Image description

ইসলামী ব্যাংকের খুলনার ফুলতলা শাখার স্টোর কক্ষে গ্রাহকের চোখ ও মুখ বেঁধে হাতুড়ি দিয়ে পেটানোর ও প্লায়ার্স দিয়ে নখ তোলার চেষ্টার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ফুলতলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জেল্লাল হোসেন।

ভুক্তভোগী ওই ব্যক্তির নাম সাইফুল্লাহ হাজেরী (৩৫)। তিনি পেশায় একজন স্কুলশিক্ষক। বর্তমানে খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তবে এ ঘটনায় ফুলতলা থানা-পুলিশ তিন ব্যাংক কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে।

গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন আশিক, মিজান ও মামুন। তাঁরা ইসলামী ব্যাংক ফুলতলা শাখার কর্মকর্তা।

তাঁদের গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ফুলতলা থানার ওসি মো. জেল্লাল হোসেন।

হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, বেডের ওপর রক্তমাখা সাদা পায়জামা ও গেঞ্জি পরে কাতরাচ্ছেন সাইফুল্লাহ। তাঁর দুই পায়ে হাতুড়ি দিয়ে পেটানোর কারণে দাগ হয়ে গেছে। যেটা কম্বল দিয়ে ঢেকে রেখেছিলেন স্বজনেরা। হাতের আঙুলের নখ প্লায়ার্স দিয়ে ওঠানোর চেষ্টার কারণে রক্ত জমাট হয়ে পড়েছে। বিষয়টি ধামাচাপা দিতে ইতিমধ্যেই ব্যাংকটির একাধিক কর্মকর্তা যোগাযোগ শুরু করেছেন।

ফুলতলা উপজেলার বেলেপুকুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সাইফুল্লাহ হাজেরীকে ব্যাংকটির ফুলতলা শাখায় গত মঙ্গলবার বিকেলে অমানবিক নির্যাতনের পর বিভিন্ন সাদা কাগজে স্বাক্ষর, খালি চেকে স্বাক্ষরসহ ব্যাংকটির মনগড়া লেখা একটি কাগজেও তাঁর স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

ইতিমধ্যে ব্যাংকটির খুলনার জোনাল অফিসের কর্মকর্তা ও ফুলতলা শাখা ব্যবস্থাপক খুমেক হাসপাতালে সাইফুল্লাহকে দেখতে গিয়েছেন। পাশাপাশি বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে অধিকতর তদন্ত শুরু হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।

অভিযোগে জানা যায়, নগরীর খানজাহান আলী থানাধীন ইস্টার্ন গেট এলাকায় ইসলামী ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকের মালিক মেসার্স হাজেরী এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী এ এইচ এম শফিউল্লাহ হাজেরীর ছেলে ভুক্তভোগী সাইফুল্লাহ হাজেরী।

চলতি মাসে এজেন্ট ব্যাংক থেকে গ্রাহকদের প্রায় ৪০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে যান এজেন্ট ব্যাংকের ক্যাশ ইনচার্জ কাগজি মাহবুবুর রহমান ও মার্কেটিং অফিসার মনিরুল গাজী। এই ঘটনার পর ব্যাংকটির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে একটি টিম সেখানে আসে। পাশাপাশি দুজন প্রিন্সিপাল অফিসার দিয়ে একটি তদন্ত কমিটিও করা হয়।

অন্যদিকে গ্রাহকদের তাগাদা ও ব্যাংকটির ভাবমূর্তি রক্ষায় ফুলতলার ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারা মরিয়া। তাঁরা এজেন্ট ব্যাংকটির মালিক শফিউল্লাহ হাজেরীর নিকট থেকে একাধিক ব্ল্যাঙ্ক চেকসহ স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করিয়ে নেন।

ভুক্তভোগী সাইফুল্লাহ হাজেরী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বলেন, ‘গত মঙ্গলবার ফুলতলার ইসলামী ব্যাংক শাখায় আমাকে যেতে বলা হয়। বিকেল ৪টার দিকে আমি ব্যাংকে যাই। ওই সময় আমার বাবাও ব্যাংকে ছিলেন। ব্যাংকের কর্মকর্তারা আমাকে এজেন্ট ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের বিষয়ে বিভিন্নভাবে দোষারোপ করার চেষ্টা করে। আমি তাদের বলি, আমরা যদি টাকা আত্মসাৎ করতাম, তাহলে এভাবে চলাফেরা করতাম না। তা ছাড়া আমার বাবা জমি বিক্রি করে খুব দ্রুতই এই ক্ষতিপূরণ দিবেন। ইতিমধ্যে আপনারা ব্ল্যাঙ্ক চেক ও স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিয়েছেন।

‘তখন ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, দ্রুত টাকা পরিশোধ করতে হবে, না হলে সমস্যা। পাশাপাশি আমার ব্লাঙ্ক চেকে স্বাক্ষর করতে বলে। আমি তখন আমার বাবাকে চেকবই আনার জন্য বাড়িতে পাঠাই। এই সুযোগে ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার আশিক আমার হাত ধরে ব্যাংকটির স্টোর রুমে নিয়ে যান। সেখানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখ ও মুখ বেঁধে ফেলে ৪-৫ জন। এরপর তারা হাতুড়ি দিয়ে আমার পায়ের তালু ও হাঁটুতে পেটাতে থাকে। পাশাপাশি প্লায়ার্স দিয়ে আমার নখ ওঠানোর চেষ্টা করে। এরপর তারা স্ট্যাম্প, চেকসহ সাদা কাগজে আমার স্বাক্ষর করিয়ে রাখে। এই ঘটনায় আমরা চিকিৎসা শেষে আইনগত কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সেটা পরিবারের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে নেব।’

হাসপাতালে থাকা সাইফুল্লাহর বোন ও মামা বলেন, ‘ব্যাংকের ভেতর এমনভাবে হাতুড়ি ও প্লায়ার্স দিয়ে নির্যাতন করাটা কতটা অমানবিক আপনারাই বলেন।

এরপর ব্যাংকের কর্মকর্তারা এসেছে ভুল স্বীকার করতে। তারা উন্নত চিকিৎসা দিতে চায়। আমরা পারিবারিকভাবে এই ঘটনার বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সেটা পরে সিদ্ধান্ত নেব। আগে রোগীর চিকিৎসা জরুরি।’

ভুক্তভোগীর বাবা এ এইচ এম শফিউল্লাহ হাজেরী বলেন, ‘গ্রাহকের টাকা পরিশোধের জন্য আমরা জমি বিক্রির কাজ শুরু করেছি। ব্যাংকের কথা অনুযায়ী চেক ও স্ট্যাম্পেও স্বাক্ষর করেছি। তারপরও আমার ছেলেকে এইভাবে ব্যাংকের ভেতর নির্যাতন করাটা ঠিক হয়নি।’

ইসলামী ব্যাংকের ফুলতলা শাখা ব্যবস্থাপক আনিসুর রহমান বলেন, ‘ঘটনার সময় আমি ব্যাংকে ছিলাম না। কী হয়েছে এবং কেন হয়েছে, এটা আমি পরিষ্কারভাবে জানি না। তবে এই বিষয়ে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। যে কর্মকর্তা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তার বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’

ইসলামী ব্যাংক খুলনা জোনের জেনারেল ম্যানেজার ইমামুল বারী বলেন, ‘বিষয়টি আমরা মঙ্গলবার রাতে জেনেছি। হাসপাতালে ও সংশ্লিষ্ট শাখায় আমাদের লোক পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে।’

ফুলতলা থানার ওসি মো. জেল্লাল হোসেন বলেন, ‘নগরীর খানজাহান আলী থানাধীন ইস্টার্ন গেট এলাকায় ইসলামী ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকের মালিক মেসার্স হাজেরী এন্টারপ্রাইজ। ওই এজেন্ট ব্যাংকটি পরিচালনা করতেন হাজেরীর ছেলে সাইফুল্লাহ হাজেরী। তিনি দুজন কর্মচারী নিয়ে ওই এজেন্ট ব্যাংক পরিচালনা করতেন। এজেন্ট ব্যাংকের ওই দুজন কর্মচারী ব্যাংকে টাকা জমা না দিয়ে বিশাল অঙ্কের টাকা নিয়ে পালিয়ে যান। এ ঘটনায় তাঁকে ব্যাংকে ডেকে নিয়ে মারধর করে ব্যাংকের কর্মকর্তারা। পরে তাঁকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। এ ঘটনায় আজ থানায় মামলা করেন ভিকটিমের মামা। ঘটনাটি ব্যাংকে হওয়ায় আমরা তিনজন ব্যাংক কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছি।’