চুয়াডাঙ্গায় মসজিদে ইমামতির পাশাপাশি একটি কওমি মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবে এলাকায় বেশ সম্মানজনক অবস্থান ছিল মাওলানা আব্দুস সামাদের। কিন্তু পতিত আওয়ামী সরকারের সময়ে র্যাবের জঙ্গি নাটকের নামে বর্বর নির্যাতনে পাল্টে যায় তার জীবন। গ্রামের বাড়ি থেকে নিজ কর্মস্থলে যাওয়ার পথে তাকে অপহরণ করে সাদা পোশাকধারীরা।তিন দিন গুম রেখে নির্মম নির্যাতনের পর সাভার থানায় মামলা দিয়ে হাজির করা হয় হরকাতুল জিহাদ (হুজি) নেতা হিসেবে। পর্যায়ক্রমে ১৪ দিন রিমান্ডে নিয়ে তাকে বিদ্যুতের শক দিয়ে জঙ্গি হিসেবে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা চালানো হয়। সম্পূর্ণ বিনা অপরাধে দেড় বছর জেল খেটেছেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ চুয়াডাঙ্গা জেলার এই সভাপতি। এতে শারীরিক, পারিবারিক, সামাজিক ও আর্থিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তিনি।
আওয়ামী সরকারের সময়ে আলেম-ওলামাদের ওপর জুলুম-নির্যাতনের অন্যতম সাক্ষী মাওলানা আব্দুস সামাদ। র্যাবের হাতে অপহরণ, গ্রেপ্তার আর জঙ্গি নাটকে লোমহর্ষক নির্যাতনের কিছু তথ্য তুলে ধরেছেন আমার দেশে-এর কাছে। এ বিষয়ে এরই মধ্যে বর্তমান সরকার গঠিত গুম কমিশনকে লিখিতভাবে বিস্তারিত জানিয়েছেন তিনি।চুয়াডাঙ্গা জেলা ওলামা পরিষদের এই সহসভাপতি জানান, ২০১১ সালের ২৩ মে নিজ গ্রাম চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা থানার দর্শনার লোকনাথপুর থেকে মোটরসাইকেলে সিঅ্যান্ডবিপাড়ার চুয়াডাঙ্গা আদর্শ মহিলা কওমি মাদরাসায় যাচ্ছিলেন।সকাল ১০টার দিকে জয়রামপুর কাঠালতলা থেকে কয়েক শ গজ দূরে পুকুরের কাছে পৌঁছালে পেছন থেকে সাদা মাইক্রোবাস এসে তার গতিরোধ করে। কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে কয়েকজন নেমে তাকে জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। সেখান থেকে অনেক দূরে গাড়ি চালিয়ে অজানা স্থানে নিয়ে তিন দিন গুম রেখে অমানবিক নির্যাতন চালায়।
একরাতে গাড়িতে অনেক জায়গায় ঘুরিয়ে ভোরবেলায় সন্ত্রাসী অভিযানের নাটক করে এবং সেখান থেকে র্যাব-১-এ নিয়ে যাওয়া হয় আব্দুস সামাদকে। সেখানে চোখ খুলে এক হলরুমে নিয়ে আগে থেকে সাজানো বিভিন্ন মালামালের টেবিলের সামনে দাঁড় করানো। একইভাবে তার পাশে ছিল আরও একজন আসামি। সামনে ছিলেন অনেক সাংবাদিক। তবে কারও সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়নি তাকে। এরপর সাভার থানায় নিয়ে ২৬ মে সন্ত্রাসবিরোধী ধারায় দুটি মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।আব্দুস সামাদ জানান, গুমের পর তিন দিনের নির্যাতনে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। সাংবাদিকদের সামনে হাজির করার সময় তিনি ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছিলেন না। তার অবস্থা দেখে প্রথমে থানা-পুলিশ তাকে রিসিভ করতে রাজি হয়নি। পরে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে চিকিৎসা দিয়ে প্রেসক্রিপশনসহ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে র্যাব।
অপহরণ-গুম ও রিমান্ডে নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে মাওলানা আব্দুস সামাদ বলেন, ‘আমাকে জোর করে গাড়িতে তোলার পর আমি “বাঁচাও বাঁচাও” বলে খুব জোরে চিৎকার করতে থাকি।আমার চিৎকারে পেছন থেকে কয়েকজন লোক আসার আগেই তারা দ্রুত গতিতে আমাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে সিটের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে ফেলে। অন্য একজন গামছা দিয়ে নাক ও মুখ এমনভাবে বাঁধে যে আমি মারা যাওয়ার উপক্রম হয়ে জোরে নড়াচড়া শুরু করি, তখন একটু নাকের বাঁধন হালকা করে দিয়ে মাথায় মোটা কালো টুপি পরিয়ে দেয়।’হাত পেছনে দিয়ে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে দুই পাশে দুজন অস্ত্র ঠেকিয়ে বলে, কোনো ধরনের নড়াচড়া এবং কথা বললেই গুলি করে মেরে ফেলব এবং তোর লাশও কেউ খুঁজে পাবে না। তাদের পরিচয় এবং এভাবে আটকের কারণ জানতে চাইলে তারা বলে, আস্তে আস্তে সব জানতে পারবি। এ সময় আমার পকেটে থাকা মাদরাসার টিন কেনার জন্য রাখা ২১ হাজার টাকা ও মোবাইল বের করে নেয়।
