
২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) চট্টগ্রামের চারটি বাসে এক শ্রমিক লীগ নেতার নির্দেশে আগুন দেওয়া হয়। পুলিশ ওই শ্রমিক লীগ নেতা ও বাসে আগুন দেওয়া ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার ওই সময়ে আন্দোলনকারীদের ওপর সব দায় চাপিয়েছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন শ্রমিক লীগ নেতার অগ্নিসন্ত্রাস ফাঁস হওয়ায় প্রশাসন নড়েচড়ে বসে।
শ্রমিক লীগ নেতাকে গ্রেপ্তার ও জবানবন্দি নেওয়ায় তিন পুলিশ কর্মকর্তা ও বিচারক শাস্তির মুখোমুখি হন। তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে পুলিশ সুপারের শোকজ ও বিচারকের অপরাধ আমলে নেওয়ার ক্ষমতা (কগনিনেন্স) খর্ব করা হলেও ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় তা বেশি দিন কার্যকর হয়নি।
নগরের অক্সিজেন-হাটহাজারী সড়কের নতুনপাড়া এলাকায় ছয় একর জায়গার ওপর বিআরটিসি ডিপো অবস্থিত। সেখানে ৯২টি সরকারি বাস রয়েছে। গত বছরের ২০ জুলাই রাত ১২টার দিকে ডিপোর ক্লিনিং শেডের পাশে থাকা চারটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। আগুনে একটি বাসের ১৬টি আসন এবং আরেকটির ৮টি আসন পুড়ে গেছে। বাকি দুটি বাস আংশিক পুড়ে যায়। এতে মোট ১০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ ঘটনায় বিআরটিসি ডিপো চট্টগ্রামের ব্যবস্থাপক মো. জুলফিকার বাদী হয়ে হাটহাজারী থানায় মামলা করেন। ঘটনার দুই দিন পর ২২ জুলাই পুলিশ সিসি ক্যামেরা দেখে লেগুনাচালক সোহেলকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে একই দিন দিদারুলকে গ্রেপ্তার করা হয়।
লেগুনাচালক সোহেল ও শ্রমিক লীগ নেতা দিদারুলকে গ্রেপ্তার করেছিলেন চট্টগ্রাম জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের ওসি আবু জায়েদ মো.নাজমুন নুর। পরে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হাটহাজারী থানার তৎকালীন এসআই রহমত উল্লাহ আসামিদের আদালতে হাজির করলে চট্টগ্রামের তৎকালীন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আওলাদ হোসেন মোহাম্মদ জুনায়েদের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন সোহেল। আদালত সূত্র জানায়, জবানবন্দিতে সোহেল বলেন, বায়েজিদ বোস্তামী থানা শ্রমিক লীগ নেতা সভাপতি দিদারুল আলমের নির্দেশে বিআরটিসি বাসে আগুন দেন তিনি। তাঁকে চার লাখ টাকা দেওয়ার কথা ছিল। অগ্রিম হিসেবে পান ৫০০ টাকা।
দেশব্যাপী বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে সোহেলের জবানবন্দিতে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসায় বিষয়টি আলোচিত হয়েছিল। তৎকালীন সরকার সবকিছুর জন্য আন্দোলনকারীদের দায়ী করেছিল। কিন্তু শ্রমিক লীগ নেতার নাম উঠে আসায় প্রশাসন নড়েচড়ে বসে।
শ্রমিক লীগ নেতা ও তাঁর সহযোগীকে গ্রেপ্তারে অভিযান পরিচালনাকারী তৎকালীন জেলা ডিবির ওসি আবু জায়েদ মো. নাজমুন নুর, হাটহাজারী থানার ওসি তদন্ত নুরুল আলম ও তদন্তকারী কর্মকর্তা রহমত উল্লাহকে শোকজ করে কারণ ব্যাখ্যা চান তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) এস এম শফি উল্লাহ।
গত বছরের ২৭ জুলাই আবু জায়েদ মো. নাজমুন নুরকে শোকজ করা চিঠিতে বলা হয়, ‘আসামি গ্রেপ্তার ও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি বিষয়ে কোনো তথ্য এসপিকে দেননি। এই ঘটনায় এসপিকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছিল। আপনার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে চরম অবহেলা, গাফিলতি, অদক্ষতা, উদাসীনতা, শৈথিল্যে ও অপেশাদারত্বের পরিচয় বহন করে, যা বিভাগীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থী ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আপনার বিরুদ্ধে কেন বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তার জবাব সাত দিনের মধ্যে দিতে হবে।’
বর্তমানে চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে সংযুক্ত পুলিশ পরিদর্শক আবু জায়েদ মো. নাজমুন নুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘অপরাধীকে গ্রেপ্তার করেছি। দলীয় পরিচয় দেখিনি। যার জন্য আমাকে শোকজ করা হয়। ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই সরকারের পতন হয়ে যায়। জুলাইয়ের সেই সময়ে দেশের জন্য নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে পেশাদারত্ব নিয়ে কাজ করেছি, প্রকৃত আসামি ধরা না পড়লে হয়তো সব দোষ আন্দোলনকারীদের ঘাড়ে চাপানো হতো।’
বর্তমানে ঢাকার কদমতলী থানায় কর্মরত হাটহাজারী থানার তৎকালীন এসআই রহমত উল্লাহ জানান, ‘সেদিন আসামিকে আদালতে হাজির করে জবানবন্দি দেওয়ার পর চাকরি যায় যায় অবস্থা হয়েছিল।’
জানতে চাইলে বর্তমানে ওএসডি চট্টগ্রাম জেলার তৎকালীন পুলিশ সুপার এস এম শফি উল্লাহ রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসামি গ্রেপ্তার ও জবানবন্দি দেওয়ার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন হিসেবে কিছুই জানানো হয়নি, নিয়ম অনুসারে তাই শোকজ করেছিলাম।’
শুধু পুলিশ নন, এই ঘটনায় আসামির জবানবন্দি গ্রহণকারী চট্টগ্রামের তৎকালীন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বর্তমানে ঢাকায় কর্মরত আওলাদ হোসেন মোহাম্মদ জুনায়েদের অপরাধ আমলে নেওয়ার ক্ষমতা নিয়ে নেওয়া হয়। অর্থাৎ কোনো অপরাধ আমলে নেওয়ার ক্ষমতা নেই। শুধু মামলার সাক্ষীসহ ট্রায়াল করার ক্ষমতা রয়েছে। জবানবন্দি নেওয়ার দিন গত ২৪ জুলাই তার কগনিনেন্স ক্ষমতা নিয়ে নেন চট্টগ্রাম চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কাজী সহিদুল ইসলাম। সরকার পতনের পর ৭ আগস্ট এটি ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
যে কারণে শ্রমিক লীগ নেতার বাসে আগুন
আসামির জবানবন্দি ও পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়, বিআরটিসি বাস ডিপোতে থাকা বাসগুলোর ইজারা চেয়ে পাননি শ্রমিক লীগ নেতা দিদারুল আলম। এর আগেও বাসের ইজারা নিয়ে ২০২২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিআরটিসি ডিপো এলাকায় আবদুল হালিম ওরফে রুবেল নামের একজনকে ছুরিকাঘাতে খুন করার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। এ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। পুলিশের অভিযোগপত্রে বলা হয়, বিআরটিসি বাসে সুপারভাইজার দেওয়া নিয়ে দ্বন্দ্বে হালিমকে খুন করা হয়।
গত বছরের জুলাইয়ে সারা দেশে যখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়, সেই সময়কে বেছে নেন দিদারুল। যাতে সব দোষ আন্দোলনকারীদের ওপর চাপানো যায়। তাঁর পূর্বপরিচিত লেগুনাচালক সোহেল রানাকে ঘটনার দুই দিন আগে বিআরটিসি ডিপো এলাকার সামনে ডেকে আনেন।
তাঁকে বলেন, ডিপোর ভেতর থাকা পাঁচটি বাসে আগুন লাগিয়ে দিতে হবে। এ জন্য তাঁকে চার লাখ টাকা দেওয়া হবে। তবে অগ্রিম হিসেবে তেল কিনতে তাঁকে ৫০০ টাকা দেওয়া হয়। সোহেল বাস ডিপোর পাশের একটি চা-দোকান থেকে একটি গ্যাস লাইটার চুরি করেন। পরে ঘটনার দিন ২০ জুলাই রাতে দেয়াল টপকে ডিপোতে ঢোকেন। একটি বাসের ভেতর থেকে ব্রেক অয়েল নেন। তিন থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে চারটি বাসের আসনের ফোমে ব্রেক অয়েল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, পেশাদারত্ব নিয়ে যেসব কর্মকর্তা কাজ করেছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে যেসব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অন্যায়ভাবে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন, তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত।