Image description

ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে দেশ যখন স্বৈরাচার মুক্তির দ্বারপ্রান্তে, ঠিক তার আগের দিন ফেনীর মহিপালে ঘটে এক নৃশংস হত্যাকাণ্ড। আন্দোলনে অংশ নেওয়া নিরীহ ছাত্রদের ওপর নেমে আসে পৈশাচিক হামলার গুলিবৃষ্টি।

ঝরে যায় আটটি তাজা প্রাণ। সব মিলিয়ে ফেনীতে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ জনে। বছর ঘুরেও মিলছে না সান্ত্বনা, মূল হোতারা রয়ে গেছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, শুরু হয়নি বিচার। উদ্ধার হয়নি হামলায় ব্যবহৃত অবৈধ অস্ত্রও। সেদিনের শহীদদের একজন ফেনীর সরোয়ার জাহান মাসুদ।

অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েই ছেলে হত্যার দ্রুত বিচার দাবি করেছেন শহীদ সরোয়ার জাহান মাসুদের মা বিবি কুলসুম। প্রয়োজনে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরু করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। তার আকুতি— বেঁচে থাকতে যেন ছেলে হত্যার বিচার দেখে যেতে পারেন। আজ পর্যন্ত হত্যার সঙ্গে জড়িত কোনো বড় আসামি গ্রেপ্তার না হওয়া এবং বিচার কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় তীব্র আক্ষেপও প্রকাশ করেছেন তিনি।

কথা ছিল প্রবাসে থাকা অসুস্থ বাবা তাকে বিদেশ নিয়ে নিজে ফিরবেন দেশে। রোগাক্রান্ত শরীরে প্রবাসে আর কাজ করতে পারছেন না। বড় ছেলে হিসেবে বিদেশ গিয়ে পরিবারের হাল ধরবেন মাসুদ- ছিল এমনই আশা। পরিবারের সেই আশা রয়ে গেল অধরাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়ে গেল ৪ আগস্ট ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনীর মহিপালে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন ফেনী সরকারি কলেজের বিএসএস প্রথম বর্ষের ছাত্র সরোয়ার জাহান মাসুদ।

২০০৩ সালের ২৩ নভেম্বর ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার উত্তর জয়লস্কর মীর বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন মাসুদ। ২০২০ সালে স্থানীয় সিলোনিয়া হাইস্কুল থেকে এসএসসি ও ২০২২ সালে দাগনভূঞা সরকারি ইকবাল মেমোরিয়াল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ফেনী সরকারি কলেজে ভর্তি হন। তিন ভাইয়ের মধ্যে মাসুদ ছিলেন সবার বড়। মেজ ভাই মাসুম আল সামির সরকারি ইকবাল মেমোরিয়াল কলেজে একাদশ শ্রেণিতে এবং ছোট ভাই সাইম সুলতান মাদরাসায় পড়ছে। বাবা শাহজাহান টিপু দুবাই প্রবাসী, মা বিবি কুলসুম একজন গৃহিণী।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই মাসুদ ও তার মেজ ভাই সামির সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। ৪ আগস্ট সকাল থেকেও তারা দুই ভাই মহিপাল ফ্লাইওভারের নিচে অবস্থান নেন। দুপুর আনুমানিক ২টার দিকে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা চারদিক থেকে অতর্কিত হামলা চালিয়ে গুলি বর্ষণ করে। দুটি গুলি মাসুদের বুকে ও একটি হাতে লাগে।

মাসুদের ছোট ভাই ও সহযোদ্ধারা দ্রুত তাকে উদ্ধার করে দাগনভূঞা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু পথিমধ্যে দাগনভূঞার বেকের বাজারে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা তাদের বাধা দেয়। খবর পেয়ে আত্মীয়রা ছুটে এলে তাদেরও মারধর করা হয়। এক পর্যায়ে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মাসুদকে মৃত ঘোষণা করেন।

লাশ বাড়ি নেওয়ার ক্ষেত্রেও বাধার মুখে পড়ে পরিবার। পরে রাত ১টায় লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং রাতের মধ্যেই দাফন করতে বলা হয়।

এ ঘটনায় মাসুদের মা বিবি কুলসুম ফেনী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারীকে প্রধান আসামি করে ১৩৪ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ২০০ জনের বিরুদ্ধে দাগনভূঞা থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন।

সন্তানের স্মৃতি মনে পড়লেই বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন বিবি কুলসুম। মাসুদের বই ও ব্যবহৃত জিনিস বুকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদছেন তিনি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফেনীর কর্মী আজিজ বলেন, মাসুদ আমাদের সহযোদ্ধা ছিল। ৪ আগস্ট আওয়ামী হায়েনাদের গুলিতে তার নির্মম মৃত্যু হয়েছে। ছেলে হারা মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমার নেই। আমরা দ্রুত মাসুদ হত্যার বিচার চাই।

হত্যাকাণ্ডের অগ্রগতি জানতে চাইলে ফেনী মডেল থানার পরিদর্শক (ওসি) মো. শামছুজ্জামান জানান, মামলার বেশ কিছু আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। আশা করা যাচ্ছে, অল্প সময়ের মধ্যে চার্জশিটও দেওয়া যাবে।