
ইসলাম আমাদের জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়কে সুনির্দিষ্টভাবে পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছে। আমরা যখন ইসলামের বিভিন্ন শিক্ষা পড়ি, তখন কখনো কখনো কিছু নির্দেশনা আমাদের আধুনিক মানসিকতায় অপ্রাসঙ্গিক বা অতিরিক্ত সংবেদনশীল মনে হতে পারে। কিন্তু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এসব নির্দেশনার মধ্যে লুকিয়ে আছে অসাধারণ দূরদর্শিতা, মানবিকতা এবং পরিশীলিত সামাজিক বোধ। এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো কাঁচা পেঁয়াজ ও রসুন খাওয়ার পর মসজিদে না যাওয়ার বিষয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশনা। এই শিক্ষা একদিকে স্বাস্থ্যসচেতনতার পাঠ দেয়, অন্যদিকে সামাজিক শিষ্টাচার ও ধর্মীয় স্থানের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের এক মর্মস্পর্শী দৃষ্টান্ত।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কাঁচা পেঁয়াজ ও রসুন খায়, সে যেন আমাদের মসজিদের ধারে না আসে, কেননা এর দুর্গন্ধ আমাদের কষ্ট দেয়। আর মানুষ যেসব জিনিসের গন্ধে কষ্ট পায়, ফেরেশতারাও তাও পছন্দ করে না। যদি কোনো কারণবশত খেতেও হয়, তখন রান্নার মাধ্যমে এর দুর্গন্ধ দূর করে খাবে।’ (মুসলিম : ১১৪৭)
এই বাণীগুলোয় রয়েছে গভীর তাৎপর্য। ইবাদত শুধু আল্লাহর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয় নয়, এর সঙ্গে জড়িত আছে আশপাশের মানুষের প্রতি দায়িত্ব ও শ্রদ্ধাবোধ। মসজিদ হলো সম্মিলিত ইবাদতের কেন্দ্র, যেখানে মুসল্লিরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নামাজ আদায় করেন। এই আন্তরিকতার পরিবেশে একজনের মুখ থেকে আসা দুর্গন্ধ অন্যের মনোযোগে বিঘ্ন ঘটাতে পারে, যা ইবাদতের আধ্যাত্মিকতাকে নষ্ট করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) এই সূক্ষ্ম বিষয়ে দৃষ্টি দিয়ে আমাদের শিখিয়েছেন, আমাদের আচরণ যেন অন্যের জন্য অস্বস্তির কারণ না হয়।
এই নির্দেশনা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সহজেই প্রাসঙ্গিক। ধরুন, আপনি দুপুরে কাঁচা পেঁয়াজ দিয়ে খাবার খেয়ে আসরের সালাত আদায় করতে মসজিদে গেলেন। হাদিসটা জানার সুবাদে আপনি ভালোভাবে ব্রাশ করে বা মাউথওয়াশ ব্যবহার করে গিয়েছেন মসজিদে। কিন্তু এরপরও আপনার শরীরে থেকে যেতে পারে কাঁচা পেঁয়াজ-রসুন খাওয়ার প্রভাব! কীভাবে?
বিজ্ঞান কী বলে এ বিষয়ে?
কাঁচা পেঁয়াজ ও রসুনের তীব্র গন্ধের জন্য দায়ী এর মধ্যে থাকা সালফারযুক্ত যৌগ, যেমন অ্যালিসিন, ডায়ালাইল ডিসালফাইড এবং অ্যালাইল মারক্যাপটান। এই যৌগগুলো খাওয়ার পর শরীরে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে তীব্র গন্ধ তৈরি করে। এই গন্ধ শুধু মুখে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং রক্তপ্রবাহে মিশে ঘাম, নিঃশ্বাস এবং প্রস্রাবের মাধ্যমেও বের হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, কাঁচা রসুন বা পেঁয়াজ খাওয়ার পর শরীরের নিঃসরণে এই যৌগগুলো তীব্র গন্ধ ছড়ায়, বিশেষ করে গরম আবহাওয়ায় বা নামাজের সময় শরীর গরম হলে এটি আরো প্রকট হয়। (শরীরের গন্ধের রসায়ন : সালফার যৌগ থেকে বিপাকীয় নিঃসরণ, জাতীয় জৈবপ্রযুক্তি তথ্যকেন্দ্র, ২০২০)
অনেক সময় আমরা নিজের শরীরের গন্ধ টের না পেলেও, পাশের মানুষ তা সহজেই টের পান। মসজিদের মতো একটা আধ্যাত্মিক পরিবেশে এই গন্ধ অন্যের জন্য বিরক্তির কারণ হতে পারে। ঠিক এ কারণেই রাসুলুল্লাহ (সা.) এ বিষয়ে সতর্ক করেছেন, যা আজ বিজ্ঞানও প্রমাণ করছে।
রান্না করে খেলে তখন সমস্যা হয় না কেন?
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশনায় রয়েছে অসাধারণ দূরদর্শিতা। তিনি পেঁয়াজ বা রসুন খাওয়াকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করেননি, বরং কাঁচা অবস্থায় এর দুর্গন্ধের প্রভাব এড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, যখন পেঁয়াজ বা রসুন ৭০-৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপে মাত্র ৫ মিনিট রান্না করা হয়, তখন তীব্র গন্ধযুক্ত সালফার যৌগ, যেমন অ্যালিসিন, ভেঙে নিরীহ জৈব সালফার যৌগে রূপান্তরিত হয়। এই যৌগগুলোর গন্ধ প্রায় থাকে না বা খুবই নগণ্য থাকে। (রসুনের অ্যালিসিন ও জৈব সালফার যৌগের তাপজনিত ক্ষয়, কৃষি ও খাদ্য রসায়ন সাময়িকী, ২০১৬)
ইসলামের প্রতিটি শিষ্টাচারমূলক নির্দেশনার মূল লক্ষ্য হলো একটি সুন্দর, পরিপাটি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাজ গঠন। রাসুলুল্লাহ (সা.) শুধু মসজিদের পরিবেশ নয়, বরং সর্বত্র পরিচ্ছন্নতা ও সৌন্দর্য বজায় রাখার আদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অর্ধেক।’ (মুসলিম : ২২৩) তিনি আরো উৎসাহ দিয়েছেন সুগন্ধি ব্যবহারে, দাঁতের যত্নে এবং মিসওয়াকের ব্যবহারে। তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সুগন্ধি ব্যবহার করে, তার প্রতি আল্লাহর রহমত নাজিল হয়।’ (তিরমিজি : ২৭৮৮)
এই শিক্ষাগুলো শুধু বাহ্যিক পরিচ্ছন্নতার জন্য নয়, বরং মনের পরিশুদ্ধি ও সামাজিক সৌজন্যের প্রতিফলন। আপনার কাছ থেকে এ রকম দুর্গন্ধ শুধু অন্যের ইবাদতের ক্ষতিই করে না, বরং আপনার প্রতিও তার মনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হতে পারে। অথচ একটু সচেতনতা এই পরিস্থিতি এড়াতে পারে। এই সূক্ষ্ম শিক্ষা ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও ব্যবহারিকতার প্রমাণ।
এই হাদিসের শিক্ষা শুধু মসজিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আজকের দিনে আমরা অফিসে, ক্লাসরুমে, বাসে, ট্রেনে বা সামাজিক অনুষ্ঠানে একত্র হই। এই পরিবেশে ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা ও সৌজন্যবোধ আরো গুরুত্বপূর্ণ। আপনার কাঁচা পেঁয়াজ বা রসুন খাওয়ার মতো ছোট্ট একটা কাজ শুধু তাদের সঙ্গে আপনার সম্পর্কে প্রভাব ফেলে না, বরং পেশাগত বা সামাজিক পরিবেশেও অস্বস্তি সৃষ্টি করে। ইসলাম আমাদের শিখিয়েছে : ‘তোমাদের কেউ যেন অন্য ভাইয়ের জন্য এমন কিছু না করে, যা সে নিজেও অপছন্দ করে।’ (বোখারি : ১৩) এই শিক্ষা আমাদের সামাজিক জীবনে সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে প্রেরণা দেয়।
আধুনিক বিজ্ঞান ও ইসলামের সামঞ্জস্য
১৪০০ বছর আগে রাসুলুল্লাহ (সা.) যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তা আজ আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকেও প্রাসঙ্গিক। সালফার যৌগের গন্ধ এবং রান্নার মাধ্যমে তা দূর করার বিষয়টি বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে। এটি আমাদের জন্য একটি শিক্ষা—ইসলামের শিক্ষা শুধু আধ্যাত্মিক নয়, বরং বাস্তব জীবনের জন্য অত্যন্ত ব্যবহারিক। আমাদের গ্রামবাংলায় পেঁয়াজ-রসুন খাওয়া খুবই সাধারণ। অনেকে কাঁচা পেঁয়াজ দিয়ে ভাত খান বা রসুন দিয়ে মাছের ঝোল তৈরি করেন। কিন্তু বাইরে যাওয়ার আগে একটু সচেতনতা আমাদের ইবাদতকে আরো পবিত্র ও সম্মানজনক করে তুলতে পারে।
সূক্ষ্ম সচেতনতা, বড় ইবাদতের অংশ
ইবাদতের পরিপূর্ণতা শুধু নামাজ পড়ে নয়, বরং এর সঙ্গে জড়িত মানসিক প্রশান্তি, মনোযোগ এবং পরিবেশের ওপর নির্ভর করে। কাঁচা পেঁয়াজ-রসুন খাওয়ার পর মসজিদে না যাওয়ার শিক্ষা আমাদের বোঝায়—ইবাদত মানে শুধু আত্মিক সংযোগ নয়, বরং সামাজিক সহানুভূতির বাস্তব প্রতিফলন। আমার ছোট আচরণ অন্যের বড় অসুবিধার কারণ হতে পারে, এ সচেতনতাই ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব।
লেখক : শিক্ষার্থী, তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়