Image description
ঐকমত্য কমিশন » চলতি মাসেই জুলাই সনদ ঘোষণা করতে চায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন । » মতৈক্য না হলে থাকছে ‘ নোট অব ডিসেন্ট ’ নেওয়ার সুযোগ । » মঙ্গলবারের মধ্যে দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ শেষ করবে কমিশন ।

জুলাই অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দুটি কাজের একটি হলো , রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কারের একটি রূপরেখা দেওয়া ; যেটি জাতীয় সনদ আকারে ঘোষণা করা হবে । এই লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন চলতি মাসেই ‘ জুলাই সনদ ’ নামে এই জাতীয় সনদ দেওয়ার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে । এ ক্ষেত্রে সংস্কার প্রস্তাবের সব বিষয়ে রাজনৈতিক মতৈক্য না হলে ‘ নোট অব ডিসেন্ট ' বা ভিন্নমত পোষণের সুযোগ রেখেই জাতীয় সনদ ঘোষণা করতে চায় কমিশন । সে অনুযায়ী প্রস্তুতি চলছে বলে কমিশন সূত্রে জানা গেছে । সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় । বৈঠকে জুলাই সনদ তৈরির প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও দৃশ্যমান রাখার নির্দেশনা দেন কমিশনের সভাপতি ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড . মুহাম্মদ ইউনূস । রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক কাঠামোর সংস্কার এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই বলেও জানান তিনি । বৈঠকে ঐকমত্য কমিশনের কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে

প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করা হয় । দ্রুততম সময়ের মধ্যে জুলাই সনদ তৈরির কাজ সম্পন্ন করতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চলছে বলে কমিশনের সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টাকে জানান । জাতীয় সূত্রগুলো বলছে , প্রতিদিনের সংলাপের আলোকে জুলাই সনদ প্রণয়নের কাজ চলছে । সনদে সংবিধান , বিচার বিভাগ , নির্বাচন ব্যবস্থা , জনপ্রশাসন , দুর্নীতি দমন ও পুলিশ সংস্কার কমিশনের ১৬৬ টি প্রস্তাবের মধ্যে দলগুলো কোন কোন বিষয়ে একমত থাকবে ; তার উল্লেখ থাকবে । কোন দল কোন প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছে , তা - ও বলা থাকবে । সরকারের ঘোষিত মৌলিক সংস্কারের অধিকাংশ প্রস্তাব সংবিধান - সম্পর্কিত হওয়ায় সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলো সনদে শুরুতেই রাখা হবে । ঘোষণার আগে সনদের খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হবে । এরপর দলগুলোর স্বাক্ষর নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জুলাই সনদ ঘোষণা করা হবে ।

জুলাই সনদকে ঘিরে রাজনৈতিক চাপ বাড়তে পারে , এমনটি মনে করছে সরকার । এ কারণে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে সনদটি ঘোষণা করতে চায় তারা । এই লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কাজ করছে । কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এ নিয়ে অধিকতর আলোচনা করবে । সনদের খসড়া দলগুলোকে দেওয়ার পর দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে গণ - অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের পরিবারসহ বসার পরিকল্পনা রয়েছে কমিশনের । প্রয়োজনে সেখানে দুই পক্ষের প্রত্যাশা ও বক্তব্য নেওয়া হবে , যা বাংলাদেশ টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে । রাষ্ট্র সংস্কারে গত বছর প্রথম দফায় ছয়টি কমিশন করে সরকার ।

সেগুলো হলো—সংবিধান সংস্কার কমিশন , বিচার ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন , নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন , জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন , দুদক সংস্কার কমিশন ও পুলিশ সংস্কার কমিশন । গত ফেব্রুয়ারির শুরুতে ছয়টি কমিশন তাদের পূর্ণাঙ্গ মতামত সরকারের কাছে তুলে ধরে । এর ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিয়ে সংস্কার বাস্তবায়নে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ছয় মাস মেয়াদি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয় । আগামী ১৫ আগস্ট ওই কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে । কমিশন প্রথম ধাপে ৩৩ টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে ৪৫ টি অধিবেশনে পৃথক সংলাপ করে ।

দ্বিতীয় ধাপে ১৮ দিনে ৩০ টি দল ও জোটের সঙ্গে বিষয়ভিত্তিক সংলাপ শুরু করে । সেখানে মৌলিক ১৯ টি বিষয়ে দলগুলোর মতামত নিচ্ছে । সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন , সংসদীয় স্থায়ী কমিটি , নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ , রাষ্ট্রপতির ক্ষমা - সম্পর্কিত বিধান , বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ , প্রধান বিচারপতি নিয়োগ , জরুরি অবস্থা ঘোষণা , সংবিধান সংশোধন এবং প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদের বিষয়ে এখন পর্যন্ত একমত হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো । এর মধ্যে ৭০ অনুচ্ছেদ ও প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদ নিয়ে ‘ নোট অব ডিসেন্ট ' দেবে বিএনপি । সংবিধান ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে পৃথক পৃথক প্রস্তাব দেয় কমিশন । সেখানে নির্বাচন কমিশন নিয়োগের বিধান সংবিধানে যুক্ত করার বিষয়ে একমত হয় দলগুলো । সরকারি কর্মকমিশন , মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক ,, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং ন্যায়পাল নিয়োগ বিধানের বিষয়ে আগামীকাল রোববার আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে । বিষয়গুলো সংবিধানে যুক্ত করার বিষয়ে দ্বিমত জানিয়েছে বিএনপি । এ জন্য এই আলোচনায় বিএনপি অংশ নেবে না বলে বৃহস্পতিবার দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ জানিয়ে দিয়েছেন ।

নিয়োগের বিধান সংবিধানে যুক্ত করাকে মৌলিক সংস্কার হিসেবে বলছে কমিশন । সংবিধান ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের স্বাধীনতার পথ নিশ্চিত করতে হবে । প্রকৃতপক্ষে এগুলো যাতে নির্বাহী বিভাগের করতলগত না থাকে , এমন ব্যবস্থা করতে হলে , তা অবশ্যই সাংবিধানিকভাবে করতে হবে । সে ক্ষেত্রে বাকি চার বিষয়ে বিএনপিকে নোট অব ডিসেন্ট দেওয়ার সুযোগ রাখা হবে । সংবিধান ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, সংখ্যানুপাতিকে ( পিআর ) উচ্চকক্ষ , সরাসরি নির্বাচনে সংসদে নারী আসন , এই তিন বিষয়ে ঐকমত্যে আসাকে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার । কিন্তু এই বিষয়গুলো নিয়ে এখনো ঐকমত্য হয়নি ।

এ ছাড়া সংসদ সদস্যদের একাধিক পদ, নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব ( অনুচ্ছেদ ৪৮ ( ৩ ) — এই তিন বিষয়ে এখনো কোনো আলোচনা হয়নি । জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ আজকের পত্রিকাকে বলেন , ছয়টি কমিশনের যেসব সুপারিশের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবে , তা জুলাই সনদে থাকবে । জুলাই সনদের প্রধান বিষয় হচ্ছে , বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোর ভবিষ্যতের পথরেখা নির্ধারণ করা । তিনি আরও বলেন , ‘ ইতিমধ্যে যেসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে , তা মীমাংসার জায়গায় যেতে হবে । আমরা আশা করি , দ্রুতই মীমাংসার জায়গায় যাওয়া যাবে । যেহেতু অনেকগুলো বিষয়ে সকলের মতামত জানা গেছে , এখন একটা সিদ্ধান্তের জায়গায় আসা সম্ভব বলে মনে করি । ” ঐকমত্য কমিশন রোববার থেকে মঙ্গলবারের মধ্যে দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ শেষ করতে চায় বলে জানা

গেছে । এ জন্য অতীতে আলোচনা হওয়া বিষয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত জানানো হবে । সেখানে টু দ্য পয়েন্টে দলগুলোকে আলোচনা করতে দেওয়া হবে । এখন পর্যন্ত আলোচনায় যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে , সেগুলো এবং ঐকমত্য না হওয়া বিষয়গুলো নিয়ে সনদের একটি খসড়া কমিশন তৈরি করছে বলে জানা গেছে । সেটা রোববার বা সোমবার দলগুলোকে দেওয়া হতে পারে বলে বলছে কমিশন । এদিকে উচ্চকক্ষের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাতে কমিশনকে দায়িত্ব দিয়েছে দলগুলো । কমিশনের পক্ষ থেকে ভোটের সংখ্যানুপাতিকে ( পিআর ) উচ্চকক্ষের বিষয়ে বলা হয়েছে , যার বিরোধিতা করছে বিএনপিসহ তার সমমনা পাঁচটি দল ও জোট । অন্যদিকে জামায়াত , এনসিপি , ইসলামী আন্দোলন , এবি পার্টি , গণসংহতি আন্দোলন , জেএসডি , বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি , গণঅধিকার পরিষদসহ ২১ টি দল পিআরের পক্ষে । জুলাই সনদ প্রণয়ন নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে । জুলাই সনদ ঘোষণা নিয়ে সংশয়ের কথা বলেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ ।

তিনি বলেছেন , “ জুলাই সনদ প্রণয়নের কার্যক্রম চলছে অত্যন্ত ধীরগতিতে । আমরা সংস্কার কমিশনকে বলেছিলাম , আগস্টের ৫ তারিখের আগে এটি প্রণয়ন করতে হবে । কিন্তু যে ধীরগতি লক্ষ করছি , তাতে আমার কাছে মনে হয় , এই সময়ের মধ্যে কি আপনারা এই কাজ করতে পারবেন ? ” জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন , ‘ আমরা জুলাই সনদের পক্ষে এবং জুলাই সনদ স্বাক্ষরিত হবেই । কারণ , যে পরিবর্তন , জীবন ও রক্ত আমরা দিয়েছি , এটার যদি কিছুই না হয় , আবার আগের জায়গায় ফিরে যায় , তাহলে তো এই ত্যাগ অর্থহীন হবে । ' জাতীয় নাগরিক পার্টির ( এনসিপি ) সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন , মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নের বিষয়টি জুলাই সনদে থাকতে হবে । তিনি বলেন , ‘ সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ- আলোচনার ভিত্তিতে ঐকমত্য কমিশন মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নের রূপরেখা দিয়ে জুলাই সনদ প্রণয়ন করবে । এই বাস্তবতা এখনো শেষ হয়নি । আমরা আশাবাদী । '