Image description
আবু সাঈদ প্রথম শাহাদৎ দিবস

ছেলের খুনিদের বিচার দেখে মরতে চান শহীদ আবু সাঈদের বাবা-মা। শুধু তাদের ছেলে আবু সাঈদ না, সকল শিক্ষার্থী হত্যার বিচার চান তারা। আল্লাহ যেন ছেলে হত্যার বিচার না দেখিয়ে মৃত্যু না দেন এটাই কামনা করেন আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন।

আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন বলেন, আমার ছেলের স্বপ্ন ছিল প্রশাসনিক ক্যাডারে যোগ দিয়ে দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানো। ছেলে হারিয়ে আজও আমি আদালতের দোরগোড়ায় ঘুরছি। বিচার চাই, শুধু আমার ছেলের না, সেই দিনের সকল শিক্ষার্থীর হত্যার বিচার চাই। আল্লাহ যেন আমার ছেলে হত্যার বিচার না দেখিয়ে মৃত্যু না দেন। আমি বিচার দেখার জন্য বাঁচতে চাই। পাশাপাশি কোন রাজনৈতিক দলের টানা-হেঁচড়ার মধ্যেও পড়তে চান না সাঈদ এবং তার পরিবার। সাঈদের বাবা মকবুল হোসেনের অভিযোগ, প্রতিদিনই বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীরা তাদের দলে যোগ দেয়ার জন্য আমাকে এবং আমার অন্য ছেলেকে প্রস্তাব দেয়। আমরা বার বার বলে আসছি, আমরা কোনো রাজনৈতিক দলের না, কোনো রাজনৈতিক দলে যেতেও চাই না। তারপরও প্রতিনিয়ত আমাদেরকে বিভিন্ন দলে ডাকা হচ্ছে। এটা আমাদের কাছে খুবই বিরক্তিকর। ছেলের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে আবু সাঈদের মা মনোয়ারা বেগম বলেন, ছেলে হারানোর বেদনা কোনোভাবে সহ্য করা যাচ্ছে না। হত্যাকা-ের বিচার হলে হয়তো কিছুটা স্বস্তি পাবো। ছেলেকে হারানোর এক বছর পেরিয়ে গেলেও মা মনোয়ারা বেগম সেই দিনটার কথা ভুলতে পারেননি। ভুলতে পারেননি ছেলের নিথর দেহ অ্যাম্বুলেন্সে করে বাড়ির দুয়ারে আসার সেই মুহুর্তের কথা। তিনি তার জীবদ্দশায় ছেলে আবু সাঈদসহ সকল শিক্ষার্থী হত্যাকারীদের ফাঁসি দেখতে চান। আজ তার প্রথম শাহাদৎ দিবসে সাংবাদিকদের সামনে এসব কথা ও দাবি উত্থাপন করেন সাঈদের বাবা, মা ও ভাই-বোন।

শহীদ আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলি বলেন, আমার ভাই শহীদ হওয়ার এক বছর হয়ে গেল, অথচ আমার ভাইয়ের হত্যার বিচার পাইনি। এখন পর্যন্ত মাত্র ৪-৬ জন আসামিকে ধরা হয়েছে। মামলার কোনো অগ্রগতি নেই। বিচার কার্যক্রমের অগ্রগতি জানতে আমরা ট্রাইব্যুনালে গিয়েছিলাম। আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে, জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে সব শহীদের হত্যার বিচার সম্পূর্ণ হবে। আমরা সেই বিচার দেখার অপেক্ষায় আছি।

শহীদ আবু সাঈদের বোন সুমি খাতুন বলেন, আমরা সাদামাটা জীবনযাপন করতাম। আমাদের খুব কম ছিল, কিন্তু ভাইদের সঙ্গে সবকিছু ভাগাভাগি করে আমরা অনেক সুখী ছিলাম। এখন হয়তো অনেক কিছু আছে, কিন্তু কোনো কিছুতে সুখ নেই। আমি খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।

আবু সাঈদ ছিলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিল। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বেরোবি সমন্বয়ক ছিলেন। এই আন্দোলনের প্রথম শহীদ তিনি। বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বাবনপুর গ্রামে। বাবা মকবুল হোসেন একজন কৃষক ও মা মনোয়ারা বেগম গৃহিণী। ৯ ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিল সাঈদ।

ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছিলেন আবু সাঈদ। পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি লাভ করেন আবুু সাঈদ। পরে এলাকার খালাশপীর দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাস করেন। এরপর ভর্তি হন রংপুর সরকারি কলেজে। সেখান থেকেও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। কলেজের গ-ি পেরিয়ে ভর্তি হন বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্বপ্ন দেখতেন বিসিএস দিয়ে প্রশাসনে যোগ দেবেন। তাকে ঘিরে পাহাড়সম স্বপ্ন ছিল দরিদ্র মা-বাবার। ঘাতক পুলিশ নিমিষেই গরিব এই পরিবারের সকল স্বপ্ন কেড়ে নেয়।

২০২৪ সালের (১৬ জুলাই) আজকের এই দিনে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) এক নম্বর ফটকের সামনে সমবেত হন ‘কোটা সংস্কার’ আন্দোলনকারীরা। শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে প্রবেশের চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দেয়। শুরু করে লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেল ছোড়া। পুলিশের সঙ্গে যোগ হয় ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ আওয়ামীলীগের অস্ত্রধারী নেতাকর্মীরা। ভয়ে সবাই দৌড়ে পালাতে থাকে দিকবিদিক। শিক্ষার্থীদের দমনে পুলিশ প্রায় ২’শ রাউন্ড গুলি ও রাবার বুলেট ছোড়ে। কিন্তু আবু সাঈদ বুক টান করে, দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকে। মুহূর্তেই তার বুক ঝাঁজরা হয়ে যায় পুলিশের গুলিতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাটিতে ন্যুইয়ে পড়ে সাঈদ। পরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। আবু সাঈদের মৃত্যুর আগ মুহূর্তের ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়।

আজ তার শাহাদৎ বরণ করে নেওয়ার এক বছর। বেরোবির শিক্ষার্থীরা ১৬ জুলাইকে শহীদ আবু সাঈদ দিবস হিসেবে পালন করছেন। পুরো ক্যাম্পাসে কালো ব্যানার, স্মরণসভা, কবিতা পাঠ, মোমবাতি প্রজ্জ্বলনসহ নানা আয়োজনে তাকে স্মরণ করা হচ্ছে।