Image description

ছোট্ট আরিয়ান, ওমাইর আর বাপ্পির কবর পাশাপাশি। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এই তিন শিশুর এক নারী আত্মীয় আরেকজনের কাছে জানতে চাইলেন, মাঝেরটা কি বাপ্পির কবর?

আরিয়ানের দাদি রাবেয়া খাতুন লাঠিতে ভর দিয়ে এসে কবরগুলোর কাছে দাঁড়ালেন। চোখ মুছলেন। একা একাই বললেন, ‘আল্লাহ আমারে না নিয়া এই তিন অবুঝ শিশুরে কেন নিল? ওদের তো যাওয়ার বয়স হয় নাই।’

আরিয়ান, ওমাইর আর বাপ্পি নিকটাত্মীয়। একসঙ্গে হেসেখেলে বড় হচ্ছিল তারা। পড়ত মাইলস্টোন স্কুলে। গত সোমবার স্কুলটিতে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনার পর বিভিন্ন সময়ে হাসপাতালে মারা যায় তারা। গভীর রাত পর্যন্ত একজনের পর একজনের লাশ এলাকায় আসতে থাকে, আর হাহাকার বাড়তে থাকে।

বুধবার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের কাছেই তারারটেক মসজিদ এলাকায় বিকেলে গিয়ে দেখা যায়, পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা কবরগুলোর পাশেই এই তিন শিশুর বাসা। আত্মীয় নন—এমন মানুষও কবরগুলোর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় চোখের পানি ফেলছেন।

আরিয়ান, ওমাইর আর বাপ্পি নিকটাত্মীয়। একসঙ্গে হেসেখেলে বড় হচ্ছিল তারা। পড়ত মাইলস্টোন স্কুলে। গত সোমবার স্কুলটিতে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনার পর বিভিন্ন সময়ে হাসপাতালে মারা যায় তারা। গভীর রাত পর্যন্ত একজনের পর একজনের লাশ এলাকায় আসতে থাকে, আর হাহাকার বাড়তে থাকে।

‘আম্মু, আমার নাকটা কি আছে’

বোরহান উদ্দিন বাপ্পি
বোরহান উদ্দিন বাপ্পি

মাহিদ হাসান আরিয়ান পড়ত চতুর্থ শ্রেণিতে। হাসপাতালে মারা যাওয়ার আগে মা মনিকা আক্তারকে বলেছিল, ‘আম্মু, তুমি কান্না কোরো না।’ কিন্তু ছেলের এ কথা তো মানতে পারছেন না মা। ছেলের তো হাজার হাজার স্মৃতি!

জ্বরের জন্য ১০ দিন আরিয়ান স্কুলে যায়নি। সোমবার স্কুলে যেতে চায়। মা ভেবেছিলেন, স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের দেখলে ছেলের ভালো লাগবে। টিফিনের জন্য ভুনা খিচুড়ি রান্না করে ছেলেকে স্কুলে দিয়ে এসেছিলেন। দুপুরে ভাশুরের ছেলে তাঁকে ফোন করে বলে, ‘আরিয়ান তো পুইড়া গেছে।’

ঘটনার দিন উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছালে ছেলে শুধু একবার আম্মু বলে ডাকে। মনিকা বললেন, ‘আমার সোনার শরীরে কোনো কাপড় নাই। কোমরে শুধু বেল্টটা আছে। মাথা থেইক্যা পা পর্যন্ত পুইড়া চামড়া ঝুলতাছে।’

আরিয়ানের অবস্থা খারাপ দেখে উত্তরা আধুনিক হাসপাতাল থেকে প্রথমে এভারকেয়ার হাসপাতাল এবং পরে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়। আরিয়ান অস্থির হয়ে পড়ে। পানি দাও, অক্সিজেন দাও বলে চিৎকার করতে থাকে। বার্ন ইনস্টিটিউটে আরিয়ান মায়ের কাছে বারবার জানতে চায়, ‘আম্মু, আমার নাকটা কি আছে?’

জ্বরের জন্য ১০ দিন আরিয়ান স্কুলে যায়নি। সোমবার স্কুলে যেতে চায়। মা ভেবেছিলেন, স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের দেখলে ছেলের ভালো লাগবে।

মনিকা জানালেন, ঘটনার সময় তাঁর ভাশুরের ছেলে কাছাকাছি ছিল। সে দ্রুত গিয়ে দেখে, সেনাবাহিনীর সদস্যরা আরিয়ানকে উদ্ধার করে হেলিকপ্টারে তুলছেন। তখন কাছে গেলে আরিয়ান বলেছিল, ‘ভাই বাঁচাও।’ সেখান থেকে অটোরিকশা করে হাসপাতালে নেওয়া হয় আরিয়ানকে।

আরিয়ানের বড় ভাই জুবায়ের আহমেদও মাইলস্টোন কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তার ভবন আলাদা। সাততলা থেকে নেমে চিৎকার করতে থাকে, ‘আমার ভাই আরিয়ানকে কেউ দেখছ!’ উদ্ধারকর্মীরা তাকে আগুনের কাছে যেতে দেননি। ভাইকে বাঁচাতে না পেরে জুবায়ের মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে।

আরিয়ানের বাবা সেলিম আহমেদ ব্যবসায়ী। ছেলে অন্য কিছু নিয়ে তেমন বায়না না করলেও মায়ের হাতের নুডলসসহ বিভিন্ন খাবার খাওয়ার জন্য বায়না করত। মা নানান ব্যস্ততার মধ্যেও ছেলের আবদার পূরণ করতেন। স্বামী, দুই ছেলেসহ চারজন মিলে কখনো পারিবারিক ছবি তোলা হয়নি। কে জানত, পরিবারের সব চেয়ে ছোট সদস্য সবার আগে চলে যাবে!

ছেলে অন্য কিছু নিয়ে তেমন বায়না না করলেও মায়ের হাতের নুডলসসহ বিভিন্ন খাবার খাওয়ার জন্য বায়না করত। মা নানান ব্যস্ততার মধ্যেও ছেলের আবদার পূরণ করতেন।

স্কুলড্রেসের চেক শার্টটি ঝাঁঝরা হয়ে যায়

ওমাইর নূর আসফিক
ওমাইর নূর আসফিক

ওমাইর নূর আসফিকের এক পায়ের একটি জুতা আর স্কুলড্রেসের চেক শার্টটি ঝাঁঝরা অবস্থায় পেয়েছিলেন মা–বাবা। তার দুই হাত, মুখ, পিঠ ঝলসে গিয়েছিল। সে পড়ত তৃতীয় শ্রেণিতে। ওমাইর হলো আরিয়ানের চাচার নাতি। একই ঘটনায় মারা যাওয়া বাপ্পি হলো আরিয়ানের ফুফুর নাতি।

ওমাইরের চাচা শফিকুল ইসলাম স্থানীয় মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। বললেন, সোমবার খবর শুনে দৌড়ে স্কুলে যান। গিয়ে দেখেন আগুন আর আগুন। সেনাবাহিনীর সদস্যরা যখন ওমাইরকে নিয়ে বের হন, তখন শফিকুল ইসলাম তাঁর ভাতিজাকে চিনতে পারেন। বললেন, ‘আমি আমার ওমাইরকে হাজার মানুষের মধ্যেও চিনতে পারছি।’

প্রথমে ওমাইরকে নিয়ে উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান চাচা। সেখানে ভিড় দেখে লুবানা জেনারেল হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকেরা জানান, ওমাইর মারা গেছে। জন্ম থেকেই ওমাইরের হৃদ্‌যন্ত্রের সমস্যা ছিল। শব্দ শুনলে ভয় পেত। এমনকি তেলাপোকা দেখলেও ভয় পেত। বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার শব্দ, আগুনে মুখ, হাত, পিঠ ঝলসে যাওয়ার ধকল সহ্য করতে পারেনি শিশুটি।

শফিকুল বলেন, ‘ওমাইর নাই, এইটা মানতে পারতেছিলাম না। লুবানা হাসপাতাল থেকে তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নিলে সেখানেও চিকিৎসকেরা একই কথা বলেন। ওকে বাসায় আনি। মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে দেখে মনে হইছিল, হয়তো বেঁচে আছে। আবার লুবানা হাসপাতালে নিই। কিন্তু...।’

ওমাইরের বাবা ইমরান হাসান ও মা মাহমুদা হাসান। এই দম্পতির দুই বছরের আরেক মেয়ে আছে। ছেলের একটি জুতা বুকের মধ্যে আগলে রাখছেন মা। আর আধপোড়া শার্টটি নাকের কাছে নিয়ে ছেলের ঘ্রাণ পাওয়ার চেষ্টা করেন।

ওমাইর আর বাপ্পি একই ক্লাসের একই সেকশনে পড়ত। দুজন সম্পর্কে চাচাতো ভাই, আর এই দুজনের চাচা আরিয়ান। আরিয়ানের আরেক চাচা মো. রাসেল বললেন, ‘আমাদের বংশের এই তিন শিশুর পাশাপাশি অন্যান্য আত্মীয়ের বাচ্চাসহ এলাকায় ছয় শিশুর মৃত্যু হয়েছে এ ঘটনায়। হাসপাতালের আইসিইউতে এক নারী আত্মীয় (স্কুলের আয়া) মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। এলাকায় শুধু হাহাকার আর হাহাকার।’

বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার শব্দ, আগুনে মুখ, হাত, পিঠ ঝলসে যাওয়ার ধকল সহ্য করতে পারেনি শিশুটি।

‘ছেলের মৃত্যুতে বুকটা ফাইট্যা যাইতেছে’

বোরহান উদ্দিন বাপ্পি
বোরহান উদ্দিন বাপ্পি

বোরহান উদ্দিন বাপ্পির জন্ম ২০১৬ সালের ১৪ মার্চ। মারা গেল ২১ জুলাই। পড়ত মাইলস্টোন স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে। তার ভাই হযরত বেলাল উদ্দিন বিজয় এ স্কুলেই প্লে শ্রেণিতে পড়ে।

বাপ্পির বাবা মো. আবু শাহীন জানালেন, ওমাইর তাঁর মামাতো ভাইয়ের ছেলে। আর আরিয়ান সম্পর্কে মামাতো ভাই। সোমবার বাপ্পির মা বীথি আক্তার হাতে টিফিন বাক্স দিয়ে ছোট ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফেরেন। বাপ্পির কোচিং থাকায় ওকে রেখে আসেন।

আবু শাহীন বললেন, ‘বাপ্পিকে স্কুলে বসে টিফিন খাওয়াইতে গেলে বাচ্চার মা, ছোট বাচ্চাটাও মারা যাইত।’

বেলা সাড়ে তিনটার দিকে আবু শাহীনের ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে আসার কথা ছিল। রোববার স্কুল থেকে ফেরার সময়ই ছেলের পছন্দের দই আর ওমাইরকে পেস্ট্রি খাইয়ে তিনজন লেগুনায় চড়ে বাড়ি ফিরেছিলেন।

আবু শাহীন বলেন, ‘জীবনের শেষ দই, তাই চাইট্যা খাইছে। এরপর বাড়ি ফেরার পর ছেলের সঙ্গে আর কথা হয়নি। পরদিন স্কুলে চলে যায়। স্কুল থেকে ফেরার আগেই তো সব শেষ।’

আবু শাহীনের নিজস্ব দোকান আছে। বললেন, ‘ঘটনার পর স্কুলে গিয়ে দেখলাম, ছেলের ক্লাস ভবনের নিচেই বিমান বিধ্বস্ত হইছে। বুঝলাম, ছেলে তো মনে হয় নাই।’

স্কুলে ছেলেকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না আবু শাহীন। পরে জানতে পারেন, ওমাইরের এক চাচা বাপ্পিকেও হাসপাতালে নিয়ে গেছেন। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে গিয়ে ছেলেকে দেখে প্রথমে ভেবেছিলেন, ছেলে মনে হয় বেঁচে যাবে। কিন্তু চিকিৎসকেরাই জানালেন, ছেলের শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে মারা যায় বাপ্পি।

রোববার স্কুল থেকে ফেরার সময়ই ছেলের পছন্দের দই আর ওমাইরকে পেস্ট্রি খাইয়ে তিনজন লেগুনায় চড়ে বাড়ি ফিরেছিলেন।

বাপ্পির স্কুলের পরিচয়পত্রসহ স্কুলড্রেস পুড়ে গেছে। স্কুলের পুরোনো আইডি কার্ড, বাসায় রেখে যাওয়া কিছু বইপত্র, খেলনা, কাপড় জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন বাপ্পির মা–বাবা। আবু শাহীন বারবার বলছিলেন, ‘ছেলের মৃত্যুতে বুকটা ফাইট্যা যাইতেছে। দেশে এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে। আর কোনো মা–বাবার যাতে এভাবে বুক খালি না হয়।’