
রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশের (আপ বাংলাদেশ) আহ্বায়ক আলী আহসান জুনায়েদ। জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্ব থাকাদের একজন ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই সভাপতি। ঐতিহাসিক ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে এই আন্দোলনের স্মৃতিচারণ ও নেতৃত্ব দেওয়া, দেশের রাজনৈতিক সমসাময়িক নানা বিষয়ে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরেছেন নিশাত তাসনিম জেসিকা–
জুলাই আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেই দিনগুলো কেমন ছিল?
আলী আহসান জুনায়েদ: ২০২৪ সালের ৫ জুন সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। এরপর জুলাইয়ে শুরু হয় এই আন্দোলন। আন্দোলনের শুরুতে আমি সব স্পট হেঁটে হেঁটে দেখেছি—অন্যরকম একটা সাড়া ছিল। আন্দোলন ফুঁসে ওঠে ১৪ জুলাই যখন শেখ হাসিনা প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন—“কোটা আসলে কারা পাবে? রাজাকারের নাতি নাকি মুক্তিযোদ্ধার নাতি?” মূলত ছাত্রদের উপহাস করে এ ধরনের কথা বলা হয়েছিল। এরপর সে কথার ভিত্তিতে যারা আন্দোলন করছিল, তারা আন্দোলন নিয়ে আরও বেশি অগ্রসর হয়। স্লোগান দেওয়া হয়—“তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার।”
তারপর আমরা একটা মিটিং করি, যেহেতু সাধারণ শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি সাড়া দিয়েছে। ১৫ তারিখ আবার কর্মসূচি দেওয়া হয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্দিকে ওবায়দুল কাদের আন্দোলনকারীদের আটকাতে কাজ শুরু করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ সভাপতি বলেন—“৫ মিনিটে ফুঁ দিয়ে আন্দোলনকারীদের উড়িয়ে দেব।” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা করলে অনেকেই রক্তাক্ত হয়। বিশেষ করে আমাদের মেয়েরা অনেক বেশি আহত হয়, তাদের বেশ কিছু ছবি ভাইরাল হয় রক্তাক্ত অবস্থায়।
সেদিন বিকেলে লোমহর্ষক ঘটনা ঘটে—ঢাকা মেডিকেলে ঢাবি ছাত্রলীগের সেক্রেটারি সৈকতের নেতৃত্বে আহতদের ওপর আবারও আক্রমণ করা হয়। এ বিষয়টি নিয়ে সকলে আরও বেশি ক্ষুব্ধ হয় এবং পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী একত্রিত হয়ে ঠিক করে, এ বিষয়টিকে প্রতিহত করা হবে পরদিন ১৬ জুলাই। ওই দিন দুপুর ২টার দিকে আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনা সবাইকে মর্মাহত করে। আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনাটা আইকনিক হয়ে ওঠে। ওই দিন ছয় জন শহীদ হন। এরপর সায়েন্সের তিনটি হল থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করা হয়। পরে মুহসিন হল থেকেও ছাত্রলীগকে বের করে দেওয়া হয়। ১৬ তারিখ রাত থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ছাত্রলীগমুক্ত করা শুরু হয় এবং সর্বশেষ এফ রহমান হল দিয়ে ছাত্রলীগ বিতাড়ন কর্মসূচি শেষ হয়।
