Image description
 

Ahmad Sabbir(আহমদ সাব্বির)

 
২০১১ সালের আরব বসন্তে যখন মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েছিল স্বাধীনতা, মর্যাদা আর ন্যায়ের দাবিতে, তখন মিশরের এবং আরব দেশ গুলোর ওলামারা এক সঙ্কটের মুখোমুখি হন। আর এই সংকট শরিয়া বনাম স্বাধীনতার দ্বন্দ্বের সঙ্কট । একদিকে তারা ইসলামের ধারক- বাহক হয়ে শরীয়াকে বাদ দিয়ে কেবল স্বাধীনতা, মানবাধিকারের আলাপ করতে পারছিলেন না। অন্যদিকে শরিয়া নিয়ে সরাসরি আলাপও করতে পারছিলেন না। কারণ এলিট এবং মিডল ক্লাস এবং শিক্ষিত নারী শ্রেণীর মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে যে ইসলামিষ্টরা আরব বসন্তের সুযোগে শরিয়া কায়েম করে তাদের চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে দেশটাকে আফগানিস্তান বানিয়ে ছাড়বে।
এই পরিস্থিতিতে আরব ওলামারা শরিয়াভীতি দূর করার জন্য দুইটা অবস্থান তুলে ধরেন। তার একটা হচ্ছে তারা সরাসরি স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে বলেন শরীয়া বাস্তবায়নের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে স্বাধীনতা। এই অবস্থান যারা গ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে রয়েছে ইউসুফ আল কারাদাভির মত স্কলার । তিনি বলেছিলেন- ألحرية قبل الشرعية অর্থাৎ “freedom is more important than Shari‘ah”। শরিয়ার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে স্বাধীনতা।
দ্বিতীয় অবস্থানটি হচ্ছে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের। যারা প্রায় একই কথা বলেছেন কিন্তু ভিন্নভাবে। তারা শরীয়ার আগে স্বাধীনতা এমনটা না বলে তারা বললেন স্বাধীনতাই হচ্ছে শরীয়ার মৌলিক উদ্দেশ্য।
২০১২ সালে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় এই সময়ে Al-Azhar Document on Basic Freedoms (وثيقة الأزهر حول الحريات الأساسية ) বা মৌলিক স্বাধীনতার দলিল নামে একটা ঐতিহাসিক ডুকুমেণ্ট প্রকাশ করে । এই দলিলটি ছিল একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ, যেখানে ইসলামী শরিয়াহর উদ্দেশ্য (maqāṣid al-sharīʿah) ও মানবিক স্বাধীনতার সম্পর্ককে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করা হয়েছিল।
এই দলিলে আল-আজহারের ওলামারা চারটি মৌলিক স্বাধীনতাকে ইসলামি মূল্যবোধ ও শরিয়াহর উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে ঘোষণা করেন—
১. বিশ্বাসের স্বাধীনতা (حرية الاعتقاد)
২. মতপ্রকাশের স্বাধীনতা(حرية الرأي والتعبير),
৩. বৈজ্ঞানিক গবেষণার স্বাধীনতা (حرية البحث العلمي )
৪. সাহিত্যিক ও শিল্প-সৃজনের স্বাধীনতা (حرية الإبداع الفني والأدبي)
প্রতিটি স্বাধীনতাকে শরিয়াহ-সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রমাণ করার জন্য কুরআনের আয়াত, হাদীস, এবং ফিকহি সূত্র ব্যবহার করে একটি ন্যায্যতার কাঠামো দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়।
উদাহরণস্বরূপ, বিশ্বাসের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে বলা হয় لا اكراه في الدين (ধর্মে কোনো জোর-জবরদস্তি নেই)। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বলা হয় ام الحرية অর্থাৎ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন স্বাধীনতা যেটা ছাড়া কোনো সৃষ্টিশীল কাজ জন্ম নিতে পারে না। গবেষণা ও সৃজনশীলতার স্বাধীনতাকে কুরআনে চিন্তা, তাদাব্বুর, তাফাক্কুরের আহ্বান দ্বারা বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। আর্ট, সাহিত্য, কবিতা, নাটক, চলচ্চিত্র ইত্যাদি ক্ষেত্রেও তারা ইসলামের ইতিহাসে সাহিত্যের প্রতি উন্মুক্ততার দৃষ্টান্ত হাজির করেন।
ডকুমেন্টটি একরকম চেষ্টা করেছে দেখাতে যে শরিয়াহ মানেই নিষেধ আর নিয়ন্ত্রণ নয়; বরং তা মানুষকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শেখায়, অন্য ধর্ম ও মতকে সম্মান করতে বলে, আর নৈতিকতার ভিত্তিতে সৃজনশীলতা উৎসাহিত করে।
ইউসুফ আল কারাদাভি কিংবা আল আজহার বিশ্বিবিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক ডকুমেন্ট যদি আমরা পর্যালোচনা করি তাহলে একটা জিনিস পরিষ্কার। আর সেটা হল বর্তমান আধুনিক জটিল দুনিয়ায় শরিয়ার ভূমিকা কি হবে সেটা নিয়ে একটা বিরাট সঙ্কট যা ওলামারা মোকাবেলা করতে পারছে না ।
একদিকে শরীয়া বলতে ট্রাডিশলান মোল্লা সমাজ যেটা বুঝে থাকেন তা হল এক ধরণের শাস্ত্রবাদী, লিগালিষ্ট নিয়ম- কানুন, যেখানে তারা ফিকহি রুলবুক অনুসরণ করে সমাজের এবং মানুষের সকল কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করতে চান। কিন্তু এই রকম চিন্তার এক্সপেরিমেন্ট দুই এক জায়গায় যা হয়েছে তা এক রকম বিরাট স্ক্যান্ডাল। যেমন আমরা আফগানিস্তানের কথা বলতে পারি যেখানে শরীয়া কায়েমের নামে নারীদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়া হইছে। রাস্তায় রাস্তায় রিলিজিয়াস পুলিশিং করে নারীর পোশাক থেকে শুরু করে পুরুষের দাড়ি কিংবা চুল কোন কিছুই তাদের নজরদারির বাইরে যেতে পারছে না। অর্থাৎ মানুষের চিন্তার স্বাধীনতা, তার চলাচলের স্বাধীনতা, শিক্ষা, সংস্কৃতি চর্চার মধ্যে মানুষের বিকাশের স্বাধীনতা সব কিছুকে তারা হরণ করেছে শরিয়ার নামে।
ইউসুফ আল কারাদাভির মত স্কলাররা বা আল আজহারের বিশ্ববিদ্যালয়ের জুরিষ্টরা ঠিক বুঝতে পারছেন না কি করবেন। এক দিকে তারা শরীয়াকে বাদ দিতে পারছেন না আবার অন্য দিকে যেভাবে শরীয়াকে অধিকাংশ মোল্লারা ভাবেন সেটা বস্তবায়ন করলে জুলুমের কোন সীমা পরিসীমা থাকবে না। ফলে শরীয়ার সাথে স্বাধীনতার সম্পর্ক কি সেটা নিয়ে ভাবলেন। এবং বললেন স্বাধীনতা ছাড়া শরিয়ার কোন অর্থ নাই। কিংবা স্বাধীনতাই শরিয়ার মূল উদ্দেশ্য।
কিন্তু তারা এই কথা গুলি খুব ভেবে বলেন নাই। ফলে তাদেরকে প্রচুর গোজামিল দিতে হইছে। Khaled Abou El Fadl এর ভাষায়, তারা শরিয়াহ ও আধুনিক মানবাধিকার উভয়ের সন্তুষ্টির চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কার্যত কোনো দার্শনিক বা আইনি মীমাংসা তারা করতে পারেন নি ।
খালেদ আবু এল ফাদেল দেখান আল-আজহার ডকুমেন্টে ইসলামের সাথে স্বাধীনতার সম্পর্ক তুলে ধরার একটা প্রচেষ্টা আছে, কিন্তু তারা এমন ভাষা ব্যবহার করেছে যা aspirational” এবং “rhetorical,” যার বাস্তব প্রয়োগের জন্য কোনো স্পষ্ট আইনগত কাঠামো বা ইনস্টিটিউশনাল মেকানিজম নেই।
যেমন ডকুমেন্টে বলা হয়েছে—বিশ্বাস, মতপ্রকাশ, গবেষণা ও সৃজনশীলতা হলো শরিয়াহর উদ্দেশ্য (maqāṣid al-sharīʿah)। কিন্তু একই সাথে বলা হয়েছে, এসব স্বাধীনতা ধর্মীয় অনুভূতি, নৈতিকতা, বা সামাজিক শৃঙ্খলা লঙ্ঘন করতে পারবে না। কিন্তু ধর্মীয় অনুভূতি আঘাত করা" মানে কী?এই শব্দগুলো অত্যন্ত ধোঁয়াটে, খামখেয়ালি ও নিয়ন্ত্রণমূলক যন্ত্র হিসেবে ব্যবহারযোগ্য। ফলে স্বাধীনতা একদিকে স্বীকৃত হয়েছে, অন্যদিকে একদম একই নিঃশ্বাসে তা আবার অস্বীকারের জায়গা রেখে দেওয়া হয়েছে।
