Image description

আমার ছেলে এমন প্রখর মেধাবী ছিল একটু পড়লেই সবকিছু শিখে ফেলত। ছিল ভদ্র, নম্র, বিনয়ী। ২য় শ্রেণি থেকেই ৩০ টি রোজা রাখতো, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো এভাবেই স্মৃতিচারণ করলেন উত্তরার বিমান বিধ্বস্তে শহিদ সায়ানের মা মাইলস্টোন কলেজের কেমিস্ট্রি বিভাগের শিক্ষক শাম্মী। রোববার (২৭ জুলাই) নিজের ফেসবুক আইডিতে এক স্ট্যাটাসে এমন স্মৃতিচারণ করেন তিনি।

 

ফেসবুক পোস্টে শাম্মী বলেন, প্রিয় সহকর্মীবৃন্দ, আসসালামু আলাইকুম। আমি ও ইউসুফ স্যার হয়তো কোনো বড় ভুল বা অন্যায় করে ফেলেছি, যার জন্য আল্লাহ আমাদের এত বড় শাস্তি দিয়েছেন। আপনারা সবাই আমাদের ক্ষমা করে দেবেন। আমার ছেলেটিকেও (সায়ান) দয়া করে ক্ষমা করবেন। আমাদের ফুলের মতো নিষ্পাপ সন্তানটি আমাদের চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল, অথচ আমরা কিছুই করতে পারলাম না।

তিনি লেখেন, কত সুন্দর, কত মেধাবী, কত বুদ্ধিদীপ্ত ছিল আমার ছেলেটি! আজ পত্রিকার শিরোনামে আমার ছেলের নাম, ফেসবুক খুললেও তার ছবি, তার খবর! আমরা কল্পনাও করতে পারিনি আমাদের সন্তান এভাবে খবরের শিরোনাম হবে। ওর বাবা সবসময় বলত, ‘সীমা, আমার মনে হয় আমাদের ছেলে একদিন কিছু আবিষ্কার করবে।’ এমন প্রখর মেধাবী ছিল সে একটু পড়লেই সবকিছু শিখে ফেলত। ছিল ভদ্র, নম্র, বিনয়ী। ক্লাস টু-তে পড়ার সময় থেকেই ৩০ টি রোজা রাখতো, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো। 

ফেসবুক পোস্টে তিনি লেখেন, দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আজ বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানের মেধাবী ছাত্ররা প্রাণ হারাচ্ছে। ইউসুফ স্যারের ইচ্ছে ছিল, আমাদের ছেলে যেন আমেরিকায় পড়াশোনা করতে পারে। আমরা ছেলেকে নিয়ে বিদেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম শুধু নিরাপত্তার কারণে আর সেই ভয়ই আজ বাস্তব হয়ে দাঁড়ালো। আমার ছেলেটি দগ্ধ শরীরে চারদিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল, কিন্তু তখনও সে কাঁধের ব্যাগটা নিতে ভুল করেনি! আহারে পড়াশোনা! আহারে শিক্ষা! কী দরকার ছিল এমন শিক্ষার, যা আমার সন্তানের জীবনটাই কেড়ে নিল!

তিনি লেখেন, ঘটনার দিন একটি নাম্বার থেকে আমার ফোন আসে। জানতে পারি, যে ছেলে আমার ছেলেকে বাংলাদেশ মেডিকেলে নিয়ে গিয়েছিল, সে ইউসুফ স্যারেরই ছাত্র। পরে ফোনে ছেলেটির কাছে শুনি, আমার সোনা পাখি ঠিকমতো নিশ্বাস নিতে পারছিল না, এই অবস্থার মধ্যেও সে ছাত্রটিকে তার মায়ের ফোন নম্বর দিয়ে দেয়। আমি ফেসবুকে দেখি, সেই ছেলেটি অমিত আমার ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছে। ভাই ও বোনেরা, আমি আপনাদের সবার কাছে চিরঋণী।

বাংলাদেশ মেডিকেলে যখন ওর দগ্ধ শরীর দেখে ওর চাচ্চু কাঁদছিলেন, তখনও আমার ছেলে তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল, "চিন্তা কোরো না চাচ্চু , সব ঠিক হয়ে যাবে।" ওর বাবাকে দেখে ও সাহস পেয়েছিল। ওর বাবা  বলেছিল, "বাবা, আমি আসছি আর ভয় নেই।" মাথা নেড়ে সে সাড়া দিয়েছিল।

শাম্মী আরও লেখেন, আমার ছেলেটি ছোটবেলা থেকেই খুব ভীতু ছিল। অথচ সেই ছেলেই আজ পাখির মতো ছটফট করেছে পুরো শরীর ঝলসে গিয়ে। কিন্তু আমাদের বুঝতে দেয়নি, যাতে আমরা দুশ্চিন্তায় না পড়ি। আইসিইউতে থাকা অবস্থায়ও ও আমাকে দেখতে চেয়েছিল। আমি যখন ওকে দেখতে যাই, দেখি তার পুরো শরীর ঝলসে গেছে। আমি আমার ছেলেকে চিনতেই পারছিলাম না। আমি তাকে বলেছিলাম, “মা, বাবা, সোনা পাখি, শুধু পড়তে থাকো ‘লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ্জোয়ালিমীন’।” আমার সোনা মাথা নেড়ে সায়  দিয়েছিল। এটাই ছিল আমার সঙ্গে ওর শেষ কথা।

এই সময়টা বড় কঠিন। আমি জানি না কিভাবে ওকে ছাড়া এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেব। দিন যেন শেষই হয় না। আমি কখন যাব আমার সোনা পাখির কাছে, সেটাই ভাবি। আমার আর সহ্য হচ্ছে না মা পাখি, আমাকে তুমি তোমার কাছে নিয়ে যাও। সোনা, আমাকে ক্ষমা করে দিস। আমি এক ব্যর্থ মা তোর জন্য কিছুই করতে পারলাম না।