এরপর সারা বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করা হয়। এই আন্দোলন থেকে পিছু হটে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ সামান্য কোটার দাবিতে ছয়জনের মৃত্যু ঘটেছে। ১৬ তারিখ রাতে আমরা সবাই আলোচনায় বসি—সেখানে সাদিক, সারজিস, হাসনাত সবাই উপস্থিত ছিলেন এবং সব শিক্ষার্থী ক্ষুব্ধ অবস্থায় ছিল। ১৭ তারিখ গায়েবানা জানাজার আয়োজন করা হয়। কিন্তু পুলিশ পুরো ক্যাম্পাস এমনভাবে ঘিরে রাখে যে সেখানে জানাজা করার কোনো সুযোগ থাকে না। তখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হলগুলো বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। শিক্ষার্থীরা আরও বেশি ক্ষুব্ধ হয়ে মজা করে একটা ঘোষণা দেয় যে শিক্ষকরা যেন তাদের কোয়ার্টার ছেড়ে দেন।
জানাজার সময় আখতারকে গ্রেফতার করা হয় এবং শিক্ষার্থীরা পরবর্তীতে সেখানে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নেয়। পারিবারিক চাপ এবং অন্যান্য টেনশন থেকে দেখা যায় হলগুলো থেকে ছাত্রসংখ্যা আস্তে আস্তে কমতে থাকে। তখন আমরা বিভিন্ন জায়গায় কল করে প্রায় দেড়শ ছাত্রের থাকার ব্যবস্থা করি এবং ৫০ জন মেয়ে শিক্ষার্থীর থাকার ব্যবস্থা করি।
প্রত্যেকে নিজের জায়গা থেকে চেষ্টা করছিল শিক্ষার্থীদের থাকার জায়গা করে দেওয়ার। এটা একটা অভাবনীয় দৃশ্য ছিল। পরবর্তীতে আমরা ভেবেছিলাম আন্দোলনটা দমে যাবে। কিন্তু ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি আন্দোলন শুরু করে এবং পুলিশ তাদের ওপর হামলা করে। এর পরবর্তী সময়ে নর্থসাউথ, ইস্টওয়েস্ট আরও অনেক প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি আন্দোলনে যোগ দেয়। ওই দিন প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের ব্যাপক ভূমিকা ছিল। পরবর্তীতে সাধারণ শিক্ষার্থীরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে যোগদান করে। যেহেতু ক্যাম্পাসগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল তখন বিভিন্ন স্থান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে—যেমন মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, বাড্ডা, নতুনবাজার, সায়েন্সল্যাব, শাহবাগ এবং গুলিস্তান। প্রত্যেকটি জায়গা আন্দোলনের মেইন পয়েন্ট হয়ে ওঠে।
১৮ তারিখ ডিজিটাল ব্ল্যাকআউট হয়। তার আগেই আমরা আলাপ-আলোচনা করে ফেলি এবং ২১ তারিখ কোর্টের রায়ের পরিবর্তন হবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা করি এবং সরকারকে ৯ দফা দাবি প্রদান করি। ১৯ তারিখ কারফিউ জারি করা হয় এবং এটি ছিল সবচেয়ে ট্র্যাজিক একটি দিন। কারফিউ থাকার পরও অনেক মানুষ রাস্তায় জড়ো হয়। আমি নিজেও ফজরের নামাজ পড়ে রাস্তায় বের হয়ে দেখি প্রচুর মানুষ জড়ো হয়েছে। তখন বুঝি কারফিউ দিয়ে কোনো লাভ হবে না। সেদিন ব্যাপক হারে গুলি চালানো হয় স্পটগুলোতে এবং হেলিকপ্টার থেকেও পুলিশ-র্যাব মিলে গুলি বর্ষণ করে। দেশের অনেক মানুষ আহত এবং নিহত হয়।
দেশের সব মানুষ বিরক্ত হয়ে যায়। সবার ধারণা হয়—না, এভাবে আর দেশ চলতে পারে না। মানুষ জীবন দিতে রাজি ছিল। তারা কারফিউ ভেঙে বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করছিল। এখানে-ওখানে মানুষ আহত হচ্ছে, নিহত হচ্ছে। তখন ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো কোনো ভূমিকা পালন করেনি। ১৯ তারিখ একই দিনে একসঙ্গে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ৩১ জন শিক্ষার্থী শহীদ হয়। আহত ও নিহতদের পরিবারের লোকজনকে অনেক কিছু সহ্য করতে হয়েছে। তারা হাসপাতালে গিয়ে লাশ খুঁজে পাচ্ছে না, চিকিৎসা পাচ্ছে না। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা লাশ নিতে দিচ্ছে না—এ ধরনের আরও অনেক বিষয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে।
