Image description

গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাকর্মীদের ওপর আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের হামলার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ব্যর্থতার কারণ নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।

এ ঘটনায় সরকারের উচ্চপর্যায়ে উষ্মা প্রকাশ করা হয়েছে। নিরাপত্তা হুমকির সুনির্দিষ্ট একাধিক তথ্য থাকার পরও কেন এ ধরনের হামলা ঠেকানো গেল না কিংবা আগে থেকে তথ্য থাকার পরও কেন হামলা এড়ানো গেল না, তা নিয়ে চলছে আলোচনা।

দেশজুড়ে পদযাত্রার অংশ হিসেবে গতকাল বুধবার গোপালগঞ্জে যান এনসিপির নেতাকর্মীরা। এনসিপির এ পদযাত্রায় হামলা করে গোপালগঞ্জের আওয়ামী সন্ত্রাসীরা।

পুলিশ সদর দপ্তরের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসের প্রথম দিকে গোপালগঞ্জে এনসিপির পদযাত্রা ও সমাবেশের নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে পুলিশের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা হয়। মাঠপর্যায় এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মনিটরিং করে সার্বিক গোয়েন্দা রিপোর্ট প্রস্তুত করা হয়। পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চও (এসবি) এ বিষয়ে রিপোর্ট দেয়। সব রিপোর্টে নিরাপত্তা হুমকির বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। ঘটনার আগের দিন রাতে শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য নিয়েও আলোচনা হয়।

গত মঙ্গলবার পুলিশ সদর দপ্তরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার উপস্থিতিতে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। আইজিপিসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন ওই বৈঠকে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন গোপালগঞ্জের এসপি মিজানুর রহমান এবং ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিক। উপদেষ্টার উপস্থিতিতে গোপালগঞ্জে এনসিপির কর্মসূচির নিরাপত্তাব্যবস্থা ও নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) ১০০ সদস্য মোতায়েনের কথা জানানো হয় জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে। অন্যদিকে আরআরএফ (রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্স) থেকে ১৫০ সদস্য মোতায়েনের কথা জানানো হয় রেঞ্জ অফিসের পক্ষ থেকে। পাশাপাশি জেলা পুলিশের নিয়মিত ফোর্স দায়িত্ব পালন করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।

জেলা পুলিশ ফোর্সের পাশাপাশি অতিরিক্ত ২৫০ সদস্য দিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব বলে জানানো হয়। মাঠপর্যায়ের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা আস্থাশীল থাকার পরও কীভাবে এ হামলা হলো—খোদ পুলিশের উচ্চপর্যায়ে তা নিয়ে চলছে আলোচনা। বলা হচ্ছে, মাঠপর্যায় থেকে চাইলে আরো বেশি ফোর্স দেওয়া যেত। কিন্তু যে পরিমাণে চাওয়া হয়েছে, সে অনুযায়ী ফোর্স মোতায়েন করার পরও কেন এ ধরনের হামলা হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

জানা গেছে, সমাবেশস্থলে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ক্যাডাররা ছিল সব মিলিয়ে ৩০ জনের মতো। অথচ সেখানে পুলিশ ছিল ৬০ জনের মতো। মাত্র ৩০ জন ক্যাডারের হামলা ঠেকাতে পারল না দ্বিগুণসংখ্যক পুলিশ ফোর্স। এ নিয়ে গতকাল ব্যাপক অসন্তোষ প্রকাশ করেন পুলিশের আইজি বাহারুল আলম। এ বিষয়ে তদন্ত করার নিদের্শ দেন তিনি। মাঠপর্যায় থেকে চাহিদা অনুযায়ী ফোর্স দেওয়া হলেও কেন এ হামলা ঠেকানো গেল না, তা নিয়ে অসন্তুষ্ট আইজিপি। অন্তত ১০ দিন আগেই গোয়েন্দা রিপোর্ট পাওয়ার পরও কোনো ধরনের ঝামেলা কাম্য হতে পারে না বলে মনে করছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ।

ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা জানান, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ইউরোপের একটি দেশে পলাতক ও বসবাসরত আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে গ্রুপ কলে মিটিং করেন। গোয়েন্দা তথ্যে বলা হয়েছিল, তিন জায়গায় গাড়িবহরে হামলা হতে পারে। এর মধ্যে কোটালীপাড়া ঢুকতে, জেলা পুলিশ লাইনসের আগে এবং পুলিশ লাইনস পার হওয়ার পর মোড়ে হামলার সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করা হয়।

দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, আওয়ামী পরিকল্পনার অংশ ছিল ছোট বাচ্চা ও মহিলাদের দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়ি লক্ষ্য করে হামলা হবে, ইট মারবে; যাতে পুলিশ ও সেনাসদস্যরা তাদের ওপর চড়াও হয়। এগুলো কয়েকটি সংবাদমাধ্যম (টিভি, পত্রিকা) ভিডিও করবে এবং তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে বলবে এনসিপি নেতারা পুলিশ ও সেনাসদস্যদের দিয়ে গোপালগঞ্জবাসীকে অত্যাচার করেছে। এ ভিডিওগুলো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেবে।

আরো বলা হয়, গোপালগঞ্জ সদর থানার মাঝিগাতী ঢালনিয়া ব্রিজের গোড়ায় ১০০ থেকে ১৫০ জন লোক জড়ো হয়ে হামলা করবে। কাজুলিয়া ও কাটি ইউনিয়নের ৭০০-৮০০ জন লোক কাটি ইউনিয়নের খেলনা ব্রিজের নিচে জড়ো হয়ে হামলা চালাবে। কাশিয়ানী উপজেলার মাঝিগাতী বাসস্ট্যান্ডে লোকজন জড়ো হয়ে সেখানেও হামলা চালাবে বলে আওয়ামী লীগ পরিকল্পনা করে।

সর্বশেষ আইজপির নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আরো ১০০ সদস্য পাঠানো হয় পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে। উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে দুপুরের পর পুলিশ সদর দপ্তরে ছুটে যান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এবং স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ভূঁইয়া সজীব। আগে থেকেই সদর দপ্তরে ছিলেন আইজিপি। তারা সেখানে বসে গোপালগঞ্জের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেন। শেষ পর্যন্ত পুলিশ ও সেনবিাহিনী মিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।

আইজিপি বাহারুল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, ধৈর্য ধরে পুলিশ গোপালগঞ্জের পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করেছে। গোপালগঞ্জে আমরা প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করিনি, তাই আমাদের একটু সময় লেগেছে। উচ্ছৃঙ্খলতা যা হয়েছে, সেটা যতটুকু সম্ভব আমরা ধৈর্যের সঙ্গে প্রশমন করার চেষ্টা করছি। পুরো জিনিসটা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য পরে আরো পুলিশ ফোর্স পাঠনো হয়।