তিনি জানান, পরে এক রুমে নিয়ে চেয়ারে বসিয়ে হাত ও পায়ের বৃদ্ধ আঙুলে বিদ্যুৎ সংযোগ লাগিয়ে শক দিতে থাকে আর বলে ৪ এপ্রিল (২০২৩) মুফতি আমিনীর ডাকা হরতাল করেছিস কেন? আমি বললাম, আমি তো ওদিন শহরেই যাইনি। এরপর অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতে থাকে এবং বিদ্যুতের শক দিতে থাকে। একপর্যায়ে আমি বেহুঁশ হয়ে যাই। কতক্ষণ পর হুঁশ হয়েছে তা বুঝতে পারিনি।পরে তাকে একটা লোহার রডের সঙ্গে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে জমটুপি পরিয়ে রেখে দেওয়া হয়। রুমের মধ্যে এবং টয়লেটেও ক্যামেরা লাগানো ছিল। তাকে যে রুমে রাখা হয়েছিল, সেখানে নিয়মিত বিমান ওঠানামা ও রাস্তায় গাড়ি চলাচলের শব্দ পাওয়া যেত। ওই ঘর থেকে আশপাশে আরও অনেকের চিৎকারের শব্দ শোনা যায়। টয়লেটে যাতায়াতের সময় কারও কারও সঙ্গে কথা হলে তারা দীর্ঘদিন ধরে সেখানের নির্যাতনের শিকারের কথা জানায়।
আব্দুস সামাদ জানান, গুম করে রাখার সময় তাকে নির্যাতনের একপর্যায়ে জিজ্ঞাসা করত, আফগানিস্তান গিয়েছি কি না? তাদের পছন্দমতো জবাব না পেয়ে কিছু সাদা কাগজে স্বাক্ষর করতে বলে। স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানালে আমাকে শেষ করে দেওয়ার হুমকি দেয়। তারা জোরাজুরির একপর্যায়ে সাদা কাগজে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করে।ওই স্বাক্ষর নেওয়ার পর তারা রাতে গাড়িতে তুলে বহু রাস্তা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ফজরের আজানের পর একটি মসজিদের পাশে টিনশেড ঘরে নিয়ে যায় তাকে। সেখান থেকেই কয়েকজন র্যাব সদস্যকে পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন। তাকে নিয়ে একটি রুমে দাঁড় করিয়ে ছবি তোলা হয়।তারপর ওখান থেকে চোখ বেঁধে গাড়িতে করে বড় বিল্ডিংয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে জানতে পারেন সেটা ছিল র্যাব হেডকোয়ার্টার। সেখানে অনেক ক্যামেরাসহ সাংবাদিকরা দাঁড়ানো ছিলেন। তাদের টেবিলের সামনে বিস্ফোরকসহ অনেক মালপত্র সাজানো ছিল।
সেখানে র্যাবের একজন অফিসার ব্রিফিং করে জানান, তারা নাকি জঙ্গি কাজের জন্য সাভার এলাকায় অবস্থান করছিলেন। গোপন সংবাদ পেয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা সাংবাদিকদের কিছু বলতে চাইলে কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। পরে ২৬ মে র্যাব হেডকোয়ার্টার থেকে গাড়িতে করে সাভার থানায় নিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী ধারায় দুটি মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।আব্দুস সামাদ জানান, মামলার পর আদালতের মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়াদে ১৪ দিন রিমান্ডে নেয় সাভার থানা-পুলিশ। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলা অবস্থায় আবার র্যাব তাদের হেফাজতে নিয়ে যায় এবং আগের সেই জায়গায় পাঁচ-সাত দিন রিমান্ডের নামে অমানবিকভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতে থাকে। পরে কোর্টে ওঠালে জেলখানায় পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রথম এক বছর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ও পরে কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে রাখা হয় তাকে।
জেলজীবনে ভয়াবহ কষ্টের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, তাকে রাখা হতো ফাঁসির আসামিদের সেলে। স্বাভাবিক বন্দিদের মতো চলাফেরার কোনো সুযোগ তিনি পেতেন না।এদিকে গ্রেপ্তার-বন্দিত্বের ব্যাপক প্রভাব পড়ে আব্দুস সামাদের পরিবারেও। গ্রেপ্তারের সময় তার স্ত্রী ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। তিন মাস পর মেয়ের জন্ম হয়। এ সময় পরিবারের সদস্যদের চরম মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। তা ছাড়া বিভিন্ন সময় খোঁজখবরের নামে বাড়িতে হানা দিত র্যাব ও পুলিশ। এতে পর্দানশিন স্ত্রী বিপাকে পড়তেন।প্রায় দেড় বছর হাজত খাটার পর ২০১২ সালের ১৮ অক্টোবর হাইকোর্টের জামিনে মুক্ত হন আব্দুস সামাদ। তবে এরই মধ্যে একটি মামলায় বেকসুর খালাস পেলেও আরেক মামলায় নিয়মিত ঢাকা জজকোর্টে হাজিরা দিচ্ছেন তিনি। এসব মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে শারীরিক-মানসিক হয়রানিসহ বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। এতে তার ২৬ লাখ ৪৬ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে তিনি গুম কমিশনকে জানিয়েছেন।রিমান্ডে ও জেলজীবনে ব্যাপক কষ্টের ধকল এখনও বইতে হচ্ছে মাওলানা আব্দুস সামাদকে। তিনি বলেন, কোমরের নিচে ও হাঁটুর ওপরের অংশে এখনও অবশ অবস্থা। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন এটা সারতে দীর্ঘ সময় লাগবে।