
স্কুল ছুটির পর বড় বোন তাহিয়া আশরাফ নাজিয়া বের হতে কেন দেরি করছে, তা দেখতে গিয়েছিল আরিয়ান আশরাফ নাফি। আর তখনই যুদ্ধবিমানটি বিধ্বস্ত হয়। এতে দগ্ধ হয় দুই ভাই–বোনই। দুজনকেই নেওয়া হয় জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। নাজিয়ার শরীরের ৯০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছিল। আর নাফির ছোট্ট শরীরের প্রায় পুরোটাই পুড়ে গিয়েছিল—৯৫ শতাংশ।
রাজধানীর কামারপাড়ায় রাজাবাড়ি দক্ষিণপাড়া কবরস্থানে এই ভাই–বোনকে পাশাপাশি কবর দেওয়া হয়েছে। নাজিয়া মারা গেছে ২২ জুলাই, আর নাফি মৃত্যুর কাছে হার মানে ২৩ জুলাই।
নাজিয়া উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ত। আর নাফি ছিল তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী।

বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি থাকার সময় নাজিয়া জানতে চেয়েছিল, ভাই কেমন আছে? পরিবারের সদস্যরা বলেছিলেন, ‘তোমার ভাই ভালো আছে, সুস্থ আছে।’ এ কথাকে ‘সত্য’ ভেবেছিল নাজিয়া। কিন্তু মৃত্যুই দুই ভাই–বোনের জন্য এখন একমাত্র ‘সত্য’। আর একমাত্র স্বজনেরাই জানেন, এ সত্য মানা কতটা কঠিন! দুই সন্তানকে হারিয়ে মা তাহমিনা আক্তার, বাবা আশরাফুল ইসলাম বাক্রুদ্ধ।
টেলিফোনে অনুমতি নিয়ে গতকাল শনিবার রাজধানীর কামারপাড়ায় রাজাবাড়ি পুকুরপাড়ে নাজিয়া–নাফিদের বাসায় যান এ প্রতিবেদক। কথা হয় ওদের খালা তানজিনা আক্তারের সঙ্গে। বললেন, ‘সন্তানদের মৃত্যু, আগুনে পুড়ে বিকৃত হয়ে যাওয়া লাশের বর্ণনা দিতে আর ইচ্ছে করছে না আমাদের! আমাদের আর কোনো চাওয়াপাওয়া নেই, কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই। ক্ষতিপূরণ বা অন্য কিছু চাওয়ারও নেই।’
নাজিয়া–নাফির সব আবদারই ছিল মায়ের কাছে। মা ওদের স্কুলে আনা–নেওয়া করতেন। ২১ জুলাইও তাহমিনা সন্তানদের স্কুল থেকে আনতে গিয়েছিলেন। নাফি মায়ের কাছে চলেও এসেছিল। পরে নাজিয়া কেন দেরি করছে, তা দেখতে আবার স্কুলের ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল নাফি। তাহমিনার চোখের সামনেই ঘটে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা, যে ঘটনা কেড়ে নিয়েছে তাঁর দুই সন্তানকে চিরদিনের জন্য।

দুর্ঘটনার পর উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে খোঁজাখুঁজি করা হয়। সেখান থেকে বার্ন ইনস্টিটিউটে গিয়ে দুই ছেলে–মেয়েকে পান।
তানজিনা জানালেন, নাজিয়ার বই বাসার যে কক্ষে ছিল, ২০ জুলাই রোববার সেই কক্ষের দরজার তালা লেগে (লক) গিয়েছিল। ফলে সে স্কুল থেকে দেওয়া বাড়ির কাজ (হোমওয়ার্ক) করতে পারেনি। সে জন্য পরদিন ২১ জুলাই সোমবার স্কুল ছুটির পর নাজিয়াকে ‘ডিটেনশনে’ নিয়েছিলেন (স্কুলের পড়া শেষ করিয়ে নেওয়ার জন্য)। তা না হলে সে–ও সময়মতো স্কুলের ফটকে মায়ের কাছে চলে আসত।
তাহমিনা আক্তার অন্তঃসত্ত্বা। আগামী মাসে সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য তারিখের কথা জানিয়েছেন চিকিৎসক। আশরাফুল ইসলাম অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য।
নাজিয়া–নাফির খালা তানজিনা বললেন, ‘ইউটিউবে সেদিনের ঘটনার নানা ভিডিও ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজ (শনিবার) আগুনে ঝলসে যাওয়া দুই শিশুর ভিডিও দেখে নিশ্চিত হলাম, এরা তো আমাদের নাজিয়া আর নাফি। আগে চিনতে পারিনি। এ ভিডিওগুলো দেখে ওদের মা–বাবা কারও সঙ্গে কথা বলছেন না, খাওয়াও প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন।’

মাইলস্টোন স্কুলে বাচ্চা পড়ে—এমন দুই মা নাজিয়া–নাফির পরিবারের সদস্যদের দেখতে এসেছিলেন। এই দুই মা তাঁদের সন্তানকে সুস্থভাবে বাড়ি নিয়ে যেতে পেরেছিলেন সেদিন। এ দুই অভিভাবকসহ বাসার অন্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, ঘটনার পর বাচ্চারা দগ্ধ হয়ে বের হচ্ছে। তখনো একদল মানুষ বাচ্চাদের সাহায্যে এগিয়ে না গিয়ে ভিডিও করায় ব্যস্ত ছিল।
তানজিনা যোগ করলেন, ‘বাচ্চাদের বিকৃত হয়ে যাওয়া লাশ কেন এলাকার মানুষদের দেখাতে চাইনি, তা নিয়ে প্রায় সালিস বসিয়ে ফেলেছিল। আপনাদের সবার ঘরেই হয়তো বাচ্চা আছে। আমাদের মতো ভুক্তভোগীদের অবস্থাটা একটু বুঝতে চেষ্টা করেন!’
তানজিনা জানালেন, তাঁর বড় বোনের ছেলে ছোট জুনায়েদও একই স্কুলে পড়ে। সে–ও দগ্ধ হয়েছে। তাকে প্রথমে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছিল। এখন ঢাকার সিএমএইচে (সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল) ভর্তি আছে।
জুনায়েদের বোন মিফতাহুল জান্নাতও মাইলস্টোন স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। সে–ও ছিল নাজিয়া–নাফিদের বাসায়। সে খুব ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, ‘চোখের সামনেই ঘটনা ঘটেছে। আমিও আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে যেতে পারতাম!’

ঘটনার পর থেকে নাজিয়া ও নাফির মৃত্যুর আগপর্যন্ত হাসপাতালেই ছিলেন তানজিনা। বার্ন ইনস্টিটিউটের সাততলায় ছিল নাজিয়া, চারতলায় নাফি। হাসপাতালে ওদের খুঁজে পেতে অনেক সময় লেগে যায়। আগুনে পুড়ে ওদের চেহারা এমন হয়ে গিয়েছিল যে চেনাও যাচ্ছিল না! তানজিনা বললেন, ‘নাজিয়া ও নাফি দুজন নিজেরাই বলে, “আন্টি, আমি নাজিয়া”, “আন্টি, আমি নাফি।”’
তানজিনা জানালেন, হাসপাতালে নাফি তেমন কথা বলেনি। মাকে ডেকেছে। তবে নাজিয়া অনেক কথা বলার চেষ্টা করেছে। ভাইয়ের কথা জানতে চেয়েছে। ভাই ভালো আছে, এরপরও খালা (তানজিনা) কেন কাঁদছে, তা–ও জানতে চেয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, তা–ই সে (নাজিয়া) ভালো হয়ে যাবে, এ কথাও বলেছে।
মৃত্যুর আগে নাজিয়া খুব কষ্ট পেয়েছে, সে কথা ভুলতে পারছেন না তানজিনা। জানালেন, নাজিয়ার মুখ ফুলে দুই চোখ একসঙ্গে লেগে গিয়েছিল, কিছু দেখতে পাচ্ছিল না। খালা যাতে তার হাতটা না ছাড়ে, সে কথাও বলে। পানি খেতে চেয়েছিল। চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে পানি দেওয়া হয়। তখন বলেছিল, এতে তার পিপাসা মিটবে না। ঠান্ডা জুস আর আইসক্রিম খেতে চেয়েছিল। যন্ত্রণা বাড়ায় চিকিৎসক নাজিয়াকে ব্যথানাশক ওষুধ দেয়। আস্তে আস্তে তার যন্ত্রণা কমে। একসময় মারা যায়। জুস আর আইসক্রিম আনা হলেও আর খেতে পারেনি নাজিয়া!
তানজিনা বললেন, বাচ্চা দুটির শরীরে এমন কোনো জায়গা ছিল না, যেটুকু ধরে একটু আদর করা যেত! কাছে নেওয়া যেত! শুধু দূর থেকে এই বাচ্চাদের যন্ত্রণা দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না!
ঘরে প্লাস্টিকের ঝুড়িতে অনেকগুলো খেলনা। তার মধ্যে হলুদ রঙের একটি খেলনা বিমান। এটি দিয়ে বাসায় খেলত নাফি।
নাজিয়া-নাফির নানি নাজমা বেগম বললেন, ‘এই বাচ্চারা নাই, এইটা তো নিজেরেই বুঝ দিতে পারি না, আমার মেয়েরে কেমনে বুঝ দিব!’