পুলিশ ছাত্রদের বাসায় হানা দিয়ে তাদের গ্রেফতার করে। ঢাকা শহরেই প্রায় ২ লাখ আসামি করা হয়। এই ধরপাকড়ের কারণে আন্দোলন খানিকটা ম্লান হতে থাকে এবং বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া ৮ দফার কথা প্রকাশ করে। ৯ দফা ২–৩টি মিডিয়া ছাড়া কেউ প্রকাশ করেনি। ওই সময় ব্যাপক ভূমিকা পালন করে অনলাইন মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট এবং ইনফ্লুয়েন্সাররা। তারা সত্যটা তুলে ধরে। যেহেতু ১৯ থেকে ২৪ তারিখ পর্যন্ত কোনো নেটওয়ার্ক ছিল না, সেহেতু আমাদের কাছে নিউজগুলো পৌঁছায়নি। তখন আমরা ফোনের মাধ্যমে সব জায়গায় যোগাযোগ করি।
২৪ তারিখ ইন্টারনেট আসার পরে আমরা দেখি কীভাবে লাশগুলো ড্রেনে ফেলা হয়েছে, ময়লার ভাগাড়ে ফেলা হয়েছে। এসব দেখে সবাই আবার ক্ষুব্ধ হয়ে আন্দোলন শুরু করে। বাড়িতে বাড়িতে পুলিশের হানা, হাসপাতালে সহযোগিতা নেই, লাশ পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, অজ্ঞাত লাশ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে—এসব দেখে সবাই বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যায়।
এসব কারণে আন্দোলনটা পুনরায় শুরু হয় এবং “মার্চ ফর জাস্টিস” কর্মসূচি দেওয়া হয়। “মার্চ ফর জাস্টিস” কর্মসূচি ব্যাপক সাড়া পায় এবং সফল হয়। আপনাদের মনে আছে হয়তো, এক ভাইকে তার বোন জড়িয়ে ধরেছিল যাতে পুলিশ তাকে নিয়ে যেতে না পারে। এরপর কালো কাপড়ের কর্মসূচি দেওয়া হয়। সেদিনই আবার সরকার শোকের কর্মসূচি ঘোষণা করে। সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনা হয়। কারণ বিল্ডিংয়ের জন্য তাদের এত মায়াকান্না, কিন্তু এত মানুষ নির্বিচারে হত্যা করা হলো—তাদের জন্য কোনো অনুশোচনা নেই।
সরকার এই বিষয়টিকে ধামাচাপা দিতে শোক সভার আয়োজন করে। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা করে কালো কাপড় কর্মসূচি বাদ দিয়ে সবার সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইল লাল করি। প্রোফাইল পিকচার লাল করার এই কর্মসূচি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। দেশের বাইরে যারা আছেন তারাও অংশগ্রহণ করেন। মূলত হাসিনার এই শোক দিবসকে প্রত্যাখ্যান করে সবাই। এরপর আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয়। দেশে-বিদেশে সবাই আন্দোলনে যোগ দেন। আপনারা জানেন যে দেশের বাইরে অনেক ভাই আন্দোলন করতে গিয়ে চাকরিচ্যুত হয়েছেন, জেলে গিয়েছেন—বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে এমন ঘটনা ঘটেছে।
এরপর আসে আমাদের “রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোস” কর্মসূচি। জুলাই আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের স্মরণে এই কর্মসূচি পালন করা হয় এবং আন্দোলনে আরেকটি নতুন মাত্রা যোগ হয়। আমাদের কয়েকজন ডিবি অফিস থেকে ছাড়া পান ২ তারিখে। স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও এখানে যোগ দেন। এরপর শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ সব পেশার মানুষ আন্দোলনে যোগদান করেন। ৩ তারিখে এক দফা আন্দোলনের ঘোষণা করা হয়। শহীদ মিনার থেকে নাহিদ ইসলাম এই ঘোষণা করেন।
আগস্টের ৪ তারিখে প্রত্যেকটি স্পটে লাখো লাখো মানুষ জড়ো হয়—এক অসহযোগ আন্দোলনের সৃষ্টি হয়। এরপর গণভবন ঘেরাও করার দাবি আসে। ৬ তারিখ লং মার্চ ঘোষণা করা হয়, কিন্তু পরে সেটা পরিবর্তন করে ৫ তারিখ করা হয়। ৫ তারিখ সকাল ৯টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে দেখি রাস্তাঘাটে কোনো মানুষ নেই—ভাবলাম আন্দোলন কি থেমে গেল! কিন্তু ১১টার দিকে দেখি অন্য চিত্র—লাখো লাখো মানুষ রাস্তায় নেমেছে। একদল মানুষ গুলি খাচ্ছে, মাথায় গুলি খাচ্ছে, তারপরও সামনে আরেক দল আসছে, তারাও গুলিবিদ্ধ হচ্ছে। তারপরও তারা আন্দোলনের মাঠ ছেড়ে যাচ্ছে না। অনেকে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। সবার চোখ দিয়ে পানি ঝরছে, তারপরও তারা আন্দোলন থেকে সরে আসছে না। তারা আরও এগিয়ে যাচ্ছে। এর পরে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। অনেক জায়গায় সন্ধ্যা ছয়টার পরও গুলিবর্ষণ হয়েছে। হাসিনা চলে যাওয়ার পরেও অনেক ধরনের অরাজকতা চলেছে। সমস্ত আত্মত্যাগ এবং ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনই হচ্ছে এই ৫ আগস্ট।
জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে এবং কতটুকু বাস্তবায়িত হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
আলী আহসান জুনায়েদ: ৫ তারিখের সেই আন্দোলনের পর আমরা জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা থেকে বলব—আমরা সামগ্রিকভাবে হতাশা দেখতে পাচ্ছি। কারণ যাদের রক্তক্ষয়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছি আমরা, তাদের এখনো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। শহীদদের পুনর্বাসন, আহতদের পুনর্বাসন এবং তাদের চিকিৎসায় এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
জানুয়ারিতে গেজেট করা হয়েছে। গেজেটে মাত্র ৮৩৪ জনকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। বিচারের বিষয়ে আমরা ধীর গতি দেখতে পাচ্ছি—এর কোনো অগ্রগতি এখনো খুঁজে পাচ্ছি না। আন্দোলনে যে গুমগুলো হয়েছে, হত্যাগুলো হয়েছে—এর বিচার কার্যক্রমও তো আমরা দেখতে পাচ্ছি না।
জাতির মধ্যে একটা সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে—যে সামগ্রিকভাবে একটি পরিবর্তন হবে। এত রক্তক্ষয়ের মাধ্যমে যে সামাজিক একটা পরিবর্তন আসবে, সেই পরিবর্তন কিন্তু এখনো আমরা দেখতে পাইনি। সমাজ কাঠামোয় কোনো পরিবর্তন হয়নি। পুলিশ, প্রশাসন, মিডিয়া বা অন্যান্য ক্ষেত্রে আমরা আগের সেই ফ্যাসিবাদী মানসিকতার সবকিছুই দেখতে পাচ্ছি। এখনো ফ্যাসিবাদের সমর্থন করা হচ্ছে।
জুলাইয়ের সনদ হলো এই অভ্যুত্থানের স্বীকৃতি। এই সনদের মধ্য দিয়েই শহীদ, সংস্কার—সব কিছুর স্বীকৃতি হবে। আমরা চাই এই সনদ সংবিধানে যুক্ত হোক। জাতি যে এই সংগ্রামের অংশ হয়েছে, তার একটা ইতিহাস থাকুক। এর একটি দায়বদ্ধতা তৈরি হোক—যারা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এতদিন আন্দোলন করেছে।
জুলাই সনদ কোনো দাবি নয়—এটা একটা ফ্যাক্ট। এত বড় আন্দোলন হয়েছে—এটার একটা সনদপত্র থাকা উচিত। এই সনদপত্র পেতে যদি আন্দোলন করতে হয়, তাহলে এই অন্তর্বর্তী সরকারের থাকার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই বলে আমি মনে করি।
জুলাইতে যে রাজনৈতিক ঐক্য ও সামাজিক সংহতি দেখা গিয়েছিল তা এখন অনেকটাই ম্লান। কেন হলো এমন পরিস্থিতি?
আলী আহসান জুনায়েদ: এটা খুবই দুঃখজনক বিষয়—আমরা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যেভাবে একসঙ্গে ছিলাম, এখনো যদি সংস্কার কাজে বা যে কোনো দায়িত্বে এক লাইনে চলতে পারতাম, তাহলে খুবই ভালো হতো। আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই রাজনৈতিক বিষয়ে দ্বিমত থাকতে পারে, একেকজনের মতামত একেক রকম হতে পারে। তার মানে এই না যে একে অপরের প্রতি সম্মান হারিয়ে যাবে। দ্বিমত থাকার পরও জাতির স্বার্থে, ন্যায্য দাবির স্বার্থে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। এখন যেহেতু প্রফেসর ইউনুস ক্ষমতায় আছেন, সে ক্ষেত্রে সবাইকে এক করা তার দায়িত্ব। যারা জুলাই আন্দোলন করেছে বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব—সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।
আমরা একসঙ্গে থাকতে পারতাম। কিন্তু এখন যে মতামতের বিভেদ হচ্ছে, আমাদের মনের আকাঙ্ক্ষা—জুলাইয়ের যে সমস্যাগুলো আছে, সেগুলো আগে সমাধান করতে হবে। সেখানে কোনো সঠিক তৎপরতা আমরা দেখতে পাচ্ছি না।
দেখুন, জুলাই সনদ নিয়ে এখনো কোনো সঠিক সিদ্ধান্ত আসেনি। সরকার ৩০ কার্যদিবস সময় চেয়েছে। সেই ৩০ কার্যদিবস পার হয়ে যাওয়ার পরও তারা সামান্য কোনো বিবৃতিও দেয়নি। এই যে পরিস্থিতি—জুলাইকে যদি বাঁচিয়ে রাখা না যায়, তাহলে সামনের রাজনীতি আগের মতো স্বৈরাচারী রাজনীতিতেই পরিণত হবে।
আমরা এই কারণে যুদ্ধ করিনি। আমরা নতুন বাংলাদেশ চাই। সবকিছু নতুনভাবে চাই। সুতরাং জুলাইকে সামনে রেখে আগে গণঅভ্যুত্থানের রাজনীতি হবে, তারপর নির্বাচন হবে।
আপ বাংলাদেশ প্ল্যাটফর্ম কী জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কাজ করছে?
আলী আহসান জুনায়েদ: আপ বাংলাদেশ প্ল্যাটফর্মটি সারাদেশে জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কাজ করছে। জুলাই সনদ নিয়ে ইতোমধ্যেই আমরা ১৬টি পর্ব করেছি—বিভিন্ন জেলায়, বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে। আমরা মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ভাবনা, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভাবনা, জুলাইয়ের আহত-নিহত পরিবারগুলোর ভাবনা—সব শুনেছি।
জানতে চেষ্টা করেছি—তারা জুলাই সনদপত্রে কী চায়। আমরা জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে চাই। এই আলোকে সারাদেশে কমিটি গঠন করার, জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা ছড়িয়ে দেওয়ার তৎপরতা আছে। ফ্যাসিবাদের দোসর গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কাজ করা—এটাও আমাদের উদ্দেশ্য।
আপ বাংলাদেশ প্ল্যাটফর্ম আগামীতে কি কোনো রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে?
আলী আহসান জুনায়েদ: জুলাই অভ্যুত্থানের রাজনীতিকে যদি আমরা মেইনস্ট্রিম রাজনীতি করতে পারি, তবেই আমরা রাজনৈতিক দল গঠন করব। আমরা যদি এখন পুরনো রাজনৈতিক দলের মতো রাজনীতি করতে চাই, তবে আমাদের চাঁদাবাজি, হানাহানি, খুন—এই ধরনের স্বৈরাচারী-ফ্যাসিবাদী কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। এজন্য এখন আমরা রাজনীতিতে ঢুকতে চাই না। আমরা আগে মানুষের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে, ছাত্রদের কথা শুনে এগিয়ে যেতে চাই।
১৬ বছর ধরে আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনীতি ঢুকিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে। শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে। আমরা গুম, খুন, হত্যা, রাহাজানি, অর্থপাচার—এসব দেখে আসছি। দেশে লোক দেখানো তিনটি নির্বাচন হয়েছে। এক রাতের মধ্যে ভোট দেওয়া হয়ে গেছে। জনগণের ক্ষোভের সম্মুখীন হতে হলে আওয়ামী লীগ বা হাসিনার যে পরিণতি—সেই পরিণতি তাদের বরণ করে নিতে হবে।
এখনো যদি তারা সচেতন না হয়, তাহলে যারা জুলাইয়ের জন্য জীবন দিয়েছে, তাদের পরিবারের লোকজন বা অন্য যারা আছে—সবাই কিন্তু বাংলাদেশেই আছে। জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত না হলে তারা আবারও রাজপথে নেমে আসতে পারে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে সাধারণ মানুষের ও ছাত্রদের আবেগকে সম্মান করতে হবে।