Image description

প্রচলিত আইনে মামলা হওয়ার পর তদন্ত করে প্রমাণ পেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ওই ঘটনায় অভিযোগপত্র দাখিল করে। আর ওই ঘটনার বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের প্রমাণ না পেলে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। এই দুই ধরনের প্রতিবেদনই দেওয়া হয় পরিপূর্ণ তদন্ত শেষে।

তবে সরকার দেশে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ (কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিওর) সংশোধন করে একটি নতুন ধারা (১৭৩-ক) যুক্ত করেছে। সেখানে ‘অন্তর্বর্তীকালীন তদন্ত প্রতিবেদন ইত্যাদি’ শিরোনামে নতুন একটি বিধান যুক্ত করা হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনের ফলে নিরপরাধ ব্যক্তিরা দ্রুতই মুক্তি পাবে বলে আশা করছে সরকার। তবে এতে মামলার অসৎ তদন্ত কর্মকর্তাদের (আইও) দুই দফা বাণিজ্য ও হয়রানির সুযোগ সৃষ্টি হলো বলে মনে করেন আইনজীবীরা।

কেন এলো অন্তর্বর্তীকালীন তদন্ত প্রতিবেদনের ধারা
ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এর ১৭৩ ধারায় মামলার তদন্ত শেষে আদালতে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ ধারায় পুলিশকে যত দ্রুত সম্ভব তদন্ত শেষ করতে বলা হয়েছে, কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়নি। ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মামলার তদন্ত শেষ করে আদালতে প্রতিবেদন দিতে মাসের পর মাস এমনকি বছরের পর বছর পর্যন্ত সময় নেন তদন্ত কর্মকর্তারা। আবার দেখা গেছে রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী বিভিন্ন মহলের চাপেও তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মামলার তদন্ত হয় এজাহারে (এফআইআর) থাকা অপরাধের অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে। তদন্ত শুরু হলে মামলার এজাহারে নাম থাকা অনেক আসামি সেই অপরাধে জড়িত ছিলেন না বলে তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে নিশ্চিত হওয়া যায়। তবে, আইনগত সীমাবদ্ধতার কারণে পুলিশি প্রতিবেদন দেওয়ার আগে তাকে দায়মুক্তি দেওয়ার সুযোগ থাকে না। আবার পুরো ঘটনা সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে পুলিশও প্রতিবেদন দিতে পারে না। এতে অনেক নিরপরাধ ব্যক্তির হয়রানির ক্ষেত্র তৈরি হয়।

 

সরকার ও পুলিশের পক্ষ থেকে নিরপরাধ ব্যক্তিদের গ্রেফতার বা হয়রানি না করতে নির্দেশনা দেওয়া হলেও অনেক ক্ষেত্রে তা উপেক্ষিত। তদন্তে মামলার অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনের বিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে এটি বড় কারণ বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তাই, ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এর অধিকতর সংশোধন করে প্রণীত অধ্যাদেশ জারি করে গত ১০ জুলাই গেজেট প্রকাশিত হয়েছে।

ফলে তদন্ত চলাকালে অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নিরপরাধ মানুষকে ভুয়া মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুযোগ তৈরি হলো বলে মনে করেন অনেকে।

আবার অপরাধী হয়েও অন্তর্বর্তী তদন্তে কোনো আসামি ছাড়া পেয়ে স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা করে পরবর্তী তদন্তে প্রভাব ফেলতে পারেন বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন কেউ কেউ। অন্তর্বর্তী তদন্ত প্রতিবেদন প্রচলনের কারণে পুলিশ বা মামলার আইও বিপথে যেতে পারেন। কারণ প্রভাবশালী আসামিরা অর্থ খরচ করবে। আইও দুর্নীতিবাজ হলে তদন্ত সঠিক হবে না বলেও আশঙ্কা করছেন তারা।

ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৩-ক ধারায় যা আছে
১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধনের প্রস্তাব গত ২৯ জুন অনুমোদন করেছিল সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের স্বাক্ষরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে তা অধ্যাদেশ (অর্ডিন্যান্স) আকারে জারি করা হয়। ‘দ্য কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫’-এর মাধ্যমে আইনে একটি নতুন ধারা (১৭৩-ক) যুক্ত করা হয়েছে। সেখানে ‘অন্তর্বর্তীকালীন তদন্ত প্রতিবেদন ইত্যাদি’ শিরোনামে নতুন একটি বিধান যুক্ত করা হয়েছে।

ওই ধারায় বলা হয়েছে–
১. অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন তলব: এখন থেকে মামলার তদন্ত চলাকালে যে কোনো পর্যায়ে পুলিশ কমিশনার, জেলার পুলিশ সুপার বা সমমর্যাদার কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তদন্তকারী কর্মকর্তাকে মামলার অগ্রগতির বিষয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারবেন।

২. অব্যাহতি: অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনে যদি কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে সেই প্রতিবেদন আদালতে (ম্যাজিস্ট্রেট বা ট্রাইব্যুনাল) দাখিল করা যাবে। আদালত ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সন্তুষ্ট হলে সেই ব্যক্তিকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে পারবেন।

৩. পুনরায় অন্তর্ভুক্তির সুযোগ: অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কোনো ব্যক্তি অব্যাহতি পেলেও সেটি চূড়ান্ত নয়। যদি তদন্ত শেষে সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত ও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে পুলিশ প্রতিবেদনে (ধারা ১৭৩ অনুযায়ী) তার নাম পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করতে কোনো বাধা থাকবে না।

গত ২৯ জুন উপদেষ্টা পরিষদ এই সংশোনী প্রস্তাবে সায় দেওয়ার পর আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘আমাদের সরকারের কিছু জিনিস নিয়ে আমরা নিজেরাই বিব্রত। একটা হচ্ছে ভুয়া বা মিথ্যা মামলা করা; আরেকটা হচ্ছে মামলার ঘটনা সত্যি, কিন্তু সেখানে অনেক লোককে আসামি করে মামলা বাণিজ্য করা। সেজন্য আমরা সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিআরপিসিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ চেইঞ্জ এনেছি।’

আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘আশা করছি পুলিশ প্রশাসন ও আদালত যেসব মামলায় গ্রেফতার বাণিজ্য হচ্ছে, মামলা বাণিজ্য হচ্ছে, যাদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক তদন্তে কোনো রকম প্রমাণ পাওয়া যাবে না, তাদের বিচার শুরুর আগেই মামলার তালিকা থেকে বাদ দিতে পারবে। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে কেউ যদি ভুয়া মামলা বা হয়রানিমূলক মামলার শিকার হন, তাদের বিচার শুরুর আগেই রেহাই দেওয়া।’

রেহাই পাবেন অনেক নিরপরাধ মানুষ
ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব শফিক জাগো নিউজকে বলেন, ‘অবিচার ও মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি থেকে মুক্তির জন্য মামলা তদন্তে অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনের বিধান একটি ভালো ব্যবস্থা হতে পারে। বর্তমানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হত্যার অভিযোগে একেক মামলায় শত শত আসামি করা হচ্ছে, তাতে এটা একটা সুবিধা হতে পারে। অনেক নিরপরাধ মানুষ হয়রানি থেকে রেহাই পাবেন। কিন্তু এই প্রতিবেদন যেন নতুনভাবে পুলিশের বাণিজ্যের পথ তৈরি না করে সেটিও খেয়াল রাখতে হবে।’

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মামলা বাণিজ্যের অনেক খারাপ অভিজ্ঞতা আছে উল্লেখ করে এই আইনজীবী বলেন, ‘অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন দেওয়ার ক্ষমতা থানার কোনো কর্মকর্তার কাছে না দিয়ে উচ্চ পর্যায়ের সম্পৃক্ততা রাখলে ভালো হবে।’

প্রথম মুক্তি পেল ফাইয়াজ
ফৌজদারি কার্যবিধির সংশোধিত ধারায় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রথম অব্যাহতি পেয়েছে সারাদেশে আলোচিত কলেজছাত্র হাসনাতুল ইসলাম ফাইয়াজ (১৭)।

গত বছরের ১৯ জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার রায়েরবাগ এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভকারী এবং পুলিশ, আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। এতে এক আন্দোলনকারী নিহত হন। এ সময় পুলিশ সদস্য গিয়াস উদ্দিনের মোটরসাইকেলের গতিরোধ করে তাকে পিটিয়ে হত্যার পর ফুটওভার ব্রিজে লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়। এ ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা হয়।

এ মামলায় পুলিশ আটজনকে গ্রেফতার করে। এর মধ্যে এজাহারভুক্ত ১৬ নম্বর আসামি করা হয় হাসনাতুল ইসলাম ফাইয়াজকে। পরে তাকে মাতুয়াইলের বাসা থেকে গ্রেফতার করে হাতে দড়ি বেঁধে আদালতে হাজির করা হয় এবং আদালত সাতদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

একজন অপ্রাপ্তবয়স্ককে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে হাজির করা এবং রিমান্ড মঞ্জুর করায় তখন সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনার সৃষ্টি হয়। পরে আদালত তাকে জামিন দেন।

গত ১৩ জুলাই সংশোধিত ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৩ (ক) ধারায় দাখিল করা অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা (ওয়ারী) বিভাগ কিশোর ফাইয়াজের অব্যাহতি আবেদন করে। এরপর ১৫ জুলাই অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন গ্রহণ করে আদালত তাকে অব্যাহতি দেন।

এর মধ্য দিয়ে সংশোধিত ফৌজদারি কার্যবিধিতে প্রথম কাউকে তদন্তাধীন মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) প্রসিকিউশন বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মাঈন উদ্দিন চৌধুরী।

তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনের আলোকে যাত্রাবাড়ী থানার হত্যা মামলায় ফাইয়াজকে অব্যাহতি দিয়েছেন আদালত। এতে অনেক হয়রানি কমবে এবং নির্দোষ ব্যক্তি ন্যায়বিচার পাবে এমনটাই আশা করছি।

তদন্তের সময় বেঁধে দেওয়া উচিত
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সংবিধান সংরক্ষণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও সিনিয়র অ্যাডভোকেট সৈয়দ মামুন মাহবুব জাগো নিউজকে বলেন, বলা হয়েছে যে প্রাথমিক অন্তর্বর্তী তদন্তে আসামিকে (ডিসচার্জ) অব্যাহতি দেওয়ার পর আবার তদন্তের পর যদি মামলার আইওর মনে হয় যে না আসামি ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তখন আবার তাকে চার্জশিটে যুক্ত করা যাবে। এ বিষয়ে আমি বিনয়ের সঙ্গে বলছি, এই চিন্তাটাই প্রো-পিপল (জনমুখী) না। বরং সামগ্রিকভাবে সংশোধন করা যেত। আইনে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময়সীমাকে সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া যেত। আর না হলে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া যাবে তা তুলে ধরলে ভালো হতো।

সৈয়দ মামুন মাহবুব বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন তদন্ত না করে আমরা আইনজীবীদের পক্ষ থেকে বলেছিলাম অহেতুক মামলার আসামি করে বিনা বিচারে নাগরিককে জেলে পাঠানো সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন। সুতরাং আইওর অন্তর্বর্তীকালীন চার্জশিটের খেলা না খেলে কোর্টে গেলে বিচারকের জামিন দেওয়ার চিন্তা করা উচিত।

আবার তদন্ত কর্মকর্তার সততা নিয়েও প্রশ্ন আছে বলে জানান সৈয়দ মামুন মাহবুব। তিনি বলেন, এ আইন তো পুলিশকে বিপথে পরিচালনার একটা পথ করে দিল। আমার মতে অন্তর্বর্তীকালীন অব্যাহতির দরকার নেই। তদন্তের একটা সময়সীমা বেঁধে দেওয়া বা বাধ্যতামূলক করা উচিত। কেননা আমরা দেখেছি সরকারের পক্ষের লোকের তদন্ত এক রকম আর সরকারবিরোধী ব্যক্তিদের তদন্ত বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ অনন্ত কাল ধরে চলে বা অন্য কোনোভাবে প্রভাবিত হয়ে আইওরা তদন্ত রিপোর্ট দেন না। চার-পাঁচ বছর অপ্রয়োজনীয়ভাবে মানুষকে হয়রানি করেন।

‘সংশোধিত ধারা সঠিকভাবে প্রয়োগ করলে তাতে জনগণের একটা প্রাথমিক লাভ হতে পারে যদি আইওরা আইন মান্যকারী কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। পক্ষপাতমূলক আচরণ না করলে হয়তো অনেক মানুষ দ্রুত অব্যাহতি পাবেন এবং জেল থেকে ছাড়া পেতে পারেন। কিন্তু আমাদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা বলে স্বাধীনতার পর থেকে পুলিশকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুলিশের কথা বহু আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। পুলিশ যদি এটাকে মনিকাঞ্চন হিসেবে ব্যবহার করে তা হলে জনগণের জন্য ডাবল বিপদ হবে। একবার হবে যে আমাকে অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন থেকে বাদ দাও, পরে আবার তদবির করতে হবে ফাইনাল চার্জশিটে আমাকে রেখো না।’ বলে মন্তব্য করেন সৈয়দ মামুন মাহবুব।

অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে তদন্ত করতে হবে
সাবেক ডেপুর্টি অ্যাটর্নি জেনারেল ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মাসুদ হাসান পরাগ জাগো নিউজকে বলেন, প্রাথমিক তদন্তে কোনো আসামির প্রাইমিং কেইস (প্রাথমিক সম্পৃক্ততা) পাওয়া না গেলে তাকে প্রাথমিক তদন্তে অব্যাহতি দেওয়া যায়। পরে পূর্ণাঙ্গ তদন্তকালে কোনো আসামির জবানবন্দিতে বা কোনো আসামির ১৬১ ধারার জবানবন্দিতে ওই আসামির নাম আসে, সেক্ষেত্রে চার্জশিট দিলে অব্যাহতি পাওয়া আসামি একটা বেনিফিট অব ডাউটের (সংশয়ের) সম্ভাবনা থাকে। এক্ষেত্রে তদন্ত কর্মকর্তাকে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে তদন্ত করতে হবে অন্যথায় সংশোধিত নতুন প্রক্রিয়ায় তদন্ত কাজটাই ব্যাহত হবে। যেহেতু তদন্ত হচ্ছে সে ক্ষেত্রে আরও ভালো হয় অল্প সময়ে দ্রুত মামলার তদন্ত শেষ করে পুলিশ রিপোর্ট দাখিল করে। যাতে দোষীদের ক্ষেত্রে অভিযোগ দেবে আর যারা নির্দোষ তাদের অব্যাহতি দেবে।

মাসুদ হাসান পরাগ বলেন, অল্প সময়ে মামলার তদন্ত শেষ করলে নতুন সংশোধিত এ ধারার প্রয়োগ করার প্রয়োজন পড়বে না। তা না হলে মামলার দীর্ঘসূত্রতা হবে। আর তা না করে এর ব্যতিক্রম হলে একটা ভালো দিকও আছে, আবার ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে।

ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে নতুন আশঙ্কা তৈরি হবে
সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট খাদেমুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৩ (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘অনাবশ্যক (বিনা কারণে) বিলম্ব ছাড়াই এই অধ্যায়ের অধীন তদন্ত শেষ করতে হবে।’ তবে এ ধারার ব্যাখ্যায় মামলার তদন্ত শেষ করার নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা আইনে উল্লেখ করা হয়নি। যে কারণে দণ্ডবিধি আইনের অপরাধের ক্ষেত্রে থানায় মামলা হওয়ার পর কোনো কোনো ক্ষেত্রে বছরের পর বছর সময় পার হয়ে যায়। অথচ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন বা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মতো বিশেষ আইনে একই পুলিশ অল্প সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। এখন এই আইনের ১৭৩ (ক) ধারা যুক্ত করে অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন বা অগ্রগতি প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে আসামিকে অব্যাহতি দেওয়ার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে মামলার চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের ক্ষেত্রে পুলিশের আরও অনীহা বাড়বে। সেক্ষেত্রে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা পুলিশের ওপর অনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে মাঝপথে অব্যাহতি নেওয়ার চেষ্টা করবে। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশের হাতেও অনৈতিকভাবে কোনো আসামিকে অব্যাহতি দেওয়ার সুযোগ থাকবে। এটি ভুক্তভোগী ব্যক্তি বা বিচারপ্রার্থীর ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে নতুন আশঙ্কা তৈরি হবে।

সেক্ষেত্রে সরকার এই অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনের বিধান না করে ১৬৭ ধারায় উল্লেখিত ‘অনাবশ্যক (বিনা কারণে) বিলম্ব ছাড়া’ কথাটি একটা সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বেঁধে দিতে পারতো বলে মনে করেন অ্যাডভোকেট খাদেমুল ইসলাম। তিনি বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারায় জামিন অযোগ্য মামলায় ১২০ দিনে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে না পারলে জামিনের বিষয় বিবেচনার সুযোগ আদালতকে দেওয়া হয়েছে। সংশোধিত আইনে তদন্তের জন্য ১২০ দিন সময় বেঁধে দেওয়া যেতো। এ সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে না পারলে সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করে সর্বোচ্চ ৬০ দিনের জন্য এ সময়সীমা বাড়ানোর সুযোগ দেওয়া যেতো। তখন তদন্ত কর্মকর্তা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে না পারলে তা বিভাগীয় অসদাচরণ হিসেবে শাস্তিযোগ্য বলে নির্ধারণ করে দেওয়া যেতো। সেক্ষেত্রে বিচারপ্রার্থী ব্যক্তি দ্রুত ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ যেমন পেতো, তেমনি নির্দোষ লোকও মামলার ঘানি টানা থেকে বাঁচতো।