Image description

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ধারাবাহিক ‘জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচির নাম পাল্টে হয়ে গেল ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’, রাতভর ছড়ানো দ্বিমুখী গুজবে গোপালগঞ্জে বাড়ল উত্তেজনা; শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের হামলার জেরে সংঘাতে প্রাণ ঝরল অন্তত চারজনের।

সেনাবাহিনী ও পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ার পর প্রথমে জারি করা হল ১৪৪ ধারা; এরপরও সংঘাত না থামায় বুধবার রাত ৮টা থেকে ১০ ঘণ্টার কারফিউ জারি করতে হল সরকারকে।

গোপালগঞ্জে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে হামলাকে ‘ন্যাক্কারজনক’ হিসবে অভিহিত করে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল; ঘোষণা করা হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি।

হামলার ঘটনাকে মানবাধিকারের ‘লজ্জাজনক লঙ্ঘন’ হিসেবে অভিহিত করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলেছে, “এই নৃশংস হামলায় জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। এটা স্পষ্ট করে বলতেই হয়–এ দেশে সহিংসতার কোনো স্থান নেই; ন্যায়বিচারের জয় হবেই হবে।”

 

 

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের অগাস্টে সরকার পতনের পর মাঠের কর্মসূচিতে না থাকা আওয়ামী লীগের ‘ঘাঁটি’ হিসেবে পরিচিত গোপালগঞ্জে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের জের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কার কথাও বলছেন কেউ কেউ।

সংঘাত বাড়তে থাকলে আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, উত্তেজনা কমানোর উদ্যোগ নিক সরকার। এ সংঘাত এড়ানো যেত কি-না, সেটাও ভাবাচ্ছে তাদের।

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বলেছেন, “প্রথমত, যা ঘটেছে এটা খুবই দুঃখজনক এবং উদ্বেগজনক এর সাথে। কারণ, উদ্বেগ এজন্য যে, এই ঘটনার আরও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটতে পারে। এবং দেশে যখন একটা নির্বাচন আকাঙ্ক্ষা করা হচ্ছে, তার আগে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।

“আরেকটি কথা হল, যখন আমরা জুলাই শহীদদের স্মরণ করছি এবং বিশেষ করে আবু সাঈদের মৃত্যুর যে দিন, সেই দিবসে এরকম একটা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং ন্যাক্কারজনক ঘটনা কোনোমতেই কাম্য নয়।”

এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “এখন এই ঘটনা পরবর্তীতে আরও সংঘাত ও উত্তেজনার দিকে যাবে কি-না, সেটা বিভিন্ন পক্ষের ভূমিকা ও পদক্ষেপের উপরে নির্ভর করবে। ইতোমধ্যে অনেক জায়গায়ই, উত্তেজিত জনতা বা মবের ছদ্মবেশে বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক মহল ব্যক্তির অধিকার, মানবাধিকার ও আইনশৃঙ্খলাবিরোধী ঘটনা ঘটিয়েছে, সরকার সেগুলির প্রতি উদাসীন ছিল, সরকার সেগুলো দক্ষভাবে দমন করে নাই।

“এইরকম যদি হয় যে, সরকার বা প্রশাসন যথাযথ দায়িত্ব পালন করছে না এবং বিশৃঙ্খলা ও মব সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে উদাসীন থাকছে, হাত গুটিয়ে থাকছে, আবার বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করছে, তাহলে কিন্তু এটা বাড়তেই থাকবে, আরো হবে এরকম। কাজেই তাদের ভূমিকার উপর নির্ভর করবে।”

 

 

যা ঘটল দিনভর

গোপালগঞ্জে এনসিপির পদযাত্রা ও সমাবেশ ঘিরে মঙ্গলবার থেকেই উত্তেজনা ছড়াতে শুরু করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চলানো হয়।

বুধবার সকালে এনসিপি নেতারা গাড়িবহর নিয়ে শহরে ঢোকার আগেই পুলিশের গাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে ঘটনার সূত্রপাত হয়। পরে ইউএনওর গাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে।

এসবের মধ্যে বেলা দেড়টার দিকে নিষিদ্ধ দল আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা মিছিল করে এসে জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে গোপালগঞ্জ শহরের পৌরপার্ক এলাকায় সমাবেশ মঞ্চে হামলা চালায়।

এরপর পুলিশ ও এনসিপি নেতাকর্মীরা জড়ো হয়ে ধাওয়া দিলে হামলাকারীরা পালিয়ে যান। পরে ওই মঞ্চে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে এনসিপি নেতারা পুলিশি নিরাপত্তায় টেকেরহাট হয়ে মাদারীপুর যাওয়ার পথে রওনা দেন। তারা দুপুর পৌনে ৩টার দিকে শহরের লঞ্চ ঘাট এলাকায় পৌঁছালে গোপালগঞ্জ সরকারি কলেজের সামনে ফের হামলা হয়।

এসময় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের সংঘর্ষে গোপালগঞ্জ শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।

 

 

এ পরিস্থিতিতে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আশ্রয় নেন। পরে তারা সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যানে করে পুলিশ সুপার কার্যালয় ছাড়েন।

দুপুরে জেলা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে স্থানীয় প্রশাসন। তাতেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় সন্ধ্যায় কারফিউ জারির ঘোষণা আসে।

দফায় দফায় হামলা, সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত গোপালগঞ্জ শহরে অন্তত চারজন নিহত হওয়ার খবর এসেছে। রাত ৮টা পর্যন্ত গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের চারটি মরদেহ আসার কথা জানিয়েছেন হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক ডা. জীবিতেষ বিশ্বাস।

গোপালগঞ্জের কর্মসূচি শেষ করে মাদারীপুর যাওয়ার কথা থাকলেও সেদিকে বুধবার আর যাননি এনসিপির নেতারা; খুলনায় গিয়ে রাতে সংবাদ সম্মেলন করেন দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।

তার অভিযোগ, গোপালগঞ্জে ‘মুজিববাদীরা’ হত্যার উদ্দেশে জঙ্গি কায়দায় এনসিপির নেতাকর্মীদের উপর হামলা চালিয়েছে।

হামলাকারীদের গ্রেপ্তারে সরকারকে ২৪ ঘণ্টার সময় বেঁধে দিয়ে তিনি বলেন, “ফ্যাসিস্ট ও ‘মুজিবাদীরা’ অস্ত্র নিয়ে এই হামলা চালিয়েছে, তারা পুলিশের উপর হামলা চালিয়েছে।”

 

 

তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ একটি জঙ্গি সংগঠনে পরিণত হয়েছে। তারা আর রাজনৈতিক দল নেই। সেটা তারা স্পষ্ট করেছে। আমরা আগেই বলেছিলাম, সারাদেশের ফ্যাসিস্টদের আশ্রয়কেন্দ্র হয়ে উঠেছে এই গোপালগঞ্জ। মামলার আসামিরা এখানে আছে। তারা হত্যার উদ্দেশে এই হামলা চালিয়েছে।”

তিনি বলেন, “গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দল সমাবেশ করতে পারে না। আমরা আজকে সেই মিথ ভেঙে দিয়েছি।”

এ সময় হামলার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার সারাদেশে বিক্ষোভের কর্মসূচিও ঘোষণা করেন এনসিপির আহ্বায়ক।

বৃহস্পতিবার ফরিদপুরে তাদের নির্ধারিত পথসভার কর্মসূচি বহাল থাকবে বলেও জানান তিনি।

এনসিপির সমাবেশে হামলার প্রতিবাদে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু সময় ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় ‘ব্লকেড’ কর্মসূচিও পালন করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

সংঘাত কেন এড়ানো গেল না

এনসিপি ও সরকারের দিক থেকে কর্মসূচির বার্তাটা সঠিকভাবে না দেওয়ায় সংঘাত ঘটেছে বলে মন্তব্য করে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন বলেন, এই সংঘাত ‘অবশ্যই’ এড়ানো যেত।

“সরকার এবং এনসিপি সতর্ক থাকলে গোপালগঞ্জের কর্মসূচি আগে থেকেই শান্তিপূর্ণভাবে ঘটানোর একটা পরিবেশ তৈরি করা যেত এবং এই দুঃখজনক পরিস্থিতিতে চারজন মারা গেছে, আরো মারা যেতে পারে– এটি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল।”

একইসঙ্গে ক্ষমতায় থাকার সময়ের কৃতকর্মের জন্য আওয়ামী লীগের সুর ‘নরম’ না করে উল্টো পথে চলাকেও এই ঘটনার আরেকটা কারণ হিসেবে মানছেন এই বিশ্লেষক।

তিনি বলেন, “আমরা যদি এই কর্মসূচিটাকে এভাবে দেখি যে, এই উত্তেজনাকার পরিস্থিতিটা সৃষ্টির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী কারা? কোথা থেকে উত্তেজনাটা সৃষ্টি করা হল? তাহলে আমি বলব যে, এর প্রথম দায়িত্ব পদযাত্রা যারা করছে এনসিপি, তাদের।

 

 

“এই জন্য যে তারা এটাকে একটার পর একটা জেলায় পদযাত্রা বলছে, কিন্তু গোপালগঞ্জে আসার আগে তাদের ভাষাটা একটু পরিবর্তিত হল কেন? তারা কেন এটা মার্চ টু গোপালগঞ্জ বলল? এই যে ইংরেজিতে তারা কর্মসূচির নাম দেয় ‘মার্চ টু’, এটা স্বাভাবিকভাবেই শ্রোতাদের কাছে ‘মার্চ টু ঢাকার’ মত, যেটাতে সরকার পতন হল, সেটার মতো শোনা যায়।”

‘জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচি থেকে ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ হয়ে যাওয়াটাতে ‘ভাষাগত’ উস্কানি রয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “কাজেই যারা কর্মসূচি দিয়েছেন, তারা কিন্তু একটি নতুন দল, তরুণদের দল; সেই হিসেবে তাদের ঘোষণাটা রাখা উচিত ছিল এরকম, যে ‘আমরা জুলাই শহীদদের স্মরণে এবং জুলাই আদর্শ বাস্তবায়ন, সেই আদর্শে বাংলাদেশ গড়ার জন্য আমরা নতুন দল, আমাদের কিছু কথা নিয়ে আমরা জনগণের কাছে যাচ্ছি, আমরা গোপালগঞ্জ বাসীর কাছে যেতে চাই। গোপালগঞ্জবাসী আমাদের অনুষ্ঠানে আসুন এবং আমরা আমাদের কথা আপনাদের বলব, আপনারা শুনুন।’

“তারা এইরকম একটা অ্যাপ্রোচ না নিয়ে, তারা প্রথমেই উস্কানিমূলক অ্যাপ্রোচ নিল। আবার তারাও জানে, যে একটা উস্কানির পরিবেশ কিন্তু রয়ে গেছে।”

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক ‘ইনফ্লুয়েন্সারদের’ তরফে এই কর্মসূচিকে ধানমণ্ডি-৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ভাঙার ধারাবাহিকতায় টুঙ্গি পাড়ায় সমাধি গুড়িয়ে দেওয়ার ‘উস্কানিমূলক’ মনে হওয়ার কথাও তুলে ধরেন মোজাম্মেল হোসেন।

তিনি বলেন, “তাদের কাছে শোনা গেছে যে, ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি বা জাদুঘর ভেঙ্গে দিতে পেরেছি, আমরা এখন বঙ্গবন্ধুর মাজার ভাঙব- এরকম উস্কানিমূলক বক্তব্য কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছিল।

 

 

“এই বিষয়ে এনসিপি এবং সরকারের সতর্ক থাকা উচিত ছিল, যে গোপালগঞ্জে হচ্ছে একটি স্পর্শকাতর জায়গা। বঙ্গবন্ধুর কবর সেখানে। এই স্পর্শকাতরতার বিষয়ে এনসিপি এবং সরকারের কোনো সতর্কতা ছিল না, সাবধানতা ছিল না। আমি বলব যে, এই জায়গাতে বিপদজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।”

এক্ষেত্রে এর আগে গোপালগঞ্জে সেনাবাহিনী ও পুলিশের আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের সংঘাতের কথাও স্মরণ করিয়ে দে তিনি।

‘নিষিদ্ধ’ ছাত্রলীগের হামলার বিষয়ে সরকারের আগাম সতর্কতার ঘাটতি থাকার কথা তুলে ধরে মোজাম্মেল হোসেন বলেন, “সরকার আজ যে বিবৃতিটি দিয়েছে এই ধরনের একটি বিবৃতি, যে সকল জায়গায় শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখুন, সকলের রাজনৈতিক মত প্রকাশের অধিকার আছে।

“আর যাদেরকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তাদেরকে আইনত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তারা যদি কোনো রকম উস্কানিমূলক কার্যকলাপ করে তাহলে সরকার কঠোরভাবে দমন করবে। এ ধরনের আগাম সতর্কতা সরকার দিতে পারত।”

সংঘাতের মধ্য দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে শঙ্কা তৈরি হওয়ার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, “নির্বাচনকে পিছিয়ে দেওয়ার জন্য কোনো না কোনো মহলের চক্রান্তমূলক কৌশল, অভিলাষ- এগুলো থাকতে পারে। কিন্তু এই কারণেও সবারই সতর্ক থাকা উচিত ছিল।

 

 

“আমরা জানি না, তবে জনগনের মনে এখন এই সন্দেহ যদি দানা বাঁধে যে, গোপালগঞ্জের এই ঘটনার মধ্যে এমন কোনো উস্কানি এবং চক্রান্ত ছিল, যার দ্বারা নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার মত একটা পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়, তাহলেতো দোষ দেওয়া যাবে না।”

ক্ষমতায় থাকার সময়ের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা এবং আত্মবিশ্লেষণ না করে উল্টো হুমকি দিয়ে আওয়ামী লীগ তার কর্মী-সমর্থকদেরকে ‘মৃত্যুর মুখে ঠেলে’ দিচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন মোজাম্মেল হোসেন।

আওয়ামী লীগের সব নেতার পলাতক বা গ্রেপ্তার থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “গত এক বছরের মধ্যে তারা কীভাবে রাজনীতিতে ফিরে আসবে, সে বিষয়ে নেতৃত্ব কোনো দিশা দেখাতে পারল না।

“এবং এটা ঠিক যে আওয়ামী লীগের শাসনকালে নানা ধরনের অন্যায়, অত্যাচার, দুর্নীতি, নির্বাচনকে বিনষ্ট করা- এগুলো নিয়ে মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ছিল। সেই তীব্র ক্ষোভেরই তো বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এক বছর আগে এবং সরকারের পতনও ঘটেছে।”

তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের নিজেদের সময়ে তারা জনগণের মনে যে আঘাত দিয়েছে, সেই বিষয়ে কিছুটা নরম হওয়া এবং নিজেদের আত্মবিশ্লেষণ করে জনসাধারণের কাছে উপস্থিত হওয়া- এ ধরনের কোনো রাজনৈতিক কর্মকৌশল ছাড়াই তারা বলে যাচ্ছে, ‘আমরা ফিরে আসব এবং সকলকে দেখিয়ে দেব, আমরা ফিরে আসব এবং কেউ রক্ষা পাবে না, দেশ থেকে পালাতে পারবে না’।

“এই কথাগুলিও কিন্তু দেশের রাজনীতিতে অনেক উত্তেজনা তৈরি করছে এবং গোপালগঞ্জের মত পরিস্থিতির পেছনে যে এরও ভূমিকা নাই, তা বলা যাবে না।”

তিনি বলেন, “কাজেই আওয়ামী লীগকে প্রথমত তাদের নিজেদের কৃতকর্ম সম্পর্কে এবং কেন তারা জনসাধারণের এরকম রোষের মুখে, বিক্ষোভের মুখে উৎখাত হয়ে গেল সেটা বিশ্লেষণ করা দরকার। একটা আত্মবিশ্লেষণ, আরেকটা তাদের অনুশোচনা থাকলে সেটা ঠিক করা দরকার এবং জনগণের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য তার রাজনৈতিক কৌশল ঠিক করা দরকার।

“এই রাজনৈতিক কৌশল ও নেতৃত্ব ঠিক না করে নেতারা পলাতক থাকবেন, আর দেশের ভেতরের তরুণ কর্মী-সমর্থকদেরকে এভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবেন। এটাও কাম্য নয়।”

গোপালগঞ্জের ঘটনাকে ‘খুবই দুঃখজনক’ আখ্যায়িত করে সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা কি কোনো আরোপিত কিছু কি-না, সেটি নিয়ে ভাবতে হবে। এনসিপির পদযাত্রা হল, সেটি গোপালগঞ্জে গেল, এটিকে ঘিরে টুঙ্গিপাড়াকে নিয়ে অনেক গুজব ছড়ানো হল; গুজবের শিকার হলেন মানুষ। আমাদের আরও গভীরভাবে দেখতে হবে যে কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে।

“এটা খুবই দুঃখজনক যে মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আমরা কোনো ধরনের মৃত্যু চাই না। আমরা চাই দেশে একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকুক, গণতন্ত্রের চর্চা হোক এবং গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে সমাধানটি বেরিয়ে আসুক।”

আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশে এ ঘটনা কোন প্রভাব রাখবে কি-না জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, “নিশ্চয়ই রাখবে, কেউ কেউ বলার চেষ্টা করবে যে যেখানে একটি জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, সেখানে নির্বাচন কীভাবে হবে?

“এ কথাতো অনেকে বলা শুরু করেছে। সেজন্যই এটা কি কোনো আরোপিত ঘটনা, সাজানো ঘটনা, না স্বতস্ফুর্ত ঘটনা সেটি খতিয়ে দেখতে হবে।”

 

 

রাজনৈতিক দলের প্রতিক্রিয়া, কর্মসূচি

এনসিপির সমাবেশে হামলা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। পাশাপাশি ঘোষণা করেছে কর্মসূচি।

এনসিপির কর্মসূচিতে হামলা ঘটনাকে ‘নৈরাজ্যের মাধ্যমে ফায়দা হাসিলের অপতৎপরতা’ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

তিনি বলেন, ‘‘ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর পতনের পর দুষ্কৃতিকারীরা আবারও দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিসহ নৈরাজ্যের মাধ্যমে ফায়দা হাসিলের অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে।”

তিনি বলেন, “গোপালগঞ্জে এনসিপির কর্মসূচিতে বর্বরোচিত হামলা, ককটেল বিস্ফোরণ, ইউএনওসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং পুলিশ সদস্যদের আহত করার বর্বর ঘটনা সেই অপতৎপরতারই বহিঃপ্রকাশ।”

অবিলম্বে দুষ্কৃতিকারীদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবির পাশাপাশি আহত পুলিশ সদস্যদের সুস্থতা কামনা করেন বিএনপি মহাসচিব।

এনসিপির সমাবেশে হামলা ও সংঘাতের মধ্যে বুধবার বিকালে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বলেন, “গোপালগঞ্জে কী হচ্ছে? গোপালগঞ্জ তো বাংলাদেশেরই অংশ। যতদূর জানতে পেরেছি, এনসিপির নেতৃবৃন্দ স্বাভাবিক নিয়মে সর্বপর্যায়ের প্রশাসনের সঙ্গে পূর্ব থেকেই আলাপ-আলোচনা করে তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহায়তা চেয়েছেন। এটি তাদের রাজনৈতিক অধিকার।

“এখন যে অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, কার্যত মাঠে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো উপস্থিতিই লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। অতি দ্রুত সরকারকে অবশ্যই প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় ইতিহাসের পূর্ণ দায় সরকারের ওপরে বর্তাবে।”

এরপর নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের হামলা, অগ্নিসংযোগ ও নৈরাজ্যের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার সব জেলা ও মহানগরীতে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করে জামায়াত।

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও এনসিপির মত আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হামলাকারী আওয়ামী 'সন্ত্রাসীদের' গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছে।

সন্ধ্যায় শাহবাগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির সভাপতি রিফাত রশিদ বলেন, “গোপালগঞ্জে যা শুরু হয়েছে সেখানে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা এবং দিল্লি এদের চক্রান্তে গোপালগঞ্জের মধ্যে একটি প্রক্সি স্টেট কায়েম করেছে।

”সেখানকার সার্বভৌমত্ব নিয়ন্ত্রণ করছে স্বৈরাচারী হাসিনা এবং দিল্লির মসনদে বসে থাকা ওই লুটেরারা, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সার্বভৌমত্বকে সবসময় ছিনিয়ে নিতে চায়। আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, এই প্রক্সি স্টেট খেলা আমরা হতে দিব না।’

সংঘর্ষের প্রতিক্রিয়ায় জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) সহ-সভাপতি ও দলীয় মুখপাত্র রাশেদ প্রধান বলেন, দিল্লির আশ্বাসে ’ফ্যাসিবাদী’ আওয়ামী শক্তি এখনও আস্ফালন করে। পুলিশ হত্যার বিচারের কথা বলে নিজেরাই পুলিশের উপরে হামলা করে।

“এই দেশ এখন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী খুনি হাসিনার নয়, এই দেশ এখন মুগ্ধ, ওয়াসিম, আবু সাঈদের। দেশবাসী প্রস্তুতি নেন, গোপালকে দিল্লি পাঠিয়ে, গোপালগঞ্জকে আবু সাঈদগঞ্জ বানাতে হবে।”

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেন, “অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির এই সময়েও স্বৈরাচারের দোসররা যে দুঃসাহস দেখিয়েছে তা সরকারের সামগ্রিক ব্যর্থতার বড় একটি দৃষ্টান্ত। পতিত ফ্যাসিবাদের বিচার এবং এর সাথে জড়িতদের বিচারের ধীরগতির কারণেই এরা আজকে এই সাহস করেছে।

“তাই বলবো, কেবল ঢাকায় গুটিকয়েকজনকে বিচারের আওতায় আনলে হবে না বরং সারাদেশে স্বৈরতন্ত্রের সাথে জড়িত সকলকে দ্রুত বিচারের আওতায় আনুন। এই ধরনের দুঃসাহস জাতী আর দেখতে চায় না।”

গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশে ‘নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীদের’ হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে খেলাফত মজলিস বলেছে, “গণঅভ্যুত্থানে পরাজিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির সুযোগে আবারো সংগঠিত হতে শুরু করেছে। এদেরকে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

“প্রশাসনকে এই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে এখনই কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। হামলাকারীদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এই ফ্যাসিবাদী অপশক্তি যাতে দেশের জানমালের আর ক্ষতি করতে না পারে সরকারকে সতর্ক হতে হবে।”

এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন এলডিপির সভাপতি অলি আহমদ। সেই সঙ্গে হামলাকারীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তিনি।

গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেছেন, “গোপালগঞ্জের হামলা প্রমাণ করে চব্বিশের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পরাজিত শক্তির সংগঠিত আক্রমণ আগামী জাতীয় নির্বাচন বানচালের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্থ করার একটি চক্রান্তের বহিঃপ্রকাশ।”