Image description

জাতীয় সংসদ নির্বাচন রমজানের আগে নির্ধারিত সময়েই অনুষ্ঠিত হবে। তবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন এই অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নয়। নির্বাচনের আগে, বিশেষ করে অক্টোবর-নভেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনকালীন নতুন সরকার গঠিত হতে পরে। নতুন সরকার কীভাবে গঠিতে হবে, এ আলোচনা ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে কূটনীতিক মহলে। কারা কারা সরকারে থাকতে পারেন, সেই আলোচনাও চলছে। বলা হচ্ছে, নতুন সরকার হবে অনেকটা ওয়ান-ইলেভেন টাইপের এবং সেই সরকার শুধুমাত্র নির্বাচন আয়োজনের কাজগুলো করবে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো এ তথ্য জানিয়েছে। 
এমনিতেই নির্বাচন আয়োজনে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে সর্বমহলে। বিশেষ করে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, রাষ্ট্রের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর সঙ্গে এই অন্তর্বর্তী সরকারের বৈরি সম্পর্ক, জামায়াত-এনসিপির সরকার হিসেবে এই অন্তর্বর্তী সরকারের পরিচিতি প্রভৃতি কারণে সরকারের নিরপেক্ষতা ও সক্ষমতা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। 


তাছাড়া ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজেও নানা রকমের দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছেন। তিনি সংকটে ফেলে দিয়েছেন জামায়াতকে। এই দলটিকে কথা দিয়েছিলেন, কমপক্ষে আগামী পাঁচ বছর দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। আরো বেশি সময় ধরেও এভাবে চলতে পারে। এমন কথার ওপর ভিত্তি করেই বিএনপির সঙ্গে অতীতের দীর্ঘ-গভীর সম্পর্কের কথা ভুলে গিয়েছিলেন জামায়াত নেতারা। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ‘বিএনপি মাইনাস’র পথে হেঁটেছিলেন। এমনকি এ ব্যাপারে নিজেদের রূপকল্পও তৈরি করে ফেলেছিলেন। মাঠ পর্যায় পর্যন্ত আওয়ামী লীগের যেহেতু কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই তাদের দলে ভেড়াবেন। নিজেদের দল ভারী করবেন। বিএনপির নেতিবাচক দিকগুলো প্রতিনিয়ত মানুষের সামনে তুলে ধরবেন। বিএনপির জনপ্রিয়তা-গ্রহণযোগ্যতাকে ধসিয়ে দেবেন। বিএনপির কর্মী-সমর্থকরাও ইতিমধ্যে হতাশ হতে থাকবে। অন্ততঃ পাঁচ বছর এভাবে চললে বিএনপির বিকল্প শক্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে জামায়াত। 


কিন্তু জামায়াতের সেই আশার গুড়ে বালি পড়েছে লন্ডনে ড. ইউনূস-তারেক রহমান বৈঠক এবং এর পরে যৌথ ঘোষণার মধ্য দিয়ে। আর তাই তাৎক্ষণিকভাবে জামায়াত অত্যন্ত ক্ষেপে উঠে। এর জের হিসেবে পরবর্তীতে ঐকমত্যে কমিশনের বৈঠকও বয়কট করে এক দফায়। বস্তুত: লন্ডন বৈঠকে নির্বাচনের সময় চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ায় জামায়াত চোখে অন্ধকার দেখছিল। আগামী দিনগুলোতে তাঁদের ভবিষ্যত কী হবে এ নিয়ে আশংকিত দলটি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফোন করে জামায়াত নেতাদের মান ভাঙান। তাদের বিপাকে ফেলবেন না বলে কথা দেন। আর সেই থেকে ড. ইউনূসও মহা বেকায়দায় পড়েছেন। তাঁর কারণেই বিএনপির সঙ্গে বেঈমানী করেছে জামায়াত। 


এদিকে বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন না দিয়ে জোর করে ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়, এটা ড. ইউনূস নিজেই বুঝতে পেরেয়েছেন। দেশি-বিদেশি তাঁর ভিতগুলো অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে বা সরে গেছে। তিনি যে পাহাড়সম জনপ্রিয়তা নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসেছেন সেটি এখন অনেকটাই নেই। উপদেষ্টারাসহ সরকারের অন্যান্য লোকজন মুখে অনেক কথা বললেও বাস্তব পরিস্থিতি এর সম্পূর্ণ উল্টো। তাঁর সরকারের এক বছর প্রায় পূরণ হতে চললো, এখন পর্যন্ত মানুষ আক্ষরিক অর্থে কোনো পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছে না। উল্টো অনেক ক্ষেত্রে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। মানুষ হতাশ। এমন পরিস্তিতিতে ভেবেছিলেন, সব দোষ বিএনপির ওপর চাপিয়ে পার পেয়ে যাবেন। সেই কৌশলও তেমন একটা কাজে আসছে না। কারণ, বিএনপি তো সরকারে নেই। সরকারে আছেন তিনিই। পুরান ঢাকার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটায় শুরুতে বিএনপিকে মহা চাপে ফেলা গিয়েছিল। জামায়াত-এনসিপি এবং সরকারের লোকজন যৌথভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে বিএনপিকে সংকটে ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু এর পরবর্তীতেই দাবার চাল উল্টে যায়। উল্টো সরকারের ওপরই দায় চাপে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণে। তাছাড়া হত্যাকারীদের অন্যতম একজনকে ছবিতে এনসিপি নেতা নাহিদ ইসলামের সঙ্গে দেখা যায়। পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা অবনতির মতো দেশে আরো বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটেছে। শুধু আইন-শৃঙ্খলাই নয়, দেশের প্রায় প্রত্যেকটি খাতেই চরম বিশৃঙ্খলা চলছে। এমন খারাপ পারফরমেন্স নিয়ে নির্বাচন আয়োজন করা বর্তমান সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে কিনা, এ প্রশ্ন উঠছে। বিদেশি কূটনীতিকরাও মনে করছেন, নির্বাচন আয়োজন করার মতো সক্ষমতা ড. ইউনূস সরকারের নেই। 


বিদেশে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রধান ভিত ছিল যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ছিল এ অঞ্চলের দখল নেয়া। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারে যাওয়ার পথ তৈরি করা। অতীতে এক সময় সেন্ট মার্টিনে ঘাঁটি করার পরিকল্পনা ছিল। বিএনপি সেটি দেয়নি এজন্য ওয়ান ইলেভেন ঘটিয়েছে। সেই থেকে বিগত বছরগুলোতে কখনো প্রকাশ্যে ও কখনো অন্তরালে বিএনপি মাইনাসের পথেই হেঁটেছে। সর্বশেষ ৫ আগস্টের পরও তা অব্যাহত ছিল। শেখ হাসিনার সঙ্গে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘অকাস’ এবং ‘জিসোমিয়া’ নামের দুটি সামরিক চুক্তির খসড়া আদান-প্রদান হয়েছে। পরবর্তীতে ভারত ও চীনের চাপে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সেই সামরিক চুক্তি থেকে সরে আসতে বাধ্য হন হাসিনা। 


৫ আগস্টের পর ড. ইউনূসের নির্বাচনবিহীন সরকারকে পাঁচ বছর ক্ষমতায় রাখার পরিকল্পনা ছিল যুক্তরাষ্ট্রেরই। পরিকল্পনা ছিল, মিয়ানমার থেকে বিচ্ছিন্ন আরাকানকে মানবিক করিডোর দেয়া। মানবিক করিডোরের নামে মূলতঃ এনজিওগুলোর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সরবরাহ হতো। ১ লাখ ৮২ হাজার রোহিঙ্গাকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এদের মধ্যে কোনো নারী-শিশু নেই। আরাকান আর্মির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য এদের প্রস্তুত করা হয়েছে। মিয়ানমার পুরোটা দখল করার মতো সেনা জনবল আরাকান আর্মির নেই। তাই রোহিঙ্গাদের যুক্ত করার পরিকল্পনা ছিল। মানবিক করিডোরের কাজ অনেকটা দ্রুততার সঙ্গেই এগোচ্ছিল। কিন্তু বেশি তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে সবকিছু উলট-পালট হয়ে যায়। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পদত্যাগের হুমকিও দিতে হয়। 


নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, মানবিক করিডোর ইস্যুতে গোলমাল বেধে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ড. ইউনূসকে পরিস্থিতি শান্ত করার পরামর্শ দেয়া হয়। করিডোরের ইস্যুটি তাৎক্ষণিকভাবে স্থগিত রাখতে বলা হয়। সেই থেকে এ বিষয়ে আর কোনো তৎপরতা প্রকাশ্য হয়নি। বরং ড. মুহাম্মদ ইউনূস টিভি ভাষণে এটিকে ‘চিলে কান নিয়ে যাওয়া’র সঙ্গে তূলনা করেছেন। 


বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি এখন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নেই, এটা তারাও বুঝতে পারছে। তাই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এগোচ্ছে। এ মুহূর্তে শুল্ক ইস্যুটির ফায়সালা নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে দেনদরবার চলছে। বলা হচ্ছে, মূল ইস্যু শুল্ক নয়, রাজনৈতিক। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ককে এক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ যাতে চীনা পণ্যের ওপর নতুন শুল্ক আরোপ করে এজন্য চাপ দেয়া হচ্ছে। আরো কিছু অঘোষিত ইস্যুও এরমধ্যে রয়েছে। 


সূত্রমতে, সাম্প্রতিক সময়ে চীনের সঙ্গে বিএনপির সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ভারত এবং চীনের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রও এ বিষয়ে তৎপর হয়ে উঠেছে। তারাও এখন বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন চাইছে। পরিস্থিতি যাতে একেবাবেই হাতছাড়া হয়ে না যায় এ চেষ্টা চালাচ্ছে। ড. ইউনূস সরকারকে দীর্ঘায়িত করার পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে দেশটি। লন্ডন বৈঠকটি হয়েছে মূলতঃ যুক্তরাষ্ট্রেরই ঈঙ্গিতে। এখন যে নতুন নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের তৎপরতা চলছে এরমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রও আছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র দাবি করেছে। 


বস্তুত, এ কারণেই ড. মুহাম্মদ ইউনূস অনেকটা হাল ছেড়ে দিয়েছেন সবকিছুতে। তবে তাঁর সামনে এখন বড় সমস্যা হলো জামায়াত-এনসিপি। তিনি ক্ষমতা ছাড়লে এদের কী অবস্থা হবে তা নিয়ে চিন্তিত। বিএনপি এ মুহূর্তে জামায়াতের ওপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। এতোদিন ড. ইউনূসের অধীনে সরকার চালিয়ে আসছে মূলতঃ জামায়াতই। এনসিপি জামায়াতেরই বি টিম। রাজনীতির মাঠের বাইরে এনসিপির তেমন কোনো ভূমিকাও নেই। সরকারি অফিস-আদালতে নবগঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপির নেটওয়ার্ক বা লোকবল নেই। এসব প্রায় পুরোই জামায়াতের দখলে। ৫ আগস্টের পরে বিএনপির লোকজন প্রভাব খাটিয়ে কিছু পদ দখল করলেও পরবর্তীতে অতি দ্রুত তাদের ক্ষমতা খর্ব করা হয়। উপদেষ্টারাসহ সরকারি কলকাঠি যেহেতু জামায়াতের নিয়ন্ত্রণে তাই বিএনপি সমর্থকরা তাদের সঙ্গে পেরে উঠেনি। কিন্তু, নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হলে অথবা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষমতা ছাড়লে রাতারাতি এ পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। এমনকি তারা নিপীড়নেরও শিকার হতে পারেন, এমন আশংকা করছেন। তাই যে কোনো মূল্যে নির্বাচন ঠেকিয়ে রাখা এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দলটি। যদিও এমন চেষ্টা সফল হওয়ার সম্ভাবনা আপাততঃ নেই। কূটনৈতিক সূত্রগুলো দাবি করছে, বাংলাদেশে নতুন আরেকটি সরকার গঠন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।  
শীর্ষনিউজ