
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বেসরকারি খাতের প্রভাব প্রতিনিয়তই বাড়ছে। এর ফলে সরকারের ওপর কিছুটা চাপ কমছে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। সরকারি হিসাব বলছে, দেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ৭৪ শতাংশই মাসিক পে-অর্ডারের তালিকার বাইরে বা নন-এমপিও। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রয়েছেন সরকারি সুযোগ-সুবিধার বাইরে।
এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীলদের বেশিরভাগকেই মাস শেষে টানাটানি করে সংসার চালাতে হয়। ফলে শিক্ষার্থীদের মানসম্পন্ন শিক্ষা দিতে ইচ্ছা থাকলেও তারা পারেন না। বিশ্লেষকরা বলছেন, শিক্ষাব্যবস্থায় শুধু কথাসর্বস্ব উন্নয়নেই চলছে। এতে কারো মনোযোগ নেই। তবে কারো কারো মতে, বেসরকারি খাতের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শুধু লাভের আশায় প্রতিষ্ঠান খোলে, শিক্ষায় অবদানের জন্য নয়।
বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে জরিপ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। ‘বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জরিপ ২০২৪’ শিরোনামের এই জরিপে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চিত্র উঠে এসেছে। এর আগে এ ধরনের জরিপ পরিচালিত হয়েছিল ২০০৭ সালে। জরিপটি পরিচালনার লক্ষ্য হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ধরন অনুসারে বিস্তারিতভাবে ২০২২ ও ২০২৩ সালের ত্রৈমাসিক মূল্য সংযোজন প্রাক্কলন করা। শিক্ষা খাতের বর্তমান অবস্থা ও মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এর অবদান জানার জন্য এ জরিপটি তথ্য-উপাত্ত প্রস্তুত করেছে।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে বিভিন্ন ধরনের ৯২ হাজার ৩৯২ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলমান আছে। এর ম্যধ্যে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান মাত্র ২৬ হাজার ১০৪টি। এমপিওভুক্ত নয়Ñএমন প্রতিষ্ঠান ৬৬ হাজার ২৮৭টি, যা প্রায় ৭৪ শতাংশ। প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যক্তি বা অংশীদারত্ব মালিকানায় চলছে। তাছাড়া এসব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরেও দেশে মোট ৬ হাজার ৫৮৭টি কোচিং সেন্টার চালু রয়েছে।
উল্লেখ্য, সরকার পরিচালিত, নিয়ন্ত্রিত ও অর্থায়নকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অর্থাৎ সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এ জরিপে অন্তর্ভুক্ত নয়। যেসব প্রতিষ্ঠানের জরিপ করা হয়েছে, ওই প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যক্তি বা অংশীদারত্ব মালিকানা দ্বারা সংগঠিত, পরিচালিত বা তত্ত্বাবধান করা হয়। এগুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন শিক্ষামূলক কর্মসূচি, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা এবং একাডেমিক সাফল্যের জন্য কোচিং সেবা দেওয়া হয়। এটি উল্লেখ করা অপরিহার্য যে, কোচিং সেন্টারগুলো প্রচলিত সরকারি বা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো স্থায়ী শিক্ষাক্রম অনুসরণ করে না।
এসব প্রতিষ্ঠানের অবদানে দেশের জাতীয় আয়েও (জিডিপি) উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। বিবিএস ১৯ খাতের হিসাব করে থাকে। তার মধ্যে জিডিপিতে শিক্ষা খাতের অবদান ৩ শতাংশ। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের সংখ্যাও প্রতি প্রান্তিকেই বাড়ছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের খসড়া এডিপি অনুসারে, শিক্ষা খাতে ৯১টি প্রকল্পে চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৮ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা, যা গত এডিপির বরাদ্দ থেকে ২ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা কম। চলতি অর্থবছরের মূল এডিপিতে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল ৩১ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা। অন্যদিকে এ খাতের ৩৫টি প্রকল্পে চলতি অর্থবছরের বরাদ্দ রয়েছে ১৮ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা। গত এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ২০ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা।
এসব বেসরকারি খাতের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি অর্থায়নের বাইরে থাকায় কী ধরনের প্রভাব পড়ছেÑজানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠান তো সরকারি অর্থায়নে চলে; কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কিন্ডার গার্ডেন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত, তারা আয়ভিত্তিক কোর্স পরিচালনা করে। মাধ্যমিক পর্যায়ে সরকারি স্কুলের বেতন আর বেসরকারি স্কুলের বেতনক্রমের ব্যবধানও অনেক। সব সরকারি স্কুলে একই হারে বেতন পায়; কিন্তু বেসরকারি স্কুলে একই হারে পায় না। যেখানে কম টাকায় পড়ানো সম্ভব, সেখানে কমে পড়ানো হয়। এখানে একক নীতিমালা কাজ করে না।
ড. মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, তারা শুধু যেখানে আয় বেশি হবে, সে ধরনের কোর্স পরিচালনা করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আয়মুখী হওয়া উচিত নয়, এখানে জ্ঞান তৈরি হবে, ছেলেমেয়েরা জ্ঞান-দক্ষতা অর্জন করে যে যেখানে যোগ্য, সেখানে যাবে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সেটি কি না, তা দেখতে হবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের কাছ থেকে কোনো সহায়তা পায় না। তাই তারা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেশি হারে বেতন নেয়।
সরকার প্রতি বছর শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করে। কিন্তু তাও পর্যাপ্ত নয়। মোট বরাদ্দের ৪ শতাংশ মাত্র। সেটিও অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য। এত কম বিনিয়োগ শিক্ষা খাতের উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট কি নাÑএমন প্রশ্নে ড. মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, শিক্ষাব্যবস্থা শুধু কথাসর্বস্ব উন্নয়নেই চলছে। যেসব প্রতিষ্ঠানে সরকারের বরাদ্দ আছে, সেগুলোই তো ঠিকমতো চলছে না। গাড়ি চলে তো চলে না অবস্থা। শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষক-ছাত্রদের চ্যালেঞ্জ এত বেশি যে, তারাও চলতে পারছে না। এর মধ্যে শিক্ষিত জাতি গড়ে তোলা আরো বেশি চ্যালেঞ্জিং। এখানে বিনিয়োগকে বিনিয়োগের মতো করতে হবে। শিক্ষক-কর্মকর্তাদের জীবনের চাহিদা যুগোপযোগী করার পাশাপাশি তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
দেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে মোট ২৩ হাজার ৬৩৭টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (কোচিং সেন্টার বাদে) ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত হয়। অংশীদারত্বের ভিত্তিতে ১০ হাজার ৮৬২টি প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়। উল্লেখ্য, মোট ৬ দশমিক ২৬ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (৫৭৮২টি) ট্রাস্টি বোর্ড বা ফাউন্ডেশনের অধীনে পরিচালিত হয়। মোট ৪৯ হাজার ৬১৮টি বা ৫৩ দশমিক ৭০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদ বা ব্যবস্থাপনা কমিটির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়।
দেশের কোচিং সেন্টারগুলোর সিংহভাগই ব্যক্তিমালিকানায় চলছে। ৬৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ বা ৪ হাজার ৩১০টি ব্যক্তিমালিকানাধীন, যেখানে ৩০ দশমিক ৭৬ শতাংশ বা দুই হাজার ২৬টি প্রতিষ্ঠান অংশীদারত্বের মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন মোহাম্মদ রফিক উল্লাহ। তার অভিযোগ, তাদের প্রতিষ্ঠান নন-এমপিও হওয়ায় তারা অনেক দেরিতে বই পান। তারচেয়েও বড় কথা, সরকারের কাছে চাইলেও তাদের শিক্ষকদের কোনো প্রশিক্ষণ করাতে পারেন না। উপজেলা থেকে কোনো তদারকি নেই। ভবনের চাহিদা থাকলেও তারা পান না। তাছাড়া পাঠদানের অনুমোদনেও সরকার অনেক গড়িমসি করে থাকে।
রফিক উল্লাহ আরো বলেন, ‘ফলাফলের ক্ষেত্রেও সমস্যা রয়েছে। আমরা এমপিওভুক্ত হাইস্কুলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার আয়োজন করে থাকি। তারাও বিভিন্ন সময় তাদের মতো করে বিমাতাসুলভ আচরণ করে, তাদের মতো করে টাকা বাড়িয়ে নেয়।’
চলতি অর্থবছরের (২০২৫-২৬) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ১৫টি খাতের মধ্যে ১৪ খাতেই বরাদ্দ কমানো হয়েছে। এখানে উল্লেখযোগ্য আর চিন্তার বিষয় হচ্ছে, তিনটি খাত, যেমনÑশিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষিতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে টাকার অঙ্কে বরাদ্দ কমানো হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে পৃথিবীর যে ১০টি দেশ অর্থনীতির আকারের তুলনায় শিক্ষা খাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ দেয়, বাংলাদেশ তার একটি। অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা পেতে একজন বাংলাদেশির বছরে ৮৮ ডলার খরচ করা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে চিকিৎসা খাতে মাথাপিছু খরচ হয় ৫৮ ডলার, যার বড় অংশই নাগরিকরা নিজেরা সংস্থান করে থাকেন।