
চাঁদপুর জেলার মতলব দক্ষিণ উপজেলার উপাদি উত্তর ইউনিয়নের নওগাঁ গ্রামের বাবুল পাটওয়ারীর বড় ছেলে রাব্বি আলম (২৩)। গেল বছর ১৯ জুলাই রাজধানীর পুরানা পল্টন এলাকায় বৈষ্যম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন।
মৃত্যুর এক বছর পরেও সন্তানের কথা স্মরণ হলে ডুকরে ডুকরে কাঁদেন মা পারভীন বেগম। বাবা বললেন ছেলে হত্যার বিচার চাই আল্লাহর কাছে।
সরেজমিন শহীদ রাব্বি আলমের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তার মা-বাবা ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে। তার বাবা বাবুল পাটওয়ারী রাজধানীর শাহবাগ পিজি হাসপাতালের সামনে মুদি দোকানি।
শহীদ রাব্বি আলমের জন্ম ২০০৩ সালের ২৯ আগস্ট। স্থানীয় নওগাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি এবং নওগাঁ উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। ভাই-বোনের মধ্যে রাব্বি চতুর্থ। তিন হলেন- রাবেয়া (৩৫), সুমী (৩২), রুবি (২৮) ও ছোট ভাই রাহিম (২১)। বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট ভাই রাহিম ও তার বাবা এখন ব্যবসা পরিচালনা করেন। রাহিম হিফজ মাদরাসায় পড়েছেন। ২০ পারা হিফজ শেষ করার পর আর পড়েননি। বাবার সঙ্গে ব্যবসায় চলে যান।
রাব্বির ছোট ভাই রাহিম বলেন, আমার সঙ্গে ভাইয়ের খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই প্রতিদিন বিকেলে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতেন। রংপুরে আবু সাইদ শহীদ হওয়ার পর ছাত্রদের আন্দোলন সারাদেশে উত্তাল হয়ে ওঠে। ঠিক ওই সময়ে অর্থাৎ ঘটনার দিন ১৯ জুলাই শুক্রবার পল্টন এলাকায় জুমার নামাজ আদায় করে ভাই আন্দোলনে যান। সেখানে পুরানা পল্টন এলাকায় তার পায়ে পুলিশের রাবার বুলেট বিদ্ধ হয়। এই সংবাদ ভাই নিজেই আমাকে ফোন করে জানায় এবং বলে ঢাকা মেডিকেলে আয়। কিছুক্ষণ পরে ভাইয়ের ফোন দিয়ে আরেকজন জানায় আপনার ভাইয়ের মাথায় গুলি লেগেছে মেডিকেলে আসেন। পরে হাসপাতালে গিয়ে ভাইকে মৃত অবস্থায় পাই। সেসময় গিয়ে দেখি ভাইয়ের ডান কানের ওপর দিয়ে গুলি মাথায় ডুকে ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেছে। হাসপাতাল থেকে ভাইয়ের লাশ পাই পরদিন সন্ধ্যায়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ময়নাতদন্ত করার পর আইনি প্রক্রিয়া শেষে লাশ হস্তান্তর করে। ঢাকা থেকে ২০ জুলাই সন্ধ্যায় ভাইয়ের লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসি এবং রাত সাড়ে ১২টায় নামাজে জানাজা শেষে বাড়ির সামনে দাফন করা হয়।
প্রতিবেশী মো. সেলিম বকাউল বলেন, আমি প্রবাসে ছিলাম। ছোট বেলায় দেখেছি রাব্বি খুবই ভদ্র এবং নম্র ছিল। রাব্বি তার বাবার সঙ্গে ঢাকার শাহবাগে ব্যবসা করত। গেল বছর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় মারা যায়। শুধুমাত্র রাব্বিই নয়, তাদের পুরো পরিবারই খুবই শান্তিপ্রিয়। আমাদের সামনেই তারা ভাই-বোন বড় হয়েছে।