খালেদ আবু এল ফাদল এর ভাষায় “It speaks of human dignity, rights, and liberty, but clings to a framework that is ultimately state-centered and control-oriented.” অর্থাৎ এটি মানব মর্যাদা, অধিকার ও স্বাধীনতার কথা বলে, কিন্তু এর ভেতরের কাঠামো শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রকেন্দ্রিক এবং নিয়ন্ত্রণমুখী।
আবু এল ফাদল বলেন যে এই ডকুমেন্ট আসলে "reformist in tone but conservative in substance", অর্থাৎ সংস্কারের ডাক থাকলেও কোনো গভীর কাঠামোগত পরিবর্তনের দিকে এগোয় না। এটি এমন একটি দলিল, যা সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে, কিন্তু সেই সংস্কার সাধনের উপায়গুলো গ্রহণ করতে ভয় পায়। আল-আজহার একদিকে মানবাধিকারের ভাষা গ্রহণ করতে চায়, কিন্তু শরিয়াহর প্রচলিত কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চায় না।
এক কথায় ওলামারা শরিয়াহকে বাদ দিতে পারছেন না আবার ঠিক কিভাবে রাখবেন সেটা বুঝতে পারছেন না। তারা স্বাধীনতাকে শরিয়াহর মধ্যে ঢোকাতে চাইছেন। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে স্বাধীনতা এবং শরিয়ার মধ্যকার সম্পর্কের নানান ডায়নামিক্স, নানান সময়ে হাজির হওয়া কনফ্লিক্ট এবং কন্ট্রাডিকশন, এ সব বিষয় গুলো ঠিক কিভাবে মীমাংসিত হবে তা পরিষ্কার করতে পারছেন না ।
এই স্ববিরোধিতা প্রমাণ করে যে, চিন্তাশীল ওলামারা সংকটটাকে টের পাচ্ছেন, কিন্তু তারা এর সমাধান দিতে পারছেন না। তারা মৌলিকভাবে বুঝে উঠতে পারছেন না—শরিয়াহর সাথে বর্তমান দুনিয়ার প্রেক্ষাপটে মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতার সম্পর্ক কিভাবে নির্ণয় করবেন।
আরব ওয়ার্ল্ডের এই সমস্ত চিন্তাশীল ওলামারা অন্তত সঙ্কটটাকে টের পেয়েছেন। কিন্তু উপমহাদেশীয় মোল্লারা কোন সঙ্কটকে স্বীকারই করেন না। তারা এখনো মনে করে ফিকহি রুলবুক মেনে শরিয়া প্রতিষ্ঠা করলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তারা লিগালিষ্ট শরিয়া যা প্রি-মডার্ন ফিকহি নিয়ম-কানুন দিয়ে প্রতিষ্ঠিত সেটাকেই এখনো চূড়ান্ত সমাধান হিসেবে ভাবেন।
ফলে তারা মনে করেন নারীকে ঘরের মধ্যে বন্দী রাখায় কোন সমস্যা নাই। মসজিদে নারীকে নিষিদ্ধ করায় কোন সমস্যা নাই। এমনকি তালেবানি পদ্ধতিতে নারীর লেখা-পড়া বন্ধ করে দিলে ও কোন সমস্যা নাই। অর্থাৎ মানুষের অধিকার, স্বাধীনতা, তাদের বিকাশ এ প্রশ্নগুলোর কোন গুরুত্বই নেই তাদের কাছে।
অর্থাৎ অন্তত আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় বা কারাদাভির মতো চিন্তাশীল ধর্মীয় স্কলাররা সংকটটা শনাক্ত করতে পেরেছেন—যদিও সমাধান দিতে ব্যর্থ। কিন্তু উপমহাদেশীয় ইসলামি নেতৃত্ব সেই সংকটের অস্তিত্বই অস্বীকার করছেন।
এই পরিস্থিতি স্পষ্ট করে দেয়—ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক সংকট এখন এতটাই গভীর যে, তার তাজদিদ বা পুনর্জাগরণ ওলামাদের ভিতর থেকে আসবে—এই আশা আর রাখা যায় না। সবচেয়ে সংবেদনশীল ও সচেতন ওলামারাও বড় দাগে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে কোন সমাধানের দিকে আগাতে পারছেন না। একদল সম্পূর্ণ গোঁড়ামিতে ডুবে আছে - যার উত্তম উদাহরণ হল উপমহাদেশের আলেমরা। আরেক দল যারা সচেতন তারা সমাধানের নামে গোঁজামিলের বেশি কিছু দিতে পারছেন না।