যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণায় রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধ বন্ধের অঙ্গীকার করে ভোট চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, তিনি যুদ্ধ করতে যাচ্ছেন না, যুদ্ধ বন্ধ করতে যাচ্ছেন। এতে অনেকেই আশাবাদী হয়েছিলেন ইউক্রেন ও গাজায় যুদ্ধ বন্ধ হবে। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে, নতুন রূপে আবির্ভূত হচ্ছেন তিনি। সম্প্রতি কানাডা, গ্রিনল্যান্ড ও পানামা খাল নিয়ে ট্রাম্প যেসব মন্তব্য করছেন, তাতে অনেকের মনে সংশয় দেখা দিচ্ছে, বিশ্বে নতুন করে উত্তেজনা ছড়াবে। গ্রিনল্যান্ডকে কেন্দ্র করে ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনা বাড়ছে। সেই সঙ্গে কানাডার সঙ্গেও দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। সংঘাতের ঝুঁকি আছে পানামা খাল দখল নিয়েও।
আগামী ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন ট্রাম্প। তবে ইতোমধ্যেই তাঁকে কেন্দ্র করে বিশ্বজুড়ে উত্তেজনার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে ডেনমার্কের নিয়ন্ত্রণে থাকা গ্রিনল্যান্ড ও পানামা খাল দখলে বল প্রয়োগের ইচ্ছা প্রকাশ, অর্থনৈতিকভাবে কানাডাকে চাপে ফেলা ও রাজ্যে পরিণত করার আকাঙ্ক্ষার কারণে তিনি বিতর্কের কেন্দ্রে আছেন। গাজায় গণহত্যা ও ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্পের অঙ্গীকার নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
গ্রিনল্যান্ড নিয়ে এরই মধ্যে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ইউরোপ। ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ‘ইউরোপের সার্বভৌম সীমানা’ লঙ্ঘনের চেষ্টার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যঁ-নোয়েল ব্যারট গত বুধবার ফ্রান্সের ইন্টার রেডিওকে বলেন, বিশ্বের অন্য কোনো দেশকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের অংশ দিয়ে দেবে– এটা হওয়ার নয়। ফরাসি মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা নতুন যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছি, যেখানে আবারও শক্তিমানদের প্রত্যাবর্তন দেখতে পাব।’ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে জার্মানিও। জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী নেতৃত্বের তরফ থেকে ‘নিশ্চিতভাবে দুর্বোধ্য’ কিছু বক্তব্য আসছে। দেশের সীমান্ত লঙ্ঘন না করার নীতি সব দেশের জন্য কার্যকর, হোক সে ছোট কিংবা শক্তিশালী দেশ।
ডেনমার্ক, জার্মানি ও ফ্রান্স– এ তিন দেশই পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য। এর আগে ৫৭ হাজার বাসিন্দার গ্রিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মিউট এগডে ও ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মিট্টি ফ্রেডরিকসন বলেন, গ্রিনল্যান্ডের মানুষ তাদের ভবিষ্যতের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
গত মঙ্গলবার ট্রাম্প ফ্লোরিডার পাম বিচে তাঁর বাড়ি মার-এ-লাগোতে সংবাদ সম্মেলন করেন। এ সময় তিনি মেক্সিকো উপসাগরের নাম পাল্টে ‘আমেরিকা উপসাগর’ করার ইচ্ছার কথা জানান। সেই সঙ্গে কথিত জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে ৮ লাখ ৩৬ হাজার বর্গমাইল বিস্তৃত বিশ্বের সবচেয়ে বড় দ্বীপ গ্রিনল্যান্ড দখলে নিতে বল প্রয়োগের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেননি। ৫১ মাইল দীর্ঘ পানামা খাল দখলের আকাঙ্ক্ষা পুনর্ব্যক্ত করেন।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামী চার বছর যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা কেমন হতে যাচ্ছে, ট্রাম্পের এ সংবাদ সম্মেলনে তারই ইঙ্গিত রয়েছে। ট্রাম্প ফিরছেন, সেই সঙ্গে বিশৃঙ্খলাও ফিরছে। এরই মধ্যে ডেনমার্ক তাদের নিয়ন্ত্রণের অঞ্চল দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্পের কাছে জানতে চাওয়া হয়– তিনি কানাডা দখল করে নেবেন কিনা? জবাবে ট্রাম্প বলেন, তিনি অর্থনৈতিকভাবে চাপ প্রয়োগ করবেন। এর প্রতিক্রিয়ায় কানাডার বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেন, দুই দেশ এক হওয়ার ক্ষীণ সম্ভাবনাও নেই।
সিএনএনের প্রতিবেদনে ট্রাম্পের গ্রিনল্যান্ড, কানাডা ও পানামা খাল দখলের উচ্চাভিলাষকে ‘সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এ ভাবনা তাঁর ‘সম্প্রসারণের মনোভাব’ থেকে এসেছে। জনস হপকিনস স্কুল অব অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহবিষয়ক অধ্যাপক হাল ব্র্যান্ডস বলেন, পানামা খাল ও গ্রিনল্যান্ড দখলের হুমকি দেওয়ার মাধ্যমে ট্রাম্প যে বার্তা দিচ্ছেন, এটা তাঁর ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিরই প্রতিফলন। ট্রাম্প তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদে যেভাবে ফিরে আসছেন, তাতে মনে হচ্ছে, তিনি বৈশ্বিক সাম্রাজ্যবাদের বদলে মহাদেশীয় সম্প্রসারণবাদকে গ্রহণ করেছেন।
নতুন সংঘাতের দিকে এগোনোয় মধ্যপ্রাচ্যের গাজায় গণহত্যা ও ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্পের অঙ্গীকার নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। তিনি আদৌ যুদ্ধ থামাতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে মঙ্গলবারের সংবাদ সম্মেলনে তিনি এক পক্ষ নিয়ে ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সংগঠন হামাসকে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন, ২০ জানুয়ারি তাঁর শপথের আগে হামাস যদি জিম্মিদের মুক্তি না দেয়, তাহলে তিনি মধ্যপ্রাচ্যকে নরক বানিয়ে দেবেন। তবে যুদ্ধবিরতির আলোচনায় আঘাত করতে চান না বলেও মন্তব্য করেন।