
এক সময় বস্তির প্রতিবেশীদের কাছে ছোট্ট ছেলেকে রেখে কাজে যেতেন মা মিছিলি বেগম। ছেলে একটু বড় হলে সেও মায়ের সঙ্গে ভাঙারি কুড়াতো। এরপর ছেলে টুকটাক কাজ করতো দিনমজুর হিসেবে। কিন্তু গত বছর জুলাই আন্দোলনে একটা গুলি লেগে সব শেষ হয়ে যায় মা মিছিলি বেগমের। এখন আর ঢাকায় থাকেন না। প্রায়ই ছেলের কবরের কাছে বসে কাঁদেন তিনি।
ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডে কাঁচপুর সেতুর কাছে ঠিকাদারের অধীনে ওয়াসার পানির লাইন মেরামতের কাজ করতেন জাকির হোসেন (২৪)। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষ ও সারাদেশে কারফিউ জারি হওয়ায় বাসায় ফিরতে পারছিলেন না তিনি। তাই সেখানেই একটি ভবনে থেকে কাজ করে যাচ্ছিলেন। ২১ জুলাই বিকেলে কাজ শেষে সহকর্মীদের সঙ্গে পাশের একটি দোকানে চা-নাশতা খেতে যান। হঠাৎ একটি গুলি এসে লাগে জাকিরের পিঠে। গুলি লাগার পর দৌড়ে পাশের একটি গলিতে গিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন জাকির। সেখানেই মৃত্যু হয় তার।
পরে অন্য সহকর্মীরা দ্রুত মরদেহ নিয়ে যান জাকিরের মায়ের কাছে, বাড্ডা নতুন বাজার এলাকায়। মা রাতেই মরদেহ নিয়ে রওনা হন গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার বাকলজোড়া ইউনিয়নের বাকলজোড়া গ্রামে। পরদিন সোমবার ১০টায় জানাজা শেষে দাফন করা হয় জাকির হোসেনের মরদেহ।
দুর্গাপুর উপজেলার বাকলজোড়া গ্রামে জাকিরের বাড়িতে গেলে এভাবেই কেঁদে কেঁদে ছেলের মৃত্যুর গল্প বলছিলেন মা মিছিলি বেগম। ছেলে মারা যাওয়ার এক বছর পরও ছেলের কাপড় হাতে নিয়ে বিলাপ করেন মা মিছিলি বেগম।
শুক্রবার দুপুরে গিয়ে দেখা যায় কবরের পাশে বসে আছেন তিনি। জানতে চাইলে বলেন, ‘নিজের কোনো ভিটেমাটি না থাকায় ছোট্ট জাকিরকে নিয়ে রাজধানীর বাড্ডা নতুন বাজার এলাকায় চলে যাই। সেখানে গিয়ে রাস্তা থেকে ভাঙারি কুড়িয়ে, মানুষের বাসায় কাজ করে ছেলেকে বড় করতে থাকি। ১৫-১৬ বছর বয়স হওয়ার পর কাজ শুরু করে জাকির। এতে কিছুটা দুঃখ ঘুচতে শুরু করে। পরে ভাঙারি কুড়ানো বন্ধ করে দেন। ছেলের আয়ের টাকা দিয়ে সম্প্রতি গ্রামে ঘর তৈরির জন্য ১৫ শতক জায়গাও কিনেছিলেন। থাকার জন্য একটা ঘর নির্মাণের পরিকল্পনাও করছিলেন তারা। কিন্তু হঠাৎ একটি গুলি জীবন কেড়ে নিলো জাকিরের। তার স্বপ্ন শেষ হয়ে গেলো মুহূর্তেই।
মিছিলি বেগম বলেন, আন্দোলন শুরুর তিন-চার দিন আগে কাঁচপুর সেতুর কাছে ওয়াসার লাইনের কাজ করতে গিয়েছিল জাকির। ঠিকাদারের অধীনে দৈনিক মুজরি হিসেবে কাজ করত। আন্দোলনের কারণে বিপদের ভয়ে বাসায় না এসে সেখানেই থেকে যায়। ফোনে প্রতিদিন বলত, মা আন্দোলন চলছে, গুলি চলছে, বাসায় আসলে রাস্তায় গুলি লাগতে পারে। রোববার বিকেলে সহকর্মীদের সঙ্গে পাশের একটি চায়ের দোকানে চা-নাশতা খেতে যায়। দোকানের সামনে যেতেই পাশের একটি উঁচু বিল্ডিং থেকে একটি গুলি এসে জাকিরের পিঠে বিদ্ধ হয়। দৌড়ে সে একটা গলিতে গিয়ে পড়ে যায় মাটিতে। তার নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। সেখানেই মারা যায় জাকির। পরে ঘরের জন্য কেনা জায়গাটাতেই জাকিরকে দাফন করা হয়।
জাকির হোসেন বাকলজোড়া ইউনিয়নের বাকলজোড়া গ্রামের মৃত ফজলু মিয়ার ছেলে। ফজলু মিয়া ছিলেন দরিদ্র দিনমজুর। অন্যের বাড়িতে বসবাস করতেন তারা। জাকিরের বয়স যখন ৫ বছর, তখন মারা যান তিনি।
মিছিলি বেগম বলেন, স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলের দিকে চেয়ে জীবনটা পার করে দিয়েছি। ছেলে বড় হলে দুঃখ ঘুচবে সেই আশায় ছিলাম। ভাঙারি কুড়িয়ে ছেলেকে বড় করেছি। ছেলে বড় হয়েছে, দুঃখও ঘুচে যাচ্ছিল। কিন্তু একটা গুলি এসে আমার সব স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে। আমার আর কোনো আশা নেই। আমার পৃথিবী শেষ হয়ে গেছে। এভাবে বেঁচে থাকার আর মানে নেই। আল্লাহ যেন এর বিচার করেন।
প্রতিবেশী হাবিবুর রহমানসহ অন্যরা জানান, মিছিলির জীবনের গল্পটা করুণ। যে ছেলের জন্য জীবনটা উজাড় করে দিয়েছেন, সেই ছেলেকে বিনা দোষে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এখন তার আর কোনো অবলম্বন নেই। এত কষ্ট সহ্য করে মানুষ কীভাবে বাঁচে জানা নেই।
জাকিরের খালতো ভাই এন্তাস মিয়া বলেন, জাকির প্রায় সময়ই কল করে আমাকে সাবধানে থাকার পরামর্শ দিত। অথচ এখন তার মৃত্যু দেখতে হলো। তার মায়ের সবকিছু শেষ হয়ে গেল। সরকার থেকে সাহায্য করেছে। একটি ঘর করে দিয়েছে। সেই ঘরেই একা থাকেন জাকিরের মা।
নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস জাগো নিউজকে বলেন, জুলাই আন্দোলনে শহীদ জাকিরের মাকে একটি ঘর করে দেওয়া হয়েছে। দশ লাখ টাকার এফডিআর করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও সরকারি বেসরকারি সহায়তা দেওয়া হয়েছে।