Image description

রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভয়াবহ বিমান বিধ্বস্তের চার দিন পেরিয়ে গেলেও থামেনি মানুষের ভিড়। দূর-দূরান্ত থেকে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ ছুটে আসছেন ঘটনাস্থল দেখতে। কেউ বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন বিধ্বস্ত ভবনের দিকে, কেউবা হতবাক নিহত শিশুদের কথা মনে করে। আবার অনেকেই চোখের সামনে দুর্ঘটনার ভয়াবহতা কল্পনা করে কেঁদে ফেলেন।

বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) বিকালে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান ফটকের সামনেই দেখা গেলো এমন চিত্র।  যদিও ভেতরে প্রবেশের দুটি  গেটেই বন্ধ ছিল। নিরাপত্তা রক্ষীরা কাউকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছেন না। তবু শত শত মানুষ এসে দাঁড়াচ্ছেন ফটকের বাইরে। কেউ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ভেতরটা দেখার চেষ্টা করছেন। আবার কেউবা ভবনের ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো এক ঝলক দেখার জন্য কাঁটাতারের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছেন।

সোমবার (২১ জুলাই) দুপুরে বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধ বিমান প্রতিষ্ঠানটির হায়দার আলী নামে দোতলা ভবনে আছড়ে পড়ে। এতে সঙ্গে সঙ্গে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে বিস্ফোরণ ঘটে। এসময় ভবনটিতে থাকা প্রাইমারি ও মাধ্যমিকের  শিক্ষার্থীসহ শিক্ষক, স্টাফ ও অভিভাবক মিলে প্রায় দেড় শতাধিক মানুষ  দুর্ঘটনার শিকার হন। এ ঘটনায় এখনও পর্যন্ত ৩১ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

সরেজমিনে দেখা যায়, মাইলস্টোনে প্রবেশের দুটি ফটক রয়েছে। একটি দক্ষিণ দিকে এবং অপরটি পূর্ব দিকে ক্ষতিগ্রস্ত হায়দার আলী ভবনের পাশে। বৃহস্পতিবার দুটি গেটই বন্ধ ছিল। দুপুরের পর থেকে কৌতূহলী মানুষ প্রতিষ্ঠানটির সামনে ভিড় জমাচ্ছেন। তারা প্রতিষ্ঠানের ভেতরে ঢুকতে না পেয়ে বাইরে থেকে দেখছেন। অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হায়দার আলী ভবনের পেছনের রাস্তা থেকে দেখছেন। এসময় দুর্ঘটনার বিষয় নিয়ে তাদের নানা আলোচনা ও হতাহতদের স্মৃতিচারণ করতে দেখা গেছে।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত দর্শনার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুধু উত্তরার স্থানীয় বাসিন্দারাই নয়, রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও মানুষ এসেছেন। কেউ এসেছেন বাসে, কেউবা ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে।

 

গেটের রেলিংয়ের ফোকর দিয়ে ভেতরের ক্ষতিগ্রস্ত হায়দার আল ভবন দেখার চেষ্টাগেটের রেলিংয়ের ফোকর দিয়ে ভেতরের ক্ষতিগ্রস্ত হায়দার আল ভবন দেখার চেষ্টা

বাড্ডা থেকে আসা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মিজানুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘টেলিভিশনে যতটা দেখেছি, বাস্তবে এসে মনে হলো—ভয়াবহতা আরও অনেক বেশি ছিল। একটা স্কুলে ক্লাস চলাকালীন এভাবে বিমান ভেঙে পড়বে—এটা ভাবতেই শিউরে উঠছি। আমি এসেছি কেবল সেই জায়গাটা নিজের চোখে দেখার জন্য, যেখানে এত শিশু এক নিমিষে আগুনে পুড়ে গেলো।

