
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) শাহ আজিজুর রহমান হলের পুকুর থেকে শিক্ষার্থী হাফেজ সাজিদ আব্দুল্লাহর লাশ উদ্ধারের ঘটনায় ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। মৃত্যুর আগের দিন ১৬ জুলাই বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলছিলেন সাজিদ আব্দুল্লাহ। ওইদিন রাত এগারোটায় পুকুর পাড়ে তার জুতা দেখতে পান কয়েকজন শিক্ষার্থী। পরদিন ১৭ জুলাই (বৃহস্পতিবার) বিকেলে পুকুরে ভেসে থাকতে দেখা যায় তার নিথর দেহ। তার এই মৃত্যুকে ঘিরে রহস্য যেন আরও গভীর হচ্ছে। খেলাধুলার সময় যেসব পোশাক তার গায়ে ছিল সেই পোশাকেই পরদিন লাশ উদ্ধার করা হয়।
সাজিদ থাকতেন শহিদ জিয়াউর রহমান হলের ১০৯ নং কক্ষে। তার পার্শ্ববর্তী কক্ষে থাকা শিক্ষার্থীরা জানান, বুধবার (১৬ জুলাই) বিকেল তিনটার দিকে বৃষ্টিতে ভিজতে বের হন সাজিদ। এরপর বৃষ্টির মধ্যে শাহ আজিজুর রহমান হল পুকুর সংলগ্ন মাঠে ফুটবল খেলতে দেখা যায় তাকে। তার সঙ্গে খেলতে থাকা অন্য খেলোয়াড়রা জানান, প্রায় সোয়া চারটা পর্যন্ত ফুটবল খেলেছেন তারা। খেলার সময় সাজিদের পরনে যে পোশাক ছিলো সেই পোশাকেই তার লাশ উদ্ধার করা হয়।
এদিকে একই পোশাকে ফুটবল খেলার পর তাকে জিয়া মোড় এলাকায় দেখেছিলেন বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও জিয়া মোড়ের দোকানি আব্দুল আলীম। এসময় তার শরীর বৃষ্টিতে ভেজা অবস্থায় ছিলো বলে তিনি জানান। এরপর থেকে আর কোন খোঁজ মেলেনি সাজিদের।
এদিকে বুধবার (১৬ জুলাই) রাত এগারোটার দিকে পুকুর ঘাটে এক জোড়া কালো জুতা দেখতে পান সমাজকল্যাণ বিভাগের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের কয়েকজন শিক্ষার্থী। তাদের একজন জানান, আমরা কয়েকজন বন্ধু বুধবার রাতে পুকুর পাড়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম। সেসময় পুকুর পাড়ে একজোড়া কালো জুতা দেখি। কিন্তু পাশে কাউকে দেখতে পাননি তারা। এদিকে লাশ উদ্ধারের সময়ও সেখান থেকে সেই জুতা জব্দ করা হয়। সেগুলো সাজিদের জুতা বলে নিশ্চিত করেন তার বন্ধুরা।
বুধবার বিকেলের পর সাজিদকে আর তার কক্ষে দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন তার পাশের কক্ষে থাকা আবাসিক শিক্ষার্থীরা। এদিকে সেদিন তার রুমমেটরা কেউ হলে অবস্থানরত ছিলেন না বলেও জানা গেছে। সাজিদ আগেও পুকুরে গোসল করেছে এবং ভালো সাঁতার জানত বলে জানিয়েছে সহপাঠীরা।
আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য এসেছে সাজিদের মোবাইল ফোন ঘিরে। বুধবার রাতে ও বৃহস্পতিবার সকালের দিকে সাজিদের ফোনে কল দেওয়া হলে কল রিসিভ হয় বলে জানিয়েছেন তার কয়েকজন বন্ধু। তবে অন্য পাশ থেকে কেউ কোন কথা বলছিলেন না বলে জানান তারা। পরবর্তীতে সাজিদের লাশ উদ্ধারের পর তার কক্ষ থেকে সেই ফোন উদ্ধারের দাবি করেছেন তার বন্ধু ইনসান। তিনি বলেন, লাশ উদ্ধারের পর সাজিদের পরিবারের সাথে যোগাযোগের জন্য আমার এক জুনিয়রের মাধ্যমে তার কক্ষ থেকে ফোনটি নিয়ে আসি। তবে লাশ উদ্ধারের আগে কীভাবে ফোনকল রিসিভ হলো তা নিয়েও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে লাশ উদ্ধারের পরদিন ১৮ জুলাই সকাল সাড়ে ৯টায় সাজিদের লাশ পোস্টমর্টেম করা হয় বলে জানা গেছে। ২১ জুলাই প্রকাশিত সাজিদের ময়নাতদন্তের প্রাথমিক প্রতিবেদনে পোস্টমর্টেমের প্রায় ৩০ ঘণ্টা পূর্বে (অর্থাৎ আনুমানিক ১৬ জুলাই দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে) সাজিদের মৃত্যু হয় বলে জানানো হয়। কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. রুমন রহমান একই তথ্য জানান। এদিকে মৃতদেহ থেকে সংরক্ষিত বিভিন্ন অঙ্গের রাসায়নিক বা বিষতাত্ত্বিক পরীক্ষার (ভিসেরা রিপোর্ট) ফলাফল আসার পর মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে বলেও ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
এদিকে সোমবার (২১ জুলাই) সাজিদের মৃত্যুর আনুমানিক সময় জানার পর শিক্ষার্থীরা এই মৃত্যুকে ‘হত্যাকাণ্ড’ দাবি করে ক্যাম্পাসের প্রধান ফটক অবরোধ করেন। বিকেল ৪ টা থেকে তারা ফটক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। তিন ঘণ্টা পর অবরোধ তুলে নেন তারা। এসময় তারা মৃত্যুর ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা, ময়না তদন্তের ভিসেরা রিপোর্ট দ্রুততম সময়ে প্রদান, প্রশাসনকে বাদী হয়ে মামলা, সাজিদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ, তদন্তের ভার পিবিআইকে (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) দেয়া, ক্যাম্পাসের সবজায়গায় সিসিটিভি ক্যামেরা লাগিয়ে শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেন।
প্রক্টর অধ্যাপক ড. শাহীনুজ্জামান বলেন, আমরা তদন্তের অগ্রগতির জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। এর আগে শিক্ষার্থীরা অনেকগুলো দাবি দিয়েছিলেন যেগুলো বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, ১৭ জুলাই বিকেল সাড়ে ৬ টায় শাহ আজিজুর রহমান হল পুকুর থেকে আল কোরআন অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ২০২১-২২ সেশনের শিক্ষার্থী সাজিদের লাশ উদ্ধার করা হয়। এরপর থেকে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ উদঘাটনের দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছে ক্যাম্পাস। ১৮ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও হল প্রশাসন থেকে দুইটি তদন্ত কমিটি করা হয়। ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে উভয় কমিটি। এদিকে এই ঘটনায় ক্যাম্পাসে বহিরাগত প্রবেশ নিষিদ্ধ ও পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত পুকুরে নামা নিষিদ্ধ করে মাইকিং করেছে প্রশাসন। এর আগে ১৯ জুলাই সাজিদের মৃত্যুকে ‘হত্যাকাণ্ড’ দাবি করে সুষ্ঠু তদন্ত ও নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে টানা পাঁচ ঘণ্টা বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা।