এসব কথা বলেন রাজনৈতিক দলের নেতারা। কমিশনের আলোচ্য সূচিতে ছিল- সরকারি কর্ম কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান ও নারী প্রতিনিধিত্ব। 

বৈঠক শেষে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কারও কোনো দ্বিমত নেই। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রস্তাব এসেছে। আমরা  যেখানে আটকে গিয়েছিলাম যে, কমিটির সিদ্ধান্তটা কীভাবে হবে। নিয়োগ কমিটি সিদ্ধান্তে আসবেন কীভাবে। সর্বসম্মতভাবে হলে কারও কোনো দ্বিমত নেই। আমাদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব ছিল র‌্যাঙ্ক চয়েস। 

তিনি বলেন, বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সর্বশেষ অপশন হিসেবে তারা ত্রয়োদশ সংশোধনীতে ফিরে যেতে চান। তবে, দু’টি বিষয় রয়েছে- ত্রয়োদশ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতির যে অবস্থান, সেটা তারা রাখতে চাচ্ছেন না। অন্যদিকে কমবেশি সব দল একমত বিচার বিভাগকে যতটা সম্ভব সংশ্লিষ্ট না করা। ত্রয়োদশ সংশোধনীতে গেলে দরজা না হলেও জানালা উন্মুক্ত হয়ে যায়। সেজন্য সকলেই চেষ্টা করছেন ত্রয়োদশ সংশোধনীতে যাওয়ার আগে বিকল্প বের করা যায় কিনা। 
জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে মৌখিকভাবে একটি প্রস্তাব হাজির করা হয়েছে উল্লেখ করে আলী রীয়াজ বলেন, আজকে রাতের মধ্যে তারা তাদের লিখিত প্রস্তাব দেবেন বলে আশা করি। কমিটি নিয়োগের ব্যাপারে সর্বসম্মতভাবে একটি প্রক্রিয়া তৈরি না হলে কীভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়, সে ব্যাপারে বলেছেন। তারা র‌্যাঙ্ক চয়েসের ব্যাপারে আপত্তি করেছিলেন- এখন তারা র‌্যাঙ্ক চয়েসের ব্যাপারে আপত্তি করছেন না, এই শর্তে যে- র‌্যাঙ্ক চয়েসটা গোপন ব্যালটে না হয়ে ওপেন ব্যালটে হতে হবে। যাতে করে প্রকাশ্যে ভোট দেয়া যায়। এগুলো তাদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব। 

তিনি বলেন, অব্যাহত আলোচনার মাধ্যমে আগামী দুই-তিনদিনের মধ্যেই ঐতিহাসিক জুলাই সনদের চূড়ান্ত প্রক্রিয়ায় পৌঁছাতে যাচ্ছে কমিশন। আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে বারবার আমরা পরিবর্তন ও সংস্কার করি এই কারণে যে, এতে করে যেন সকলে একটি নির্দিষ্ট স্থানে একমত হতে পারে। এখন পর্যন্ত ১২টি বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি। যদিও দু’টি বিষয়ে নোট অফ ডিসেন্ট রয়েছে। তবুও আমি বলবো, যেহেতু সকলেই ছাড় দিচ্ছেন, সে কারণে এই ঐকমত্য গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে।
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের পক্ষ থেকেই প্রস্তাব ছিল, কেউ যেন ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে না পারেন, সেটি গৃহীত হয়েছে। আমরা আরও প্রস্তাব দিয়েছি, নির্বাচন কমিশন গঠনে একটি স্বাধীন সার্চ কমিটি গঠন করা হোক, যেখানে সরকারি দল, বিরোধী দল ও বিচার বিভাগের প্রতিনিধি থাকবে, সেটিও গ্রহণযোগ্য হয়েছে।

তিনি বলেন, আমরাই প্রস্তাব করেছি যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে পরবর্তী সময়ে সংসদ কোনো সংশোধনী আনলে, তা রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের আগে গণভোটে যেতে হবে। এটি গৃহীত হওয়া মানে, দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় পদক্ষেপ। 
এসব অগ্রগতির মধ্যেও নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিএনপি’র এই নেতা বলেন, নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি যেমন সংসদের কাছে, তেমনি জনগণের কাছেও রয়েছে। কিন্তু যদি কর্তৃত্ব না থাকে, কেবল দায়িত্ব আর জবাবদিহি থাকে, তাহলে তা কার্যকর রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যথেষ্ট নয়।
সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগে নির্বাহী বিভাগের হাত-পা বাঁধা হলে তা ভবিষ্যতের জন্য বাধা সৃষ্টি করতে পারে। জনগণের প্রত্যাশা পূরণে নির্বাহী বিভাগকে শক্তিশালী হতে হবে, দুর্বল নয়।

জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগের বিষয়ে আজকে আলোচনা হয়েছে। এর আগেও দুইদিন এই বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আজকেও চারটি বিষয় এজেন্ডার মধ্যে রাখা হয়েছে। আজকের আলোচনার শুরুতে পার্লামেন্ট (হাউজ/কমিশন) একটু উত্তেজিত হয়েছিল। কারণ এর আগে আমরা দুই-একটি ওয়াক আউট এবং ওয়াক ইনও দেখেছি। হাউজ কিছুটা প্রাণবন্ত রয়েছে, ইউ আর ইনজয়িং দেস ইস্যু। 
নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামীর এই নির্বাচনে প্রথম এজেন্ডা থাকবে ‘দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ’। এটা আমরা এই কারণে করতে পারবো- আমরা অলরেডি টেস্টেড, ছোটখাটো যেখানে ছিলাম। আমরা নির্বাচন চাই, নির্বাচন হওয়া উচিত। নির্বাচন যদি ফেব্রুয়ারিতে হয়, আমাদের কোনো ধরনের আপত্তি নেই- নির্বাচনে যাওয়ার প্রস্তুতি আমাদের আছে। কিন্তু নানা ষড়যন্ত্র দেখতেছি, কারণ এখনো লেবেল প্লেয়িং ফিল্ডের ব্যাপারে গভর্নমেন্ট কোনো ধরনের স্টেপ নেয়নি। 
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে দল নিরপেক্ষ নিয়োগের বিষয়টি বিএনপি না মানার কারণ বোধগম্য নয়। দলটি যেহেতু নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়ায় একমত, তাই অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোও সাংবিধানিকভাবে নিয়োগ হওয়ার বিষয়ে একমত হওয়া উচিত।

বৈঠকে কমিশনের সদস্য হিসেবে বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে, বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), গণসংহতি আন্দোলনসহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।  
বিএনপি’র ওয়াকআউট: কমিশনের প্রস্তাবিত সরকারি কর্ম কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান আলোচনায় অংশ নেয়নি বিএনপি। সকাল সাড়ে ১১টার পর বিষয়টি আলোচনার জন্য উপস্থাপন করেন কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। এ সময় বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ জানান, তারা আলোচনায় অংশ নেবেন না।

পরে আলী রীয়াজ বলেন, বিএনপি’র পক্ষে বলা হয়েছে, তারা আলোচনায় থাকবে না। একটি রাজনৈতিক দল আলোচনায় অংশ না নিলে আলোচনা করা যাবে না, তা নিয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারি না।