
আগামীতে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো এককভাবে কিংবা জোটবদ্ধ হয়ে ভোটে লড়তে চাইলে সংশ্লিষ্ট দলগুলোর প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা প্রমাণের জন্য নিজ দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে।
এই বিধান যুক্ত করে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ- ১৯৭২ (আরপিও) সংশোধনের প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। অন্যের জনপ্রিয় প্রতীক নিয়ে জনসমর্থনহীন দলের সংসদে যাওয়ার পথ বন্ধ করতে ইসি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আরপিও সংশোধনের খসড়া প্রস্তাবনার নথি পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া যায়।
জানা যায়, নিবন্ধন প্রথা চালু হওয়ার পর গত ৪ নির্বাচনে জনসমর্থন না থাকলেও নামসর্বস্ব অনেক দল বড় দলের সঙ্গে জোট বেঁধে ভোট করেছে। এ সময় জনপ্রিয় প্রতীকে ভোট করার কারণে ছোট দলগুলোর প্রার্থীরা সহজেই জয় পেয়ে এমপি হয়েছেন। যেমন— ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনএফ নামে নামসর্বস্ব একটি দলের প্রধান ‘নৌকা প্রতীক’ নিয়ে এমপি নির্বাচিত হন। পরে এ দলের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। অথচ সংসদে গিয়ে তার পরিচয় দাঁড়ায় বিএনএফের দলীয় এমপি তিনি। তাই আরপিওর ২০(১) অনুচ্ছেদ যোগ করে সেখানে বলা হয়েছে, জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও কোনো রাজনৈতিক দল নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন না করলে ওই দলের জনভিত্তি এবং জনপ্রিয়তা যাচাই করার সুযোগ থাকে না। নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করলে একদিকে যেমন ওই দলের জনপ্রিয়তা সম্পর্কে জানা যায়। অন্যদিকে, সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য এবং সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
খসড়ায় দেখা গেছে, আরপিওর ৪৮টি অনুচ্ছেদে কম-বেশি সংযোজন-বিয়োজন ও নতুন ধারা যোগ করা হচ্ছে। যার মধ্যে সংযোজন হচ্ছে ১৫টি নতুন অনুচ্ছেদ, পুরোনো ৫টি অনুচ্ছেদে বিদ্যমান বিধানের সঙ্গে যুগোপযোগী নতুন বিধান সন্নিবেশ করা এবং বাকি ২৮টি অনুচ্ছেদে সংযোজন-বিয়োজন আনা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ভোটকেন্দ্র ও ভোটকক্ষের নাজুক পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রিসাইডিং অফিসার (ভোট গ্রহণ)-এর ক্ষমতা পুনর্বহাল করা হচ্ছে। বিগত কমিশন আরপিওর ২৫(১) ধারাটি ২০২৩ সালে সংশোধন করে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ভোট গ্রহণ বন্ধে প্রিসাইডিং অফিসারের ক্ষমতা শর্তাধিন সীমিত করেছিল। বিপরীতে বেড়েছিল ভোটকেন্দ্র বন্ধে পুলিশ কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হস্তক্ষেপ।
খসড়ায় আরো দেখা যায়, ভালো নির্বাচন আয়োজনে প্রয়োজনীয় আর্থিক বরাদ্দ কিংবা চাহিদামতো সরঞ্জামাদি কিংবা নিরাপত্তা বাহিনীর সাপোর্ট, এক্ষেত্রে সরকার ও ইসির মধ্যে ওই সহায়তার বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিলেও কমিশনের চাহিদাকে প্রাধান্য দিতে হবে। একইভাবে নির্বাচনের কাজে জড়িত কোনো কর্মকর্তা ও কর্মচারী কিংবা সরকারের কোনো বিভাগ কর্তব্যে অবহেলা কিংবা অনিয়মে জড়ালে তাহলে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে ইসি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় পুলিশ-র্যাব-বিজিবি-আনসার-আর্মস পুলিশ ব্যাটালিয়ন-ব্যাটালিয়ন আনসার-এর পাশাপাশি নতুনভাবে কোস্টগার্ড, বিএনসিসি এবং সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী যুক্ত হচ্ছে। সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করতে চাইলে প্রার্থীকে অবশ্যই ন্যূনতম স্নাতক পাস হতে হবে। এ বিষয়ে ইসির ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, স্নাতক পাসের নিচে বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হতে পারে না। একজন সংসদ সদস্য দেশের আইন প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ফলে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক পাসের নিচে বাঞ্ছনীয় নয়।
আরপিও সংশোধনের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, দুটির বেশি আসনে প্রার্থী হওয়া যাবে না। ব্যালটে প্রতীকের পাশাপাশি ‘না’ ভোট অন্তর্ভুক্তের সুপারিশ করা হয়েছে। প্রার্থীর অবাধ স্বাধীনতার অংশ হিসেবে সরাসরি অথবা অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমার বিধান রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এদিকে, আরপিওর ১৫(৩) ও (৪) নতুন অনুচ্ছেদ যোগ করার প্রস্তাব করা হচ্ছে। সেখানে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীর মনোনয়নপত্র চূড়ান্তকরণে ইসির সিদ্ধান্তই অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। আরপিওর ২৭(১)-এ বলা হয়, পোস্টাল ব্যালটের পাশাপাশি প্রক্সি ভোটিং অথবা অনলাইন ভোটিং অথবা ভোটার এলাকার বাইরে স্থাপিত ভোটকেন্দ্রে সরাসরি ভোটিং পদ্ধতির মাধ্যমে বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে ভোট দেওয়া যাবে। আরপিওর ৪৪ (ঘ) নতুন অনুচ্ছেদ যোগ করা হয়েছে। সেখানে নির্বাচনি ব্যয়ের রিটার্ন দাখিলের পর তা অডিট করবে ইসি। এক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম পেলে কমিশন তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর নির্বাচন বাতিল করতে পারবে। পাশাপাশি ওই আসনের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে বিজয়ী ঘোষণা অথবা নতুন নির্বাচন করা যাবে।
নির্বাচনে অনিয়মের কারণে পুরো আসনের ভোট বাতিলের ক্ষমতা বাদ দিয়েছিল বিদায়ী কাজী হাবিবুল আউয়ালের কমিশন; সেটি ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। আরপিওর ৯১(ক) ধারায় নির্বাচনে বল প্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন এবং চাপ সৃষ্টিসহ বিরাজমান অপকর্মের কারণে নির্বাচন করা না গেলে ভোট গ্রহণসহ নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধ হবে। আর আরপিওর ৯১(চ)(১) ধারা নতুনভাবে যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, যে কোনো উৎস থেকে কমিশন যদি জানতে পারে নির্বাচিত প্রার্থী হলফনামার তথ্যে বা আয়-ব্যয়ের রিটার্নে গরমিল বা মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন, তাহলে নির্বাচিতকে শুনানির সুযোগ দেবে ইসি। একই সঙ্গে তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পেলে ওই আসনের নির্বাচনের ফল বাতিল করে সেখানে নতুন নির্বাচন করা যাবে।