মিরপুর-১ নম্বর থেকে বন্ধুদের সঙ্গে এসেছেন ফরিদুল হাসান। তিনি বলেন, খবরে শুনেছি ‘হায়দার আলী’ ভবনে বিমান বিধ্বস্ত হয়। সামনে দাঁড়িয়ে যতটুকু দেখা যাচ্ছে, তাতে ভবনটির এখনকার অবস্থা বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু এখানকার বাতাসে যেন আজও পোড়া গন্ধ ছড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে, চারপাশে এখনও শিশুদের চিৎকার আর কান্না জমে আছে।”

যাত্রাবাড়ী থেকে একাই এসেছেন কলেজছাত্র সোহাগ। তিনি বলেন, ‘ফেসবুক খুললেই দুর্ঘটনার ভিডিও, ছবি, আহাজারি দেখতে পাই। চোখে জল চলে আসে। কিছুই তো করতে পারিনি আমরা—অন্তত একবার ঘটনাস্থলে এসে মৃতদের প্রতি সম্মান জানাতেই এসেছি।

মিরপুরের বাসিন্দা আফসানা মিমি। তিনি পরিবারের চার সদস্য নিয়ে ঘটনাস্থল দেখতে এসেছেন। আফসানা মিমি বলেন, আমার ছোট মেয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে, ঠিক ওই নিহত শিশুদের বয়সী। ভাবতেই গা শিউরে উঠছে। ওর হাত ধরে দাঁড়িয়ে ভাবছি, যদি আমার সঙ্গে এমন কিছু হতো? কীভাবে মেনে নিতাম! তাই এসেছি—এক মায়ের চোখে আরেক মায়ের বেদনা উপলব্ধি করতে।

কৌতূহলের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের গুজব যাচাই

ঘটনাস্থলে আসা অনেকেই জানাচ্ছেন, নিহতের প্রকৃত সংখ্যা ও দুর্ঘটনার বিস্তৃতি সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া তথ্য যাচাই করতেই তারা এসেছেন। কেউ কেউ বলছেন, ঘটনাটি নিয়ে নানা বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে, আর সেই বিভ্রান্তি দূর করতে চাইছেন নিজের চোখে দেখে।

মূল গেট বন্ধ থাকায় যে যেভাবে পারছেন বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার জায়গাটি দেখার চেষ্টা করছেনমূল গেট বন্ধ থাকায় যে যেভাবে পারছেন বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার জায়গাটি দেখার চেষ্টা করছেন

বন্ধ ফটক, কড়া নিরাপত্তা

স্কুলের দুটি প্রবেশপথই বন্ধ করে রাখা হয়েছে। নির্ধারিতের বাইরে কাউকেই ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। নিরাপত্তারক্ষীরা শুধু হেল্প ডেস্কে আগত হতাহত বা নিখোঁজদের স্বজনদের পরিচয়পত্র যাচাই করে প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছেন।

এরই মাঝে যারা শুধু দেখতে এসেছেন, তাদের বারবার অনুরোধ করা হচ্ছে—যেন বেশি ভিড় না করেন এবং ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা না করেন।

এদিকে এই দুর্ঘটনায় এখনও যারা নিখোঁজ রয়েছেন এবং যাদের মরদেহ শনাক্ত করা যাচ্ছে না। এছাড়া এ ঘটনায় হতাহতের প্রকৃত তথ্য যাচাই-বাছাই করতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ একটি কমিটি গঠন করেছে। সেই কমিটি আজ থেকে স্কুল প্রাঙ্গণে স্বজনদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কয়েকটি পরিবারের সদস্যরা এসে তথ্য দিয়েছেন।

এরপর দুপুরে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন মেজর মেহেদী।

এদিকে এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মাহাতাব (১৪) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তার শরীরে ৮৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছিল। এরপর বিকাল সাড়ে চারটার দিকে মাহিয়া তাসনিম (১৫) নামে আরেকটি শিশু চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তার শরীরে ৫০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছিল। এ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩১ জনে এবং বিভিন্ন হাসপাতালে এখনও ৫১ জন রয়েছেন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।