Image description

মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি পরপর তিনটি ‘মিসড কল’। দ্রুতই কল ব্যাক করলাম প্রথম আলোর ফার্স্ট নিউজ হেড ইমাম হোসেন সাঈদ ভাইকে। তিনি বললেন, ‘দ্রুত উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলে যান। বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে স্কুলে, আপনি তাড়াতাড়ি যান।’

কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘রাইড শেয়ারিং’ সেবায় তৎক্ষণাৎ মোটরসাইকেল ভাড়া করলাম। মাত্র তিন মিনিটের মধ্যে মোটরসাইকেল পেয়ে যাওয়ার পর চালককে বললাম, ‘ভাই, পারলে একটু দ্রুত যান।’

কুড়িল হয়ে কালশী ফ্লাইওভার ধরে মিরপুর ডিওএইচএসের ভেতর দিয়ে মেট্রোরেলের উত্তরা উত্তর স্টেশনে পৌঁছেই যানজটে পড়তে হয়। একটু সামনে এগোনোর পর সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোটরসাইকেল আটকানোর চেষ্টা করে, অফিসের আইডি কার্ড দেখিয়ে পার হতে পারলেও আবার যানজটে পড়তে হয়। এরপর চালককে ভাড়া বুঝিয়ে দিয়ে দৌড়ে ঘটনাস্থলের কাছে পৌঁছাই। সেখানে ভিড়ের মধ্যে এক লোকের ইশারায় বুঝতে পারি, চালকের দেওয়া হেলমেট তখন মাথায় পরা, তাড়াহুড়ার কারণে তাঁকে সেটি ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি।

স্কুলে ভেঙে পড়ল বিমান, নিহত ২২

 

ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটা সোয়া ২টা পেরিয়েছে। উৎসুক জনতার জন্য সামনে এগোনো যাচ্ছে না। এরপরও যতটা পেরেছি ঠেলে মাইলস্টোন স্কুলের গেটের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। সেখানে ভিড়ের মধ্যে লাকি আক্তার নামে একজন অভিভাবকের সঙ্গে কথা হয়। তিনি যাকে দেখছেন তাঁকেই বলছেন, ‘ভাই, আমার ছোট ছেলে স্কুলের ভেতর আটকে আছে। আমার ছেলেকে উদ্ধার করেন।’

এরপর রাত পৌনে নয়টার দিকে যখন অফিসের উদ্দেশে রওনা হই, তখন কেন জানি বারবার আধপোড়া সেই জুতার কথা মনে হচ্ছিল। জানি না, জুতাটি যে শিশুর, সে বেঁচে আছে কি না...।

এ সময় কেউ কেউ লাকি আক্তারকে পরামর্শ দিচ্ছিলেন শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। কিন্তু কারও কথা শোনার মতো অবস্থা তাঁর ছিল না। একনাগাড়ে একই কথা বলে যাচ্ছিলেন তিনি। ভিড়ের মধ্যে লাকি আক্তার কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন।

পরে সেই ভিড় ঠেলে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রবেশমুখের ডান পাশের একটি নির্মাণাধীন ভবনের দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকি। এরপর সিঁড়ির দিকে দৌড়ে যাই। দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে ভবনটির ছাদে উঠি। যত দূর মনে পড়ে চার থেকে পাঁচতলা ভবনটি। কিন্তু ছাদে গিয়ে স্কুলের ভেতরের পরিস্থিতি কিংবা উদ্ধার তৎপরতা ভালোভাবে দেখা যাচ্ছিল না। তখন দ্রুত নেমে নির্মাণাধীন ভবনটির ডান পাশের তিন–চারটি ভবন দৌড়ে পার হয়ে দুটি ভবনের মাঝামাঝি একটি লোহার গ্রিল টপকে মাইলস্টোন স্কুলের পরিবহন পুলের কাছাকাছি পৌঁছাই। এরপর কাঁটাতারের বেড়া দেখে বিকল্প কোনো প্রবেশের পথ আছে কি না, তা খুঁজছিলাম। কোনো পথ খুঁজে না পেয়ে পাশে থাকা একটি আমগাছে উঠে কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে কলেজে ঢুকতে সক্ষম হই। কিন্তু শুরুতেই নিরাপত্তারক্ষী বাধা দেন। সাংবাদিক পরিচয়েও কাজ হচ্ছিল না। অনেক অনুরোধ করার পর তিনি যেতে দেন। কিন্তু একটু সামনে গিয়েই আবার বাধার মুখে পড়তে হয়। সেখানে উদ্ধার তৎপরতা ও শৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা সেনাসদস্য ও স্বেচ্ছাসেবীরা বলেন, আর সামনে যাওয়া যাবে না। কয়েক দফা নানাভাবে অনুরোধ করে ঠিক ঘটনাস্থলে (যে ভবনে বিমান বিধ্বস্ত হয়) গিয়ে প্রথমেই মোবাইলে ছবি তুলি, উদ্ধার তৎপরতার একাধিক ভিডিও করে তা হোয়াটসঅ্যাপে অফিসে পাঠিয়ে দিই।

এ সময় কেউ কেউ লাকি আক্তারকে পরামর্শ দিচ্ছিলেন শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। কিন্তু কারও কথা শোনার মতো অবস্থা তাঁর ছিল না। একনাগাড়ে একই কথা বলে যাচ্ছিলেন তিনি। ভিড়ের মধ্যে লাকি আক্তার কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন।

ঘটনাস্থলে তখন ফায়ার সার্ভিসের একাধিক গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স ও উদ্ধার তৎপরতায় থাকা বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা ছোটাছুটি করছিলেন। একের পর এক স্ট্রেচার আসছে, ফায়ার সার্ভিস ও অন্য অ্যাম্বুলেন্সগুলোয় হতাহতদের তোলা হচ্ছে। হর্ন বাজিয়ে মুহূর্তের মধ্যে হাসপাতালের দিকে ছুটছে। ঘটনাস্থলের পরিস্থিতি ও উদ্ধার তৎপরতার হালনাগাদ তথ্য ফোনে অফিসের অন্য সহকর্মীদের জানাই। একই সঙ্গে উদ্ধার তৎপরতার কিছু ছবি ও ভিডিও পাঠাই।

হঠাৎ খেয়াল করি ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের সামনে হাতে একটি ছোট মাইকে হাসপাতালে রক্ত দিতে যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছিলেন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের হিসাববিজ্ঞানের শিক্ষক মো. সবুজ মিয়া। একফাঁকে তাঁর সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ তখন বেরিয়েছে, কেউ কেউ স্বজনদের অপেক্ষায় ছিল। এর মধ্যেই বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে। ভবনের সামনে থাকা তিন–চারজন শিশুর ক্ষতবিক্ষত দেহ তিনি দেখেছেন বলে জানান।

ভবনের ভাঙা অংশের একটু দূরে বিধ্বস্ত বিমানের আরও কিছু অংশ পড়ে আছে। দৌড়ে সেখানে গিয়ে দেখি পোড়া চেয়ার এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। বুঝতে অসুবিধা হলো না এসব চেয়ার ভবনের নিচতলার ক্ষতিগ্রস্ত কক্ষের। পোড়া চেয়ারসহ ধ্বংসস্তূপের মধ্যে হঠাৎ চোখ আটকাল আধপোড়া কালো একটি জুতায়। এই জুতার ছবি–ভিডিও যখন করছিলাম, তখন কেন জানি, ভেতর থেকে কান্না আসছিল, আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না...।

হিসাববিজ্ঞানের শিক্ষকের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন কয়েকজন সেনাসদস্য এসে উপস্থিত হন। পরে সেখানে থাকতে না পেরে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটির পেছনের দিকে চলে আসি। তখন দেখতে পাই ভবনের পেছনের দেয়ালের এক পাশ ভাঙা। ভাঙা ওই অংশ দিয়ে বিধ্বস্ত বিমানটির বিভিন্ন অংশ বের করছিলেন উদ্ধারকর্মীরা। দ্রুত সেই ছবি তুলছিলাম। এর মধ্যে দেখতে পাই ভবনের ভাঙা অংশের একটু দূরে বিধ্বস্ত বিমানের আরও কিছু অংশ পড়ে আছে। দৌড়ে সেখানে গিয়ে দেখি পোড়া চেয়ার এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। বুঝতে অসুবিধা হলো না এসব চেয়ার ভবনের নিচতলার ক্ষতিগ্রস্ত কক্ষের। পোড়া চেয়ারসহ ধ্বংসস্তূপের মধ্যে হঠাৎ চোখ আটকাল আধপোড়া কালো একটি জুতায়। এই জুতার ছবি–ভিডিও যখন করছিলাম, তখন কেন জানি, ভেতর থেকে কান্না আসছিল, আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না...।

বেলা দুইটা থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত টানা সাড়ে ছয় ঘণ্টা সেনাসদস্য, পুলিশ কর্মকর্তা, ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা, ঘটনাস্থলে থাকা স্বজনসহ প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে। এরপর রাত পৌনে নয়টার দিকে যখন অফিসের উদ্দেশে রওনা হই, তখন কেন জানি বারবার আধপোড়া সেই জুতার কথা মনে হচ্ছিল। জানি না, জুতাটি যে শিশুর, সে বেঁচে আছে কি না...।