
৪ আগস্ট ২০২৪। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দ্বিতীয় ঢেউয়ে উত্তাল ছিল সারা দেশ। রাজধানীর বাইরে, নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর ব্রিজ এলাকাতেও সেই আন্দোলনের ঢেউ পৌঁছায়। ঠিক সেখানেই পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান শেরপুর জেলার নকলা উপজেলার দরিদ্র নির্মাণ শ্রমিক সফিক মিয়া (৩৮)। শহীদ হলেন একজন সহমর্মী মানুষ, যিনি ছাত্রদের ন্যায্য দাবির পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে নিজের জীবন হারালেন।
তিন ভাইবোনের মধ্যে একমাত্র ছেলে সফিক। শেরপুরের নকলার গরিব ঘরে জন্ম নেওয়া এই মানুষটি জীবিকার তাগিদে পরিবার নিয়ে ঢাকায় ছিলেন। স্ত্রী মুন্নি বেগম, তিন মেয়ে—১১ বছরের বড়, ৫ বছরের মেঝো এবং ৩ বছরের ছোট সন্তান—এই ছিল তার পৃথিবী। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে নির্মাণ সাইটে ছুটে যেতেন কাজের সন্ধানে। দিনমজুরির সামান্য আয়ে চলছিল অভাবের সংসার।
৪ আগস্ট ঢাকায় চলমান ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সহমর্মিতা জানাতে কাঁচপুর ব্রিজ এলাকায় গেলে পুলিশ গুলি চালায়। সেখানেই গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন সফিক মিয়া। রাত দশটায় স্ত্রী মুন্নি বেগম খবর পান স্বামী আর নেই। কিন্তু তাকে সরাসরি কিছু জানানো হয়নি। দাফনের ব্যবস্থাও সহজ ছিল না। সবকিছুতে এগিয়ে আসে ছাত্ররা। তাদের সহযোগিতায় লাশ উদ্ধার হয়, ফিরিয়ে আনা হয় কাফনে মোড়া সফিকের নিথর দেহ।
মুন্নি বেগম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমার স্বামী পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন। তিনি ইনকাম করতেন, সংসার চালাতেন। এখন তিনি শহীদ হয়েছেন। তিন মেয়ের পড়াশোনা, খাওয়া-দাওয়া, চিকিৎসা—সব কিছু এখন আমার একার কাঁধে। শাশুড়িও অসুস্থ। কোনো চাকরি নেই, কোনো উপার্জনের ব্যবস্থা নেই। ঋণের বোঝাও রয়ে গেছে। সরকারের কাছে অনুরোধ করছি—আমাকে যেন দৈনিক বা মাসিক কিছু আয় করার সুযোগ করে দেওয়া হয়। আমার স্বামীর হত্যাকারীদের দ্রুত বিচার চাই, ফাঁসি চাই।’
সফিকের শ্যালক মাহমুদুল হাসান মিন্টু বলেন, ‘আমি ৪ আগস্ট আশুলিয়ায় ছিলাম। বিকেল চারটায় একটি ফোন পাই, যেখানে বলা হয় দুলাভাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। আমরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। পরে ছাত্রদের সহায়তায় লাশ ঢাকায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়। ৫ আগস্ট সকালে শেরপুর মহাসড়কে জানাজা হয় এবং পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।’
আর্থিক সহায়তার বিষয়ে মুন্নি জানান, ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচ লক্ষ, আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন থেকে এক লক্ষ, জামায়াতে ইসলামি থেকে দুই লক্ষ এবং বিএনপি থেকে ২০ হাজার টাকা অনুদান পেয়েছি।
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু সরকার তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দমন-পীড়নের মাধ্যমে থামাতে গিয়ে সরকারই আরও প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস হস্তক্ষেপে প্রায় হাজারো নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন হাজার হাজার। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন ঘটে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘদিন নিপীড়ন নির্যাতন চালানো আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।