প্রতিবেশী হোসনে আরা (৪৮) জানান, রাব্বিদের পরিবারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। তিনি শহীদ রাব্বির মায়ের সঙ্গেই থাকেন। খুব কাছ থেকে এই পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে জানেন। রাব্বি ঢাকায় থাকার কারণে তার মা সব সময়ই খুব চিন্তিত থাকতেন। যখন আন্দোলন শুরু হয়, তখন থেকেই তার মা নিষেধ করতেন যেন ছাত্রদের আন্দোলনে না যায়। কিন্তু রাব্বি মায়ের কথা শুনেননি। আন্দোলনে গিয়ে শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যু হয়। বাড়ির পাশেই দাফন করা হয় রাব্বিকে। যে কারণে তার মা ছেলের কবর দেখলেই ডুকরে কেঁদে ওঠেন।
রাব্বির বোন রুবি বেগম বলেন, আমাদের তিন বোনের পর রাব্বির জন্ম। যে কারণে সব বোনরাই তাকে ছোটবেলা থেকে আদর সোহাগ দিয়ে বড় করেছি। ঢাকায় থাকলেও আমাদের সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ ছিল। আন্দোলনের সময় সবাই মিলে নিষেধ করলেও ভাই আমাদের কথা শুনেনি। যে কারণে আমাদের আদরের ভাইকে হারাতে হয়েছে। ভাইয়ের মৃত্যুর পর আমার মা শোক সহ্য করতে না পেরে এখন অসুস্থ।
শহীদ রাব্বির মা পারভীন বেগম ছেলেকে হারিয়ে এখন খুব কম কথা বলেন। ছেলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ছেলেকে এলাকার লোকজন খুবই ভালো জানতেন। কারণ রাব্বি একাধিকবার তাবলীগ জামাতের চিল্লায় গিয়েছে। ধর্মীয় রীতি নীতি মানার চেষ্টা করত। অল্প বয়সে ছেলে আমার দাঁড়ি রেখেছিল। বড় বড় চুল ছিল। ছেলে মারা যাওয়ার আগের দিন ১৮ জুলাই তার সঙ্গে শেষ কথা হয়। আমাদের বাড়ির কাজের মালপত্র কেনার জন্য হাজীগঞ্জ যাই। তখনই রাব্বিকে বলি বাবা তুমি আন্দোলনে যাবে না। কিন্তু সে কারো নিষেধ মানেনি। ছেলে বলতো ছাত্রদের আন্দোলন যৌক্তিক। আমরা না গেলে কে যাবে আন্দোলনে।
তিনি আরও বলেন, আমার তিন মেয়ের পর এই ছেলে। তার জন্মের পর পরিবারের আনন্দের শেষ ছিল না। কিন্তু ছেলেকে হারিয়ে এখন আমরা শোকাহত। চোখের সামনে ছেলের সব স্মৃতি ভেসে ওঠে। ছেলেকে বাড়ির আঙিনায় দাফন করা হয়েছে। ছেলের কথা মনে পড়লে আমার বুক ফেটে যায়। আমার এই আর্তনাদ শেষ হবে কবে। যারা আমার ছেলেকে গুলি করে মেরেছে তাদের শাস্তি চাই।
রাব্বির মা বলেন, ছেলের মৃত্যুর পর জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা, জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচ লাখ এবং জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে দুই লাখ টাকা পেয়েছি। এর আগে উপজেলা প্রশাসন থেকে ১০ হাজার টাকা এবং খাবার উপহার দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে দেওয়া হয়েছে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। আমাদের পরিবার নিরীহ হওয়ার কারণে জামেলায় যেতে চাই না। যে কারণে কোনো মামলা করিনি।
শহীদ রাব্বি আলমের বাবা বাবুল পাটওয়ারী বলেন, আমার খুবই আদরের সন্তান শহীদ রাব্বি আলম। সে উচ্চ মাধ্যমিক পড়া শেষ করতে পারেনি। যে কারণে আমার সঙ্গে ঢাকায় ব্যবসার কাজে নিয়ে যাই। তবে আমার ছেলে খুবই ধার্মিক ছিল। তার মৃত্যুর সময় আমি দেশের বাড়িতে ছিলাম। তাকে আন্দোলনে যাওয়ার ব্যাপারে নিষেধ করা হলেও ছোট ভাইকে দোকানে রেখে আন্দোলনে যেত। শেষ পর্যন্ত আমার ছেলে আর বেঁচে রইল না। ছেলে হত্যার ঘটনায় আমরা কোনো মামলা করিনি। তবে আমরা চাই সরকার এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে বিচার করবে। আর আমার বিচার আল্লাহর কাছে।