
‘আমার আব্বার বয়স হইছে। উনি যদি আজকে অন্যভাবে মারা যাইতেন, আমরা বিষয়টা মেনে নিতে পারতাম। হেলিকপ্টার থেকে পাখির মতো শিকার করে আমার আব্বাকে মারছে। আব্বার বুকটা ঝাঁঝরা করে ফেলছে। আব্বার বুকটার কথা মনে পড়লেই আর সহ্য করতে পারি না।’ কথাগুলো বলেই অঝোরে কাঁদলেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহিদ আব্দুর রহমানের (৬৫) ছেলে ফয়সাল। খবর বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)
২০২৪ সালের ২১ জুলাই সারাদেশের ন্যায় নারায়ণগঞ্জেও চলছিল কারফিউ। তবে কারফিউ না মেনেই ছাত্র-জনতা আন্দোলনে নেমে পড়ে। নারায়ণগঞ্জের ভূইগড় এলাকার সিকদার পাম্পের সামনে তাদের সাথেই যুক্ত হন ষাটোর্ধ্ব আব্দুর রহমান। ছাত্রদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে আন্দোলনে নামেন তিনি। কিন্তু আন্দোলনে নামার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই হেলিকপ্টার থেকে একটি বুলেট এসে তার বুকে বিঁধে, মুহূর্তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন আব্দুর রহমান।
পরিবারের সদস্যরা জানান, আব্দুর রহমান ভূইগড়ের পুরান বাজার এলাকায় ভাড়া বাসায় পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। সেদিন বেলা ১১টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংকরোডে মিছিলে যোগ দেন। মিছিলে যাওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তার মৃত্যুর খবর আসে।
আব্দুর রহমানের ছেলে বলেন, ‘আব্বাকে না করছিলাম, বলছিলাম বাইরের পরিস্থিতি ভালো না। তুমি কোথাও যেও না। বাসায় আব্বাকে রেখে আমি একটু কাজে চাষাড়া গেছিলাম। রাস্তায় থাকা অবস্থায় একজনের কল আসে। রিসিভ করতেই বলা হলো, আপনার আব্বার গায়ে গুলি লাগছে, হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘শুনে অবাক হয়ে গেলাম। মাত্রই তো আব্বাকে বাসায় দেখে আসলাম, আব্বা খাচ্ছিলেন, হাসাহাসি করছিলেন। পরে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য রওনা দিই। পথেই ফোন আসে-হাসপাতালে যেন না যাই, আব্বা আর নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘কথাটা আমি নিতে পারিনি। আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। সেসময় আমার সঙ্গে আমার বন্ধু ছিল, সে আমাকে বাসায় নিয়ে আসে। সেদিন বিকেলে আব্বাকে জানাজা দিয়ে পরদিন বাবার জন্মস্থান চাঁদপুর জেলার বালিয়া ইউনিয়নের দেওয়ানবাড়ি এলাকার স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করি।’
আব্দুর রহমানের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর। তবে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে তিনি তিন দশক ধরে নারায়ণগঞ্জের সদর উপজেলায় বাস করতেন। জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার জন্য অনেক কাজ করেছেন তিনি। অবশেষে ভূইগড়ের পুরান বাজার এলাকায় একটি ভাঙারির দোকান দিয়েছিলেন।
বড় ছেলে ফয়সাল (৩৪) কাভার্ড ভ্যানের চালক। মেয়ে বৃষ্টিকে (২২) নিজ জেলা চাঁদপুরে বিয়ে দিয়েছেন। ছোট ছেলে রনি (২৫) ও মেহেদী (২০)-কে নিয়ে বেশ সুখেই দিন কাটছিল আব্দুর রহমানের। কিন্তু বটবৃক্ষের মতো ছায়া দেওয়া বাবাকে আকস্মিকভাবে হারিয়ে সন্তানেরা হতবাক হয়ে পড়ে।
ফয়সাল বলেন, ‘আব্বা অনেক আদর করে ছোট থেকে বড় করেছে। নিজে কষ্ট করলেও আমাদের ভাই-বোনদের কখনো কষ্ট করতে দেন নাই। একটু একটু করে আমাদের ব্যবসাটা একটা পর্যায়ে নিয়ে আসছিলাম। আজ সব কিছু ছেড়ে চলে আসছি আব্বার কাছে। ওই মাটি আর ভালো লাগে না।’
তিনি জানান, অটোরিকশা চালিয়ে পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করেন তিনি। নিজেদের ব্যবসা বিক্রি করে ছোট ভাই রনিকে কুয়েত পাঠিয়েছেন। বাবা হারানোর শোক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি পরিবারের কেউ। বাবার কবরের পাশেই নতুন করে জীবন শুরু করেছেন।
দীর্ঘ দিনের জীবনসঙ্গীকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব শাহানারা বেগম। তিনি বলেন, ‘আমি মেয়ের কাছে গ্রামে আসছিলাম। সে আগের দিন ফোন করে বলছিল, আইসা পড়ো। আমিও ভাবছিলাম তাড়াতাড়ি চলে যাবো। সেই আশা আর পূরণ হলো না। কী দোষ করেছিল ফয়সালের আব্বা? বুড়া একটা মানুষকে এভাবে খুন করে? মানুষটার শরীর থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হয় নাই। এই রক্তচোষাদের বিচার চাই আমি।’
সরকারিভাবে আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন শহিদের পরিবার। তবে সরকারের কাছে তার হত্যার সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন সন্